নতুন নতুন বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারগুলো শুধুমাত্র বিজ্ঞানকেই সমৃদ্ধশালী করেনি বরং পৃথিবীতে এনেছে এক বৈচিত্র্যময় পরিবর্তন। বিজ্ঞানের উন্নতি সাধনে পুরুষদের পাশাপাশি নারীরাও পিছিয়ে নেই। যেসব নারীরা তাদের বৈজ্ঞানিক চিন্তা ও কর্ম দিয়ে বিজ্ঞানের জগতে খ্যাতি অর্জন করেছেন তাদের মধ্যে অন্যতম ১০ জন নারী হলেন।
১. ডরোথি হজকিন
ডরোথি হজকিন ১৯১০ খ্রিস্টাব্দের ১২ মে মিশরের কায়রোতে জন্মগ্রহণ করেন। তবে তিনি নাগরিক সূত্রে ব্রিটিশ জীব রসায়নবিদ ছিলেন। তিনি ও তার সহকর্মীরা মিলে পেনিসিলিনের গঠন আবিষ্কার করেন। ডরোথি অনেক জৈব অণুর ত্রিমাত্রিক গঠন আবিষ্কার করেন। এছাড়াও তিনি ভিটামিন বি-১২ এর গঠন আবিষ্কার করেন। ডরোথি হজকিন এক্সরে ক্রিস্টালোগ্রাফিতে অন্যতম একজন পথিকৃত বিজ্ঞানী ছিলেন। তার সাড়া জাগানো কাজ প্রোটিন ক্রিস্টালোগ্রাফি ১৯৬৪ সালে তাকে রসায়নে নোবেল পুরস্কার এনে দেয়। ১৯৯৪ সালের ২৭ জুলাই এই বিখ্যাত নারী বিজ্ঞানী ইহলোক ত্যাগ করেন।
২. রোজালিন্ড ফ্রাঙ্কলিন
রোজালিন্ড ১৯২০ সালের ২৫ ই জুলাই লন্ডনে জন্মগ্রহণ করেন। আমাদের মধ্যে যারা বিশ্বাস করেন যে, ডিএনএ মডেলের একমাত্র অবদানকারী ওয়াটসন এবং ক্রিক, তাদের সময় হয়েছে ইতিহাস ঘেঁটে দেখার। কারণ এটি আসলে সেই নারীর অবদান, যিনি সেই ইতিহাসটা তৈরি করেছিলেন। রোজালিন্ড এমন এক পদ্ধতি বের করেন যাতে সর্বপ্রথম ডিএনএ এর ছবি তোলা সম্ভব হয়। এই ছবির নাম ফটো ৫১ আর এর ওপরে ভিত্তি করেই ওয়াটসন এবং ক্রিকের থিসিস দাঁড়িয়ে যায়।
যুক্তরাজ্যের এই নারী রসায়বিদ ও এক্সরে ক্রিসটোলোগ্রাফার বিশ্বে সর্বপ্রথম ডিএনএ, আরএনএ, ভাইরাস, কয়লা, গ্রাফাইটের আণবিক কাঠামো বোঝাতে অবদান রাখেন। ডিএনএর কাঠামো আবিষ্কারের জন্য আজও আলোচিত তিনি। ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে ১৯৫৮ সালে এই মহান নারী মারা যান।
৩. বারবারা ম্যাকলিন্টক
বারবারা ম্যাকলিন্টক ১৯০২ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি নোবেলজয়ী আমেরিকান জীব বিজ্ঞানী ছিলেন। তিনি সর্বপ্রথম ভুট্টার ক্রোমোজমে ট্রান্সপোজেবল জেনেটিক এলিমেন্ট তথা অবস্থান পরিবর্তনে সক্ষম বংশগতির উপাদান আবিষ্কার করেন। আধুনিক জেনেটিক বিদ্যা তার এ আবিষ্কারের কাছে বিশেষভাবে ঋণী। নোবেল কমিটি তার এ আবিষ্কারের গুরুত্ব অনুধাবন করতে পেরে ১৯৮৩ সালে তাকে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত করেন।
৪. মারিয়া গ্যোপের্ট-মায়ার
মারিয়া গ্যোপের্ট-মায়ার জার্মান বংশোদ্ভুত মার্কিন তাত্ত্বিক ও পদার্থবিজ্ঞানী। যদি এডওয়ার্ড টেলার হয় হাইড্রোজেন বোমার জনক তবে মারিয়া গ্যোপের্ট-মায়ার হলোর জননী। মারিয়া ও ইয়োহাসেন মিলে নিউক্লিয় শক্তিস্তরের গঠন আবিষ্কার করেন। এ আবিষ্কারের ফলাফল হিসেবে দু’জনই পদার্থবিজ্ঞানে নোবেলজয়ী খেতাব অর্জন করেন। সাহিত্য জগতেও তার কিছু খ্যাতি রয়েছে। বিজ্ঞান কল্পকাহিনী রচয়িতা গ্রেগরি বেনফোর্ড রচিত উপন্যাস “টাইমস্কেপ”-এ মারিয়া গ্যোপের্ট-মায়ারের উল্লেখযোগ্য এবং ক্ষুদ্র অবদান রয়েছে।
৫. জেন গুডঅল
জেন গুডঅল হলেন একজন নৃবিজ্ঞানী। বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আন্দোলনের জন্য সারা বিশ্বজুড়ে পরিচিত এই নারী। মাত্র ২৬ বছর বয়সে তিনি শিম্পাঞ্জিদের উপর গবেষণা করতে তানজানিয়ায় পাড়ি জমান। দীর্ঘ ৫৫ বছর ধরে তানজানিয়ার ন্যাশনাল পার্কে শিম্পাঞ্জি নিয়ে গবেষণা করছেন তিনি। মানুষের বর্বরতা থেকে এদের রক্ষা করতে ১৯৯৬ সাল থেকে নন-হিউম্যান রাইটস আন্দোলন শুরু করেন ড. জেন গুডঅল।
৬. জারট্রুড ইলিওন
জারট্রুড ১৯১৮ সালে নিউইয়র্কে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি আমেরিকান জীব রসায়নবিদ ও ফার্মাকোলজিস্ট ছিলেন। বর্তমানে লিউকোমিয়া তথা শ্বেত কণিকা আধিক্য ঘটিত রক্ত স্বল্পতা এবং হার্পেটিক ভাইরাস জনিত সমস্যার চিকিৎসা করা সম্ভব হচ্ছে এই মহান বিজ্ঞানীর জন্যেই। তিনি প্রথম ইমিউনোস্পপ্রোসিভ ড্রাগ অ্যাজাথিওপ্রিনের আবিষ্কার করেন যা অর্গান ট্রান্সপপ্ল্যান্ট ব্যবহার হয়। ১৯৮৮ সালে তিনি চিকিৎসা বিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পান। অাধুনিক চিকিৎসা শাস্ত্রে তার অবদান অনস্বীকার্য।
৭. আইরিন জোলিও কুরি
আইরিন জোলিও কুরি ছিলেন বিখ্যাত ফরাসী বিজ্ঞানী। এছাড়াও, তিনি মারিয়া স্ক্লদভ্স্কা কুরি এবং পিয়ের কুরি দম্পতির কন্যা ও ফ্রেদেরিক জোলিও-কুরি’র স্ত্রী ছিলেন। ১৯৩৫ সালে তিনি এবং তাঁর স্বামী ফ্রেদেরিক জোলিও-কুরি’র সাথে যৌথভাবে কৃত্রিম তেজস্ক্রিয় পদার্থ আবিস্কারের ফলে রসায়নশাস্ত্রে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন।
কৃত্রিম তেজস্ক্রিয়তা আবিস্কারের ফলে স্বল্পকালীন সময়ের মধ্যে বোরন, ম্যাগনেসিয়াম এবং অ্যালুমিনিয়াম সহযোগে আলফা উপাদান থেকে রেডিওআইসোটোপ তৈরী করা সম্ভব হয়েছিল। মনে করা হয়, তার গবেষণা কর্মের ফলে এখন পর্যন্ত মিলিয়ন মিলিয়ন জীবন রক্ষা পেয়েছে।
৮. হেডি লেমার
আপনি যদি ওয়াইফাই , রেডিও ব্যবহার করে থাকেন , তাহলে হেডি লেমারকে অন্তত একবার ধন্যবাদ দিন। আধুনিককালের ওয়াইফাই প্রযুক্তি উদ্ভবের পিছনে তার অবদানকে একেবারে অস্বীকার করা সম্ভব না। তিনি মার্কিন চলচ্চিত্র অভিনেত্রীও ছিলেন। তার অভিনীত চলচ্চিত্র বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। তবে তিনি ছিলেন রেড়িও কমিউনিকেশনে প্রকৌশল বিদ্যা অর্জনকারী।
২য় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার দিনে রেড়িও কমিউনিকেশন জ্যামিং থেকে মুক্তি পেতে হেডি লেমার আবিস্কার করলেন ফ্রিকুয়েন্সি টু ফ্রিকুয়েন্সি জাম্প পদ্ধতি। সুন্দরী লেমার তখনি ডিজাইন করলেন সেন্ডার আর রিসিভার জ্যাম্প ফ্রিকুয়েন্সী। যেটি ব্যবহার করলে শত্রু কখনো ফ্রিকুয়েন্সী ডিটেক্ট করতে পারবে না এবং জ্যাম ও করতে পারবে না। লেমার এটির নাম রাখলেন ফ্রিকুয়েন্সী হোপিং। পরবর্তীতে এটির নাম করন করা হয় স্প্রেড-স্পেকট্রাম কমিউনিকেশন।
৯.লিজে মাইটনার
লিজে মাইটনার ছিলেন একজন পদার্থবিজ্ঞানী। তিনি নিউক্লীয়ফিউশন এর প্রথম সফল ব্যাখ্যাদাতা। মনে করা হয় যে, তার যুগান্তকারী আবিষ্কারের ফলে আমেরিকার মানহাটান প্রজেক্টের বিজ্ঞানীরা এ্যাটম বোমা তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিলেন, আর বিশ্ব রাজনীতির ক্ষমতার চিত্রটাই পাল্টে গিয়েছিল। পরমাণু বোমার আঘাতে ছোট্ট দেশ জাপানের গুরুত্বপূর্ণ আর বর্ধিষ্ণু শহর হিরোশিমার মৃত্যু হয়েছিল।
আর সেই সঙ্গে শেষ হয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ নামক প্রলয়কান্ড। বিজ্ঞানের জগতে ১০৯ নম্বর মৌলটিকে তার নামে নামকরণ করে সেটির নাম দেওয়া হয়েছে, মাইটনেরিয়াম। যতদিন বিজ্ঞানের ইতিহাস চলমান থাকবে ততদিন মৌলের তেজস্ক্রিয়তা নিয়ে গবেষণার ক্ষেত্রে উচ্চশক্তিসম্পন্ন পারমাণবিক সংঘর্ষের ফলে সৃষ্ট মাইটনেরিয়াম মৌলটির নাম উল্লেখ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মাইটনারের নামটি মনে করা হবে।
১০. মেরি কুরি
আমরা অনেকেই তাকে জানি তেজস্ক্রিয়তার আবিষ্কারক হিসেবে কিন্তু পাশাপাশি তিনি পেলোনিয়ামেরও আবিষ্কারক। তিনিই সেই প্রথম মহিলা বিজ্ঞানী যে বিজ্ঞানের দুইটি ভিন্ন শাখায় দুইবার নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। পদার্থবিজ্ঞানে তিনি নোবেল পান তেজষ্ক্রিয়তা নিয়ে কাজ করার জন্য। আর রসায়নে নোবেল পান পিচব্লেন্ড থেকে রেডিয়াম পৃথক করার জন্য। এক্সরে প্রযুক্তির উপর তার উচ্চতর গবেষণা, বর্তমানে চিকিৎসা বিজ্ঞানের অতি আবশ্যকীয় একটি হাতিয়ার হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফরাসি এ নারী বিজ্ঞানী ১৯৩৪ সালে ৬৬ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন।
বিজ্ঞানের অগ্রগতিতে এই নারী বিজ্ঞানীদের অবদান অনস্বীকার্য। এদের গবেষণা কর্মকে ভিত্তি করেই, আজকের বিজ্ঞানীরা নতুন নতুন বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তি ও কৌশল আবিষ্কার করতে সক্ষম হচ্ছে। ফলে পৃথিবী আজ নতুন এক বিস্ময়কর রূপ নিয়ে আমাদের কাছে হাজির হয়েছে। তাই এই নারী বিজ্ঞানীদের ভুলে যাওয়া কখনও সম্ভবপর নয়।