“মানুষটা একটা সাইকোপ্যাথ”- বেশ প্রচলিত একটি বাক্য। কি এই সাইকোপ্যাথি বা কারা সাইকোপ্যাথ। কতটুকু জানি আমরা এ সম্পর্কে? সাইকোপ্যাথি বা সাইকোপ্যাথ কী?
সাইকোপ্যাথি হচ্ছে মনোবিজ্ঞানের জনপ্রিয় একটা রোগের নাম। সাইকোপ্যাথি হলো একটি মানসিক অসুস্থতা বা পার্সোনালিটি ডিজঅর্ডার যা বিভিন্ন চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য শনাক্ত করলেই বোঝা সম্ভব। এই রোগের রোগীদের সাইকোপ্যাথ বলা হয়ে থাকে। সাইকোপ্যাথ নারী-পুরুষ উভয়ই হতে পারে। আমরা হুটহাট ছোটখাটো কিছু কর্মকান্ডেই একজন মানুষকে সাইকোপ্যাথ বলে আখ্যায়িত করি।
এই সাইকোপ্যাথ যদি আমাদের কর্মক্ষেত্রে সহকর্মী রূপে চলে আসে, তবে বলা যায় কর্মজীবনে বেশ বেগ পেতে হবে। কর্মক্ষেত্রে সহকর্মীদের মধ্যে অনেক সাইকোপ্যাথ লুকিয়ে থাকে। এ ধরণের ব্যক্তিদের এড়িয়ে চলাই উত্তম। কিন্তু সাইকোপ্যাথদের এড়িয়ে চলতে গেলে, প্রথমত তাদের সনাক্ত করতে হবে। নিম্নের ১৫ টি উপায়েই আপনার সহকর্মী সাইকোপ্যাথ কিনা তা সনাক্ত করতে পারবেন। তবে জেনে নেওয়া যাক একজন সাইকোপ্যাথ সনাক্তকরণের ১৫ টি লক্ষণ।
১. ধ্বংসাত্মক মনোভাব
সাধারণত একজন কর্মীর কাছে তার বস হচ্ছেন ‘সাইকোপ্যাথ’। কারণ তিনি যথেষ্ট রুঢ় এবং কঠোর। তার মধ্যে রয়েছে ভুল ধরিয়ে দেওয়ার প্রবণতা। কিন্তু একজন সাইকোপ্যাথ সহকর্মী বা বস কখনো আপনাকে ভুল পথে যেতে বাঁধা দিবেন না বরং উৎসাহিত করবেন। তাছাড়া সাইকোপ্যাথ ব্যক্তির জন্য সম্মান বা গৌরব প্রয়োজনীয় নয়। সে চায় শাসন করতে। সে ভয় ভীতির মাধ্যমে কাজ হাসিল করিয়ে নেওয়াতে বিশ্বাসী। সে সবসময় চাইবে তাকে সবাই সম্মান নয় ভয় করুক।
সাইকোপ্যাথের বিষয়ে, কানাডার দুটি বৃহৎ সংস্থার জ্যেষ্ঠ নির্বাহী এবং The Bully’s Strap এর লেখক এন্ড্রু ফ্যাস বলেছেন,
“আমি হাজার হাজার লোকের হয়ে নেতৃত্ব দিয়েছি, পরিচালনা করেছি হাজারো কার্যক্রম। আমি স্থায়ী ছিলাম কেননা আমি শ্রদ্ধাকে আপন করে নিয়েছিলাম, আমি এর মাধ্যমেই মানুষকে কাজে অনুপ্রাণিত করতে চেয়েছিলাম কারণ আমি চাই মানুষ উন্নতি করুক।”
২. মনোমুগ্ধকর ব্যক্তিত্বের অধিকারী
সাইকোপ্যাথেরা সবচেয়ে ভাল উপস্থাপক। যে কিনা আলাপে বেশ পটু আর গল্পের আসরে যার ভাণ্ডারে থাকে অফুরন্ত গল্প যা আসর জমানোর জন্য একাই যথেষ্ট।
মনোবিজ্ঞানী Robert D. Hare তার ‘Psychology Today’র একটি আর্টিকেলে বলেছেন, একজন সাইকোপ্যাথ হচ্ছেন সদালাপী ব্যক্তি, যার কাছে থাকে অসম্ভাব্য কিন্তু বিশ্বাসী কিছু গল্প যা তাকে সকলের কাছে পরিচিত ও আকর্ষণীয় গল্পকার করে গড়ে তোলে। তিনি তার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে আরো বলেছেন, একবার এক পুরুষ কয়েদীর সাক্ষাৎকার নিতে গেলে কয়েদী তাকে তার রূপের প্রশংসা করে বসেন। সাক্ষাৎকারের শেষ দিকে Hare অস্বাভাবিক ভাবে বেশ চমৎকার অনুভব করছিলেন। কিন্তু পরবর্তীতে Hare কয়েদীর মনোমুগ্ধকর ব্যক্তিত্বের প্রতি দুর্বলতাকে বোকামি বলেই আখ্যায়িত করেন।
৩. আত্মমূল্যায়ন
একজন সাইকোপ্যাথের কাছে তার একমাত্র প্রতিযোগী সে নিজে। নিজেকে সে এতটাই গুরুত্বপূর্ণ মনে করে যেন বাকি মানুষ সবাই তার খেলার পুতুল সমতুল্য। সে নিজেকেই এই মহাবিশ্বের মূল আকর্ষণ বলে মনে করে বলে জানিয়েছেন Hare.
৪. আত্মবিশ্বাস হলো হাতিয়ার
আমরা সাধারণ মানুষেরা খুব সহজেই আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলি। কোনো বাক বিতন্ডায় পরাজয় স্বীকার করে ফেলি সহজেই। Dr. Willium Hirstein তার Psychology Today তে বলেছেন, একজন সাইকোপ্যাথ চেনার সবচেয়ে কার্যকর উপায় হলো তাদের মাত্রাতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস। হেরে যাওয়া যেকোনো বিতর্কেও অবিশ্বাস্য ভাবে নিজেকে উপস্থাপন করে জিতে আসবে এরা। তাই মনে রাখতে হবে একজন সাইকোপ্যাথ সহকর্মী সর্বদা নিজের কৃতিত্ব প্রমাণ করতে চাইবে।
৫. একজন মিথ্যাবাদী
মিথ্যা বলা সাইকোপ্যাথদের জন্য অত্যন্ত সহজ ব্যাপার। শুধু তাই নয়, তাদের মিথ্যা হয় অত্যন্ত গোছানো এবং তথ্যবহুল। মিথ্যা শুরু করলে তারা থামে না বা থামতে আগ্রহী নয়। তাদের মিথ্যা প্রমাণ হওয়ার বা মিথ্যুক হিসেবে ধরা পড়ে যাওয়ার কোনো ভয় তাদের থাকে না। কেননা সেই পরিস্থিতিতে কিভাবে আত্মবিশ্বাসের সাথে মিথ্যা বলে সামাল দিতে হবে, একজন সাইকোপ্যাথের তা জানা আছে।
৬. নিয়মের নেই কোনো পরোয়া
যে সহকর্মী কোনো নিয়মকে পরোয়া না করেই তার কার্যক্রম চালাতে থাকে, বুঝতে হবে তার মধ্যে মানসিক অসুস্থতা বিদ্যমান। মনোবিজ্ঞানী Amy Morin বলেছেন, একজন সাইকোপ্যাথ এতটাই নির্মম হৃদয়ের অধিকারী ও আত্মকেন্দ্রিক যে, যেকোনো পরিস্থিতিকে তার ভয়ানক আচরণ দিয়েই সামাল দেওয়ার ক্ষমতা রাখে বলে সে বিশ্বাস করে।
৭. পরজীবীর ন্যায় জীবনধারা
পরজীবী যেমন নিজের জীবিকার জন্য কেবল বাহকের দেহ থেকে গ্রহণ করতে থাকে, ঠিক একইভাবে একজন সাইকোপ্যাথ নিজের জীবনে উন্নতির লক্ষ্যে যেকোনো কিছু গ্রহণে আগ্রহী। তারা এতটাই আত্মকেন্দ্রিক এবং নিজের প্রতি তাদের ভালবাসা এতই তীব্র যে, কারো অপকার করতে গিয়েও তাদের অনুশোচনা বোধ হয় না। তারা মনে করেন – তাদের জীবন তাদের মত চলবে এবং কোনোরূপ পরামর্শে তারা আগ্রহী নন। তাদের ধারণা জীবনের নিয়মিত নিয়মগুলো অনুসরণ করতে তারা বাধ্য নয়।
৮. তারা হন ধূর্ত
একজন সাইকোপ্যাথের সবচেয়ে বড় শক্তি হলো, তারা হলো সুকৌশলী, ছলনাকারী ও পরিবর্তনশীল। এই তিনটির প্রভাবে তারা সর্বদা প্রথম স্থান দখল করতে পারেন। যে ব্যক্তি খুব সহজেই যেকোনো নির্ভুল কাজের কৃতিত্ব নিয়ে নেন কিন্তু তার ভুলের দায়ভার নিতে আগ্রহী নন বরং অন্যের ঘাড়ে চাপিয়ে দেন, তিনিই হলেন সাইকোপ্যাথ।
৯. অসুন্দর শৈশব
কথায় আছে, Rome wasn’t built in a day. অর্থাৎ একদিনেই রোম শহর তৈরী হয় নি। একজন সাইকোপ্যাথও একদিনেই সাইকোপ্যাথ হন নি। একজন মানসিক অসুস্থ রোগীর ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায় তাদের শিশুকাল ছিলো বেশ জটিল প্রকৃতির। স্বাভাবিক ভাবে তারা বেড়ে ওঠে নি। শিশুকাল থেকেই বিভিন্ন অভ্যাস যেমন- মিথ্যা বলা, চুরি করা, প্রতারণা করা ইত্যাদি তাদের বড় হয়ে একজন প্রকৃত মানসিক রোগী হওয়ার ক্ষেত্রে বেশ প্রভাব ফেলেছে।
১০. আবেগের অভাব
সাধারণের মত সাইকোপ্যাথদের আবেগ থাকে না। শুধুমাত্র লোক দেখানো আবেগে তারা পারদর্শী। আর অনুভূতির ক্ষেত্রে তারা নিজের দিক বাদে অন্য কোনো ব্যক্তির প্রতি তেমন কোনো আবেগ অনুভব করেন না।
১১. দীর্ঘমেয়াদী লক্ষ্যে অবিশ্বাসী
সাইকোপ্যাথ যতই চেষ্টা করুক বা ধূর্ততার সাথে চলুক, লক্ষ্য অর্জনের তাদের বেশ বেগ পেতে হয়। কারণ তারা পরিকল্পনায় পারদর্শী নন। শুধুমাত্র সাময়িক চিন্তা করেই তারা পথ চলতে শুরু করেন। দীর্ঘমেয়াদী চিন্তা করাতে তাদের বেশ অনাগ্রহ।
১২. অনুশোচনার অভাব
অনুশোচনার কোনো স্থান নেই একজন সাইকোপ্যাথের জীবনে। তার যেকোনো কর্মকান্ড যদি কারো ক্ষতি করে, সে বিভিন্ন যুক্তি তর্কের মাধ্যমে নিজের স্থান সুন্দরভাবে উপস্থাপন করতে পারে। নিজের পরিবার পরিজন বা বন্ধু-বান্ধবের সংখ্যা কম হলেও, যারা রয়েছে তাদেরকে দুঃখ দিয়ে নিজের কাজ হাসিল করতেও একজন সাইকোপ্যাথ অনুশোচনা বোধ করে না।
Robert D. Hare তার আরেকজন কয়েদীর সাক্ষাৎকারের কথা বলেছেন, যেখানে কয়েদী, একজনকে ছুরিকাঘাত করে জেলে আছে। তাকে এই বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে সে উত্তরে বলে,”কয়েক মাস হাসপাতালে থেকেই তার মুক্তি আর আমি পচে মরছি এখানে।”
কয়েদী তখনো নিজের কর্মকান্ডে অনুশোচনা বোধ না করে আহতের হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাওয়া নিয়ে দুঃখ করছিল।
১৩.বদমেজাজী
বদমেজাজী মানুষের সংখ্যা আমাদের চারপাশটায় কিন্তু কম নয়। কিন্তু খোশমেজাজ থেকে খুব দ্রুত বদমেজাজে চলে যাওয়া মানুষের সংখ্যা হাতে গোনা। একজন সাইকোপ্যাথ সহকর্মী যেমন তার উপস্থিত বুদ্ধি দিয়ে মন জয় করে নিবে, ঠিক একই ভাবে খুব সহজে সামান্য বিষয়েই মেজাজ বিগড়ে যাবে তার।
১৪. প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হতে চান না
স্বাভাবিক ভাবেই প্রতারক ও ধূর্ত প্রকৃতির মানুষ কখনোই প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হতে চান না। এটা হতে পারে তার ভালবাসার সম্পর্কের ক্ষেত্রে। যদি আপনার কোনো সহকর্মী তার ‘প্রেম’ নিয়ে বেশ বিরক্ত থাকেন তবে কিন্তু সরাসরই তাকে সাইকোপ্যাথ আখ্যায়িত করা যায় না। প্রতিজ্ঞাবদ্ধতায় ভীতি বাকি লক্ষণগুলোর পাশাপাশি থাকতে পারে।
১৫. কাজের প্রতি বিরক্ত প্রকাশ
আপনার সহকর্মী যদি ক্রমাগত কাজের ব্যাপারে বিরক্ত প্রকাশ করে, তবে হতে পারে আপনার কর্মক্ষেত্র বেশ একঘেয়ে কিংবা আপনার সহকর্মী ভীষণ একঘেয়ে।
কিন্তু উপরিউক্ত সকল লক্ষণের উপস্থিতির সাথে যদি সহকর্মীর মধ্যে কাজের প্রতি অনুৎসাহের ভাব প্রকাশ পায়, তবে তাকে সাইকোপ্যাথ হিসেবে আখ্যায়িত করাই যায়।
উপরিউক্ত লক্ষণগুলো একজন সাইকোপ্যাথের প্রকাশক। কিন্তু নির্ভুল ভাবে একজন মনোবিজ্ঞানীই কেবল এই রোগ নির্ণয় করতে পারেন।