সময় এবং স্রোত কারো জন্য অপেক্ষা করে না। এই কথাটি আসলেই সত্য। সময় একবার চলে গেলে তা কখনোই ফিরে আসবে না। তাই আপনার দিনের ২৪ ঘন্টার মাঝের কোন সময়য় যাতে অযথা নষ্ট না হয় সেদিকে খেয়াল রাখা অবশ্যই প্রয়োজন। তবে এর মাঝেও নিজের জন্য কিছু সময় বরাদ্ধ রাখতে হবে। সেই সময়টুকু কখনোই নষ্ট সময়ের তালিকায় পড়বে না, বরং আপনার নিজের কর্মক্ষমতা বাড়াবে।
আপনার দিনের সবটুকু সময় যাতে ভালো কাজে ব্যয় হয় সেজন্য প্রয়োজন একটি সুন্দর রুটিন। রুটিনমাফিক চললে আপনার সব সময়ের উপযুক্ত ব্যবহার হবে। প্রতিদিন সকালে উঠেই আপনার ঠিক করে নিতে হবে সারাদিন কী কী করবেন। এই সকালের রুটিন ঠিক করে নেওয়ার উপরই নির্ভর করছে আপনার পুরো দিন কিভাবে কাটাবেন। চলুন জেনে নেওয়া যাক সেই ১৪টি অভ্যাস যা আপনাকে আরো উৎপাদনশীল করে তুলতে সহায়তা করবে।
১. সকালে তাড়াতাড়ি উঠুন
যদিও সকল সফল ব্যক্তিদের সবাই সকালে ঘুম থেকে উঠার তালিকায় নেই, কিন্তু তন্মধ্যে বেশীরভাগই সকালে ঘুম থেকে উঠতেন। রিচার্ড ব্র্যানসন বলেন, “আমি পৃথিবীর যে প্রান্তেই থাকি না কেন আমি সবসময় নিয়ম মেনে ভোর ৫ টায় উঠার চেষ্টা করি। সকালে উঠার জন্য আমি ব্যায়াম করার সময় পাই এবং পরবর্তীতে পরিবারের সাথে কিছু সময় কাটাতে পারি। এতে আমার মন এবং মস্তিষ্ক উভয়ই খুব ফুরফুরে থাকে যা আমাকে ব্যবসায় মনোযোগী হতে সাহায্য করে।”
ব্র্যানসনের সাথে এমন আরো অনেক সফল তারকা ব্যক্তিত্ব রয়েছেন যারা কিনা সকালে উঠেন সবসময়। এর মাঝে রয়েছেন এপল কোম্পানীর সিইও টিম কুক (ভোর ৪ টায় ঘুম থেকে উঠেন), টুইটারের সিইও জ্যাক ডরসি( ভোর ৫টায় উঠেন), স্টারবাকসের এক্সিকিউটিভ চেয়ারম্যান হাওয়ার্ড স্কাল্টয, যিনি কিনা ভোর ৪ঃ৩০ বাজে ঘুম থেকে উঠেন প্রতিদিন।
জরিপে দেখা গিয়েছে, প্রায় সকল সফল ব্যক্তিত্ব কাজে যাওয়ার বেশ কিছু সময় আগে ঘুম থেকে উঠেন এবং নিজেকে সময় দেন। এতে তারা সারাদিনের কাজ করার উৎসাহ পান।
২. পরের দিন কী কী কাজ করবেন তা আগের দিন বিকালেই ঠিক করে রাখুন
আপনার প্রতিদিনের কাজ তখনই শেষ হবে যখন আপনি জানবেন যে পরবর্তী দিনে আপনার কী কী কাজ করা প্রয়োজন। দিনের কাজ দিনে শেষ করে পরবর্তী দিনে কী কী কাজ করা প্রয়োজন তা সাথে সাথে নোট করে রাখা উচিৎ যেমনটি Shark Tank এর বিনিয়োগকারী কেভিন ও লেরি করেন।
“আমি ঘুমাতে যাওয়ার আগে সবসময় পরবর্তী দিনে কারোর ফোন কিংবা ইমেইল কিংবা কারো সাথে মিটিং এ বসার আগে কী কী প্রয়োজনীয় কাজ রয়েছে তা লিখে রাখি। এতে সবকাজে সমন্বয় রক্ষা হয়। এই কাজগুলো যেকোন রকমের হতে পারে, যেমন আমার মেয়ের স্কুলে ফোন দিয়ে তার খোঁজখবর জিজ্ঞাসা করা। এই কাজগুলো করলে আপনি সেই দিনের পরবর্তী কাজগুলো খুব ভালোভাবে শেষ করতে পারবেন”।
৩. কাজের তালিকার সবচেয়ে কঠিন কাজটি সবার আগে করুন
বিখ্যাৎ লেখক মার্ক তাঈন বলেন, “Eat a live frog first thing in the morning and nothing worse will happen to you the rest of the day.” এই উক্তি দ্বারা তিনি বুঝাতে চেয়েছেন যে নিজের কাজের তালিকায় সবচেয়ে কঠিন যেই কাজটি যা আপনি করতে চান না, সেই কাজটি আগে করুন।
Lifehacker.com এর প্রতিষ্ঠাতা গিনা ত্রাপাঠির মতে, ” আপনি যখন সকালে কাজ করতে বসবেন তখন আপনার মন এবং মস্তিষ্ক একদম ফ্রেশ থাকবে, আপনাকে অন্যান্য আরো দশটা কাজ নিয়ে ভাবতে হবে না। তাই এই সময়ই সবচেয়ে উপযুক্ত নিজের কঠিন কাজ করার জন্য। এর মাধ্যমে আপনার সবচেয়ে কঠিন কাজ সকাল ১০টার মাঝেই শেষ হয়ে যাবে, পরবর্তীতে বাকি কাজ করতে অনেক সহজ হবে।”
৪. ঠান্ডা পানি পান করুন
পুষ্টিবিদ এবং The One One One Diet এর লেখক রায়ান বাতায়ানেহ বলেন, “আপনি যখন ঘুম থেকে উঠবেন তখন অনেক পানি পান করুন। কারণ আপনি ঘুমের জন্য অনেকটা সময়য় পানি পান করা থেকে বিরত ছিলেন। তাই উঠে পানি পান করুন। পানি পান করলে আপনার দেহের সকল কার্যক্রম সঠিকভাবে হবে।”
৫. মোবাইল ফোন হাতের নাগালের বাইরে রাখুন
জরিপে দেখা গিয়েছে, দিনের সবচেয়ে বেশী সময়য় নষ্ট হয় মোবাইল ফোনের জন্য। বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়ার জন্য এমনটা হয়ে থাকে। ঘনঘন ফোনের নোটিফিকেশন দেখার অভ্যাস আপনার কাজে মন বসানোর ক্ষমতা ধীরে ধীরে নষ্ট করে দেয়। আপনার সময় যাতে নষ্ট না হয় সেজন্য মোবাইল ফোন লকারে রাখতে পারেন, অবসর সময়ে ব্যবহার করতে পারবেন এমন ভাবে ব্যবস্থা করবেন। এতে করে কাজের সময় মনোযোগ বিঘ্নিত হবে না।
৬. আলো জ্বেলে রাখুন
এমন অনেক সময় হয় যে, সকালে ঘুম থেকে উঠতে চাচ্ছেন কিন্তু বাহিরে এখনও কোন আলো নেই। তখন রুমের আলো জ্বেলে রাখুন, ঘুম দৌড়ে পালাবে। এটি প্রাকৃতিক ব্যাপার যে, আপনি যখন আলো জ্বেলে রাখবেন কিংবা আলো দেখবেন তখন আপনার মস্তিষ্কে নিজে থেকেই বার্তা চলে যাবে যে সকাল হয়ে গিয়েছে কিংবা ঘুম থেকে উঠার সময় হয়ে গিয়েছে।
মার্থা জেফারসন হাসপাতালের ডা ক্রিস্টোফার উইন্টার বলেন, “ধরুন আপনি যখন সকালে ঘুম থেকে উঠতে চাচ্ছেন তখন বাহিরে অন্ধকার, সেক্ষেত্রে আপনি আপনার মস্তিষ্ককে বোকা বানাতে পারেন। আলো জ্বেলে রেখে এই বোকা বানানোর কাজটি করতে পারেন।”
৭. ব্যায়াম করুন
সকালে প্রত্যহ ঘুম থেকে উঠেই প্রথম যেই কাজটি করা উচিৎ তা হলো ব্যায়াম করা। আপনার শরীর যদি সুস্থ থাকে তবে সকল কাজে মন বসবে। ৬৭ বছর বয়সী ব্র্যানসন একজন সাইক্লিস্ট এবং প্রত্যহ দৌড়ান। তিনি বলেন, “আমি আমার বয়সের তুলনায় দ্বিগুণ কাজ করতে পারি আর এর পুরো কৃতিত্ব আমার ব্যায়াম করার। প্রত্যহ ব্যায়াম করলে মস্তিষ্ক সুস্থ থাকে।”
৮. স্বাস্থ্যসম্মত নাস্তা করুন
সকালের নাস্তার উপর অনেকগুলো ব্যাপার নির্ভর করবে। আপনি যদি সকালে স্বাস্থ্যসম্মত খাবার গ্রহণ না করেন তবে সারাদিনের কাজের জন্য শক্তি আপনি পাবেন না।
প্রতিদিন সকালের খাবারের তালিকায় প্রচুর পরিমাণে পানি এবং ফল থাকা উচিৎ। এবং খাবারের তালিকায় আমিষ এবং শর্করার সমন্বয় প্রয়োজন।
৯. ধ্যান করুন
অপরাহ উইনফ্রে এবং আরিয়ানা হাফিংটন এর প্রতিদিন সকালের রুটিন হলো ধ্যান করা। এই ধ্যান করার তালিকায় শুধু যে এই দুইজন রয়েছে তা কিন্তু নয়, আরো অনেক ব্যক্তিত্ব রয়েছেন। ধ্যান করলে আপনার মস্তিষ্ক শান্ত থাকে, আপনার ধৈর্য বাড়ায়। যে কোন কাজ করতে পারবেন ঠান্ডা মাথায় আপনি।
১০. পর্যাপ্ত পরিমাণ ঘুম
সারাদিন কাজ করার জন্য প্রয়োজন শক্তি, আর এজন্য সবচেয়ে বেশী প্রয়োজন হলো পর্যাপ্ত পরিমাণ ঘুম। একজন ব্যক্তির প্রত্যহ সাত থেকে নয় ঘন্টার ঘুম প্রয়োজন। সঠিক সময়ে যাতে ঘুমাতে পারেন সেজন্য ঘুমাতে যাবার ৪-৫ ঘন্টা আগে কোন প্রকার কফি বা চা পান থেকে বিরত থাকুন। রুমের মাঝে শান্ত পরিবেশ তৈরী করুন। দেখবেন সঠিক সময়েই ঘুমাতে পারবেন।
১১. সঠিক সিদ্ধান্ত নিন
দিনের কখন কোন কাজ করবেন, কোন কাজ করা ঠিক হবে আর কোণ কাজ করা ঠিক হবে না তা ঠিক করুন। সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে। ভুল সিদ্ধান্ত নিলে পুরো দিনটিই নষ্ট হয়ে যেতে পারে। আপনার সারাদিনে অনেক কাজ করতে হবে, এর মাঝে আপনি সকালে কি পড়বেন এসব ব্যাপারে সময় নষ্ট না করাই ভালো। ফেসবুকের প্রতিষ্ঠাতা মার্ক জুকারবার্গ এক্ষেত্রে উদাহরণ, তিনি প্রায় সবসময় একই রকম পোশাক পরিধান করেন, তার ধূসর রঙ এর টি-শার্ট আর হুডি প্রতিদিনের সঙ্গী। তাই কোন বিষয়ে কতটুকু সময় দিবেন সেক্ষেত্রে সঠিক সিদ্ধান্ত নিন।
১২. কৃতজ্ঞ থাকুন
সবসময় জীবনের প্রতি কৃতজ্ঞ থাকুন। লাইফ কোচ এবং লেখক টনি রবিনস দৈনিক সকালের একটি সময়য় রয়েছে যখন তিনি তার জীবনের জন্য কৃতজ্ঞতা স্বীকার করে। তিনি বলেন, “আমি প্রতিদিন সাড়ে তিন মিনিট ধরে তিনটি বিষয়ের প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করি। প্রতিদিন সকালের এই নিয়ম আপনাকে সবসময় পজিটিভ চিন্তা করতে সহায়তা করবে।এমনকি আপনার রাগ এবং ভয়ও এই নিয়মের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রনে চলে আসবে।
১৩. পড়ুন
সফলতার সাথে সবচেয়ে বেশী যে ব্যাপারটি জড়িয়ে রয়েছে তা হলো পড়া। সবকিছু থেকে আপনি শিক্ষা নিতে পারেন। আর সেই শিক্ষাগুলো কখনোই বৃথা যাবে না। পত্রিকা পড়লে পুরো পৃথিবীর খবর জানতে পারবেন, বই পড়লে আপনার জ্ঞান বৃদ্ধি পাবে। তাই সবসময় পড়া উচিৎ।
১৪. পরিবারকে সময় দিন
আপনার জীবনে আপনি যাই করছেন তা নিজের এবং নিজের পরিবারের জন্য। দিনের শুরুতে পরিবারকে সময় দিন, পরিবারের বিভিন্ন সমস্যার কথাগুলো শুনুন, সমাধানের চেষ্টা করুন। পরিবারের সবার সাথে সময়য় কাটালে সারাদিনে কাজে মনোযোগ দিতে পারবেন।