প্রত্যেক বাবা মা সন্তানের মঙ্গল কামনা করেন। কিন্তু নিত্য নৈমিত্তিক কাজ আর সংসারের নানা চিন্তার বেড়াজালে নিজেরা এমনভাবে আবদ্ধ হয়ে যাই যে সন্তানের প্রতি আলাদা করে মনোযোগ দিতে ভুলে যাই। আর সেই ভুলের ফলাফল দাঁড়ায়- কিশোর কিশোরীদের আত্মহত্যা, কখনোবা মাদকাসক্তি।
পিতৃত্ব কিংবা মাতৃত্ব আমাদের জীবনের অন্যতম আশীর্বাদ। তাই সকল অভিভাবকের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব সন্তানকে পর্যাপ্ত আদর ভালোবাসা দিয়ে লালন-পালন করা। সেই সাথে তাদেরকে যথাযথ মূল্যবোধ শেখানো, ভালো-মন্দের মধ্যে তফাত খুঁজে বের করতে সাহায্য করাও গুরুত্বপূর্ণ। লালনপালনের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ আপনার সন্তানকে অনেক বেশী আশাবাদী, আত্মবিশ্বাসী এবং ভবিষ্যতের সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। অনেক সময় ব্যস্ততার জন্য সন্তানকে সময় দিতে পারেন না। তাই আপনাদের জন্য আমাদের আজকের আয়োজন কীভাবে একজন ভালো অভিভাবক হতে পারেন?
১. সন্তানকে যে ভালবাসেন সেটা প্রকাশ করুন
ভালোবাসা জীবন থেকে সব ধরনের গ্লানি, বিষণ্নতা দূর করতে সক্ষম। তাই আপনার সন্তান আপনার কাছে যে ভালোবাসা পাওয়ার ইচ্ছা পোষণ করে সেটি তাকে পর্যাপ্ত পরিমাণে দিতে হবে। একটা উষ্ণ আলিঙ্গন অথবা মাথার উপর আশীর্বাদের হাত তার জীবন থেকে সকল কষ্ট, গ্লানি মুহূর্তে মুছে ফেলতে সক্ষম।
২. সন্তানের প্রশংসা করুন
সন্তান সবসময় বাবা মায়ের কাছ থেকে তার প্রশংসা শুনতে পছন্দ করে। এটি তাকে ভালো কাজ করার অনুপ্রেরণা দেয়। তাই তাদের সাফল্যে অবশ্যই তার তারিফ করুন। এমনকি যদি তারা কোনো কাজে সফল নাও হয় তাও তাকে অনুপ্রাণিত করে এমন কিছু বলুন। যেমন- “পরের বার ভালো করবে তুমি”, “তুমি আমাদের কাছে সবসময় বিজয়ী”। এগুলো আপনার সন্তানের মনে ইতিবাচক ভূমিকা তৈরি করে।
৩. তুলনা কিংবা পক্ষপাত থেকে দূরে থাকুন
অন্যের সন্তানের সাথে নিজের সন্তানের তুলনা থেকে বিরত থাকুন। প্রতিটি শিশুরই নিজস্ব স্বকীয়তা আছে। তাদেরকে তাদের নিজেদের মত বিকশিত হতে দিতে হবে। তুলনা অনেক সময় শিশুদের মানসিকতাকে ধ্বংসাত্বক করে তোলে। তারা প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে উঠে। এমনকি নিজের সন্তানদের মধ্যেও তুলনা অথবা পক্ষপাত করা উচিত নয়। এতে ভাইবোনের সম্পর্কেও ছেদ দেখা দেয়।
৪. মনোযোগ দিয়ে সন্তানের কথাগুলো শুনুন
আপনার সন্তান আপনাকে কি বলতে চায় তা শোনার এবং তার পরিপ্রেক্ষিত বোঝার চেষ্টা করুন। শোনার পর আপনার মতামত দিন যে কাজটি তার জন্য উপযোগী নাকি ক্ষতিকর। তাদের ভালো সময়ে তাদের পাশে থাকুন। তাদের বিশেষ দিন যেমন: জন্মদিন উদযাপন করুন। হোমওয়ার্ক করতে সাহায্য করুন। মাঝে মাঝে স্কুলে গিয়ে শিক্ষক-শিক্ষিকার কাছ থেকে তাদের পড়াশোনার খোঁজখবর রাখুন। এতে আপনার সন্তান বুঝতে পারবে যে, তার বাবা মা তার বিষয়ে অত্যন্ত সচেতন।
৫. সন্তানকে আদরের পাশাপাশি শাসনও করুন
আপনার সন্তানের জন্য নির্দিষ্ট সীমানা তৈরি করুন। জীবনের ভালো-মন্দ দিকগুলো সম্পর্কে তাদের অবহিত করুন। বন্ধু নির্বাচনের ক্ষেত্রে তাদের সাহায্য করুন। অন্যায় করলে তা বুঝিয়ে বলুন প্রয়োজনে শাসন করুন। পাঠক, শাসন করা মানে গায়ে হাত তোলা নয়। তাছাড়া বয়সন্ধিকালে সন্তানরা না বুঝে অনেক ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে। তাই আপনার সন্তানকে স্বাধীনতা দিন কিন্তু তার একটি নির্দিষ্ট সীমারেখা তৈরি করে দিন।
৬. পারিবারিক বন্ধন মজবুত করুন
সন্তান সবসময় বাবা-মা কে একত্রে দেখতে চায়। তাই সন্তানের সামনে পিতা-মাতার বন্ধন মজবুত হওয়া জরুরি। এগুলো সন্তানের মানসিক বিকাশে গুরূত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বাবা-মা’দের মতের অমিল থাকতেই পারে এবং মতবিরোধ হতেই পারে কিন্তু সেটি সন্তানের সামনে প্রকাশ করবেন না। যদি আপনি সিঙ্গেল বাবা অথবা মা হন তবুও কখনো সন্তানকে তার মা অথবা বাবা সম্পর্কে নেতিবাচক কথা বলা থেকে বিরত থাকুন। এতে সন্তানের মনে বাবা-মা এর সুন্দর প্রতিচ্ছবি নষ্ট হতে পারে। সন্তানের উপস্থিতিতে দুইজনের হাসি মুখ সন্তানের সারাদিনের অনুপ্রেরণার উৎস হতে পারে।
৭. সন্তানের কাজকর্মকে বিচার করুন
বয়ঃসন্ধিকালে অনেক সময় সন্তান ভুল কাজ করে থাকে। কারো সাথে অভদ্রতা করে থাকলে বাবা-মা হিসেবে আপনার উচিত তার সেই অন্যায়ের বিচার করা। তাদের অন্যায়গুলোকে তাদের সামনে তুলে ধরা। জনসম্মুখে তারা কোনো মন্দ কাজ করলে সেখানেই তাকে বকুনি দেওয়া থেকে বিরত থাকুন। বাসায় গিয়ে নিজের মতো করে তাকে তার ভুল অনুধাবন করতে সাহায্য করুন এবং তার মাঝে অনুশোচনাবোধ জাগ্রত করুন।
৮. সন্তানকে আত্মবিশ্বাসী করে তুলুন
জোরপূর্বক তাদের উপর কিছু আরোপ না করে তারা যে কাজে আগ্রহী তা করতে সহায়তা করুন। তাদেরকে আত্মবিশ্বাসী করে তুলুন। তাদেরকে নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে নিজে উপার্জন করতে শেখান। বিভিন্ন প্রতিযোগিতামূলক কাজে অংশ নিতে উদ্বুদ্ধ করুন। এগুলো তাদের কোমল মনের বিকাশ সাধন করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।
৯. সন্তানের আদর্শ হন
সন্তান সবসময় তার বাবা-মাকে অনুসরণ করে। তাই তাদের সামনে ভালো কাজের উদাহরণ তৈরি করুন। আপনি যদি চান আপনার সন্তান স্বাস্থ্যবান হবে তাহলে আপনার উচিত তাকে নিয়ে প্রতিদিন সকালে হাঁটতে যাওয়া। তাকে স্বাস্থ্য সচেতন করে তুলত হলে আগে নিজেকে সেভাবে প্রস্তুত করতে হবে। সুষম খাদ্য গ্রহণ করতে হবে। এখান থেকে তারা শিক্ষা গ্রহণ করবে।
১০. জীবন থেকে শিক্ষা নিতে অনুপ্রাণিত করুন
মানুষ তার নিজের জীবন থেকে সবচেয়ে বেশী শিক্ষা নেয়। তাই আপনার সন্তানকে জীবনমুখী শিক্ষা দিন। জীবনকে উপভোগ করতে শেখান। অনেক পাঠ সে জীবনের প্রতি ধাপে নিজেই শিখে যাবে যখন সে নিজে সেই পরিবেশকে মোকাবিলা করবে।