শত কোটি মানুষ লক্ষ লক্ষ বছর ধরে পৃথিবীতে বাস করে গেলেও গুটি কয়েক মানুষ বদলে দিয়েছেন মানব সভ্যতার গল্প। লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি, নিউটন, গ্যালিলিও, জেমস কুক, আইনস্টাইন সহ হাজারো মহামানবদের চেষ্টা, চিন্তা এবং পরিশ্রমের ফল আমাদের আধুনিক পৃথিবী এবং সমাজ। তবে এদের কাতারে আরেক মহামানবের নাম না বললেই নয়, তিনি হলেন বিখ্যাত উদ্ভাবক নিকোলা টেসলা। নিকোলা টেসলাকে বলা হয় আধুনিক সময়ের ‘দ্য ভিঞ্চি’।
একাধারে বিজ্ঞানী, উদ্ভাবক, ভবিষ্যৎ দ্রষ্টা এবং পদার্থবিদ, ইঞ্জিনিয়ার – নিকোলা টেসলা। জীবিতাবস্থায় মোটামোটি তারকা বনে গেলেও উদ্ভাবক হিসাবে প্রাপ্য সম্মান তিনি পাননি। বর্তমান আধুনিক প্রযুক্তি কোনো না কোনো ভাবে তার চিন্তাপ্রসূত। তিনি সবচেয়ে বেশি সমাদৃত এসি কারেন্টের (Alternating Current) ইন্ডাকশন মোটরের জনক ও আধুনিক বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থার নকশায় তার অবদানের জন্য। আজ অখ্যাত কিন্তু সেরা এই মহামানবকে নিয়ে আমাদের আয়োজন।
আলোর সন্তান
এই মহামানবের জন্ম ১০ জুলাই ১৮৫৬ সালে তৎকালীন সার্বিয়ায় (বর্তমান ক্রোয়েশিয়ায়) স্মিলিজান শহরে। পিতা মিলুতিন টেসলা একজন ধর্মযাজক এবং মা ডুকা টেসলা ছিলেন একজন উদ্ভাবক। নিকোলা টেসলার মায়ের বেশ নাম ডাক ছিল বিভিন্ন ঘরোয়া যন্ত্রপাতি এবং মেশিন তৈরির জন্য। বলা হয় নিকোলা টেসলা যখন পৃথিবীতে আসেন সেদিন নাকি প্রচন্ড বজ্র সহ ঝড় হচ্ছিল। দাই বলেছিলেন, এই ছেলে অন্ধকার নিয়ে এলো কিন্তু নিকোলা টেসলার মা বলেছিলেন- আমার এই সন্তান পৃথিবীতে আলো নিয়ে আসবে। মায়ের কথা তিনি সত্য প্রমাণ করে সারা বিশ্বকে দেখিয়েছিলেন। তার আবিষ্কার দিয়েই সারা পৃথিবী এখন আলোকিত।
ছোটবেলা থেকেই টেসলা ছিলেন প্রচন্ড মেধাবী। তিনি মাথার ভেতরে ক্যালকুলাস করে ফেলতে পারতেন বলে স্কুলে শিক্ষকরা ধরেই নিয়েছিলেন যে, তিনি হয়তো পরীক্ষায় নকল করছেন! কিন্তু আদতে জন্মসূত্রে তিনি পেয়েছিলেন অসাধারণ বুদ্ধিমত্তা। তার ছিল ফটোগ্রাফিক মেমোরি, এই ক্ষমতা দিয়ে তিনি বই মুখস্ত করে ফেলতেন অনায়াসে। এছাড়া মাথার ভেতরে ক্যালকুলাস ছাড়াও তিনি মাথার মাঝে যে কোনো গঠন বা স্ট্রাকচার কল্পনা করতে পারতেন। এজন্যই হয়তো তার গবেষণা পত্রে ছবি পাওয়া যায়নি তেমন।
বাস্তবতা দেখার গল্প
নিকোলা টেসলা সব সময় ছিলেন কর্মঠ এবং একগুঁয়ে। কলেজ জীবন শুরু করেন অস্ট্রিয়া পলিটেকনিক এ। প্রথম বছর তিনি ছিলেন সেরা ছাত্র, এমনকি কলেজের ডিন তার বাবাকে চিঠিতে অভিবাদন জানান। কিন্তু দ্বিতীয় বর্ষে গিয়ে গোল বাঁধান প্রফেসরের সাথে আর তৃতীয় বর্ষে মজেন জুয়ার আসরে। ফলাফল ৩য় বর্ষে গিয়ে ড্রপ আউট। কর্মঠ ও প্রতিভাবান এই মানুষটির জন্য কলেজ ছেড়ে দেওয়া সমস্যা হয়নি কোনো।
পড়াশোনা এক পাশে রেখে মন দিয়েছিলেন চাকরিতে। ১৮৮১ সালে বুদাপেস্ট টেলিফোন এক্সচেঞ্জে চাকরি নেন টেসলা। টেসলা সেখানে তার মেধা এবং চেষ্টার মাধ্যমে পুরো কোম্পানির মেশিনাদি ঠিক করা ছাড়াও আমূল পরিবর্তন এনে দেন। টেলিফোন এক্সচেঞ্জে কাজ করার সময় টেসলা আরেক উদ্ভাবক তিভাদার পুস্কাসের সাথে কাজ করা শুরু করেন। ১৮৮২ সালে তিভাদারের সহায়তায় নিকোলা টেসলা প্যারিসে পাড়ি জমান আরেক বিখ্যাত উদ্ভাবকের কোম্পানিতে কাজ করার জন্য। ধারণা করতে পারছেন কে? হ্যাঁ, তখনকার বিশ্বের সেরা ইঞ্জিনিয়ার এবং ব্যবসায়ী এবং উদ্যোক্তা টমাস আলভা এডিসনের প্যারিস শাখার অফিসে আসেন টেসলা। সেখানে তার সেরা কাজ দিয়ে চলে যান জার্মানিতে। এবার গল্পের অন্য দিক।
চোখে আমেরিকার স্বপ্ন
এবার পালা স্বপ্নের দেশ আমেরিকায় পাড়ি জমানোর! প্যারিসে নিকোলা টেসলার অসামান্য কাজের এবং জ্ঞানের জন্য সহজেই নজরে চলে আসেন উপরের মহলের। এবার ডাক দেন স্বয়ং কোম্পানির প্রেসিডেন্ট টমাস আলভা এডিসন। ১৮৮৪ সালে নিকোলা টেসলা আমেরিকা পাড়ি জমান এডিসনের চিঠি আর ৫০ সেন্ট পকেটে নিয়ে। সেখানে নিকোলা টেসলা কাজ করতে শুরু করেন সরাসরি এডিসনের সাথে থেকে। এডিসন আবিষ্কৃত ডিসি মোটর নিয়ে কাজ করাই ছিল টেসলার মূল কাজ।
ডিসি মোটরের সবচেয়ে বড় অসুবিধা হচ্ছে ডাইরেক্ট কারেন্ট (ডিসি) তৈরি যেমন ব্যয়বহুল তেমনি নিয়ন্ত্রণও বেশ ঝামেলার। ডিসি কারেন্টের বিদ্যুতের জন্য কিছু দূর পর পর স্টেশন তৈরি করার দরকার পড়ে বিদ্যুৎ পরিবহনের জন্য। এডিসন এই সমস্যা সমাধানের দায়িত্ব দেন টেসলার উপর। কাজের বিনিময় হিসাবে এডিসন ৫০ হাজার ডলার পারিশ্রমিক দেবার প্রতিশ্রুতিও দেন নিকোলা টেসলাকে। ৬ মাসের মাথায় টেসলা নিয়ে আসেন তার যুগান্তকারী আবিষ্কার এসি মোটর এবং এসি কারেন্ট প্রযুক্তি। পারিশ্রমিক দেবার পরিবর্তে এডিসন তাকে বলেছিলেন, “তুমি আমেরিকান ব্যঙ্গ ধরতে পারোনি টেসলা!” ১০ ডলার থেকে ১৮ ডলার অর্থাৎ মাত্র ৮ ডলার বেতন বাড়াতে রাজী হন এডিসন। রাগে অপমানে চাকরি ছাড়েন টেসলা।
এবার পৃথিবী বদলানোর পালা
এডিসনের চাকরি ছেড়ে জেদের বশে ১৮৮৫ সালে শুরু করলেন তার নিজের কোম্পানি “টেসলা ইলেকট্রিক লাইট এন্ড ম্যানুফ্যাকচারিং”। প্রথমে উদ্যোক্তারা সাহস পায়নি নতুন জায়গায় কাজ করতে; ফলাফল সর্বহারা হলেন। এ সময় তিনি বিভিন্ন ইলেকট্রিকাল কোম্পানিতে ২ ডলার বেতনে রিপেয়ারম্যানের চাকরি শুরু করেন! অবশেষে ১৮৮৬ সালে আলফ্রেড এস ব্রাউনের সহায়তায় ওয়েস্টার্ন ইউনিয়ন কোম্পানির সহায়তায় নতুন করে কাজ শুরু করেন।
যুক্তরাষ্ট্রের ম্যানহ্যাটন শহরে টেসলা গড়ে তোলেন তার নিজের ল্যাবরেটরি। সেখান থেকেই ১৮৮৭ সালে নিজের ডিজাইন করা ইন্ডাকশন মোটর তৈরি করেন। আর এই ইন্ডাকশন মোটরের মাধ্যমে ইউরোপের চেহারা বদলে যায়। এই ইন্ডাকশন মোটর দিয়ে টেসলা আকাশের নীল বজ্রকে নিয়ে আসেন ঘরে ঘরে এসি কারেন্ট রূপে। ১৮৯৫ সালে ডিন এডমিন্সের সহায়তায় নিকোলা টেসলা কোম্পানি নতুন করে গড়ে তোলা হয়।
এসি কারেন্টের সবচেয়ে বড় সুবিধা এটি সহজলভ্য, সহজে বহনযোগ্য এবং সস্তা। শুরু হয় নিকোলা টেসলা এবং থমাস এডিসনের স্নায়ু যুদ্ধ। অনেকে একে বলেন “বিদ্যুতের যুদ্ধ”। থমাস এডিসন নানারকম কুৎসা রটাতে শুরু করেন টেসলার বিপক্ষে। এমনকি লোকজনকে মিডিয়ার মাধ্যমে ভুল সংবাদ প্রচার করতেও দ্বিধা করেননি এডিসন! নিকোলা টেসলার এসি কারেন্ট শুধু যুক্তরাষ্ট্রে আটকে থাকেনি বরং ছড়িয়ে পড়েছে সারা পৃথিবীতে। বলা হয় আধুনিক মানব সভ্যতা দাঁড়িয়ে আছে টেসলার কাজের উপর!
এবার শুধু কাজ আর কাজ
নিকোলা টেসলা ছিলেন কাজ পাগল এক মানুষ। তিনি ২৪ ঘণ্টায় মাত্র ৩ ঘণ্টা ঘুমাতেন বাকি সময় কাজ। এসি মটর থেকে প্রাপ্ত অর্থে তৈরি করেন নিজের গবেষণাগার। সেখানে বসে তিনি ১৮৮৯ সালে তৈরি করেন তার আরেক যুগান্তকারী আবিষ্কার ‘টেসলা কয়েল”। এই কয়েল দেখে অনেকে তাকে পাগল বিজ্ঞানী বলতো, এমনকি আধুনিক বেশ কিছু এনিমেটেড কার্টুনের জন্য টেসলা ‘ম্যাড সায়েনন্টিস্ট’ উপাধি পান! চলুন পাঠক, এবার দেখে নিই তার আবিষ্কারগুলো কী কী।
রেডিও এবং রিমোট কন্ট্রোল
আমাদের ঘরের টিভি থেকে শুরু করে খেলনা গাড়ি, ড্রোন সহ বিভিন্ন কাজে রিমোট কন্ট্রোল আমাদের ঘরের আসবারের অংশ এখন। সাধারণ জ্ঞানের বইয়ে আমরা পড়েছি রেডিওর আবিষ্কারক মার্কনি। আসলে পেছনের গল্প ভিন্ন। ১৮৯২ সালে নিকোলা টেসলা সর্বপ্রথম রেডিওর ধারণা আনেন এবং এ নিয়ে কাজ করেন। ১৮৯৮ সালে ম্যানহ্যাটন শহরের ম্যাডিসন স্কয়ারের ঝর্ণায় সর্বপ্রথম রেডিও নিয়ন্ত্রিত খেলনা জাহাজ চালিয়ে লোকজনকে অবাক করে দেন। এরপর বড় মাপের রেডিও ট্রান্সমিশন তৈরি শুরু করেন নিকোলা টেসলা তার গবেষণাগারে কিন্তু আগুনে পুড়ে নষ্ট হয়ে যায় যন্ত্রপাতি। আর এই মূল ধারণা থেকেই মার্কনী বনে যান রেডিওর আবিষ্কারক!
ওয়াই-ফাই
আমাদের জীবনে ইন্টারনেট আর ওয়াই-ফাই এখন এক ছন্দ। এক মুহুর্ত এই ছন্দপতন আমরা মানতে পারি না। জানেন কি, এই ওয়াই-ফাই প্রযুক্তি ধারণা দেন সর্বপ্রথম নিকোলা টেসলা? ১৯০৪ সালে টেসলা লং আইসল্যান্ডে গড়ে তোলেন বিশাল টাওয়ার শুধুমাত্র তারবিহীন সঙ্কেত আদান প্রদানের জন্য। তার মৃত্যুর অনেক বছর পর টেসলার গবেষণার উপর ভিত্তি করে ওয়াই-ফাই তৈরি করা হয়। নিকোলা টেসলার এই অবদানের জন্য সিলিকন ভ্যালিতে তার একটি মূর্তি তৈরি করা রয়েছে যেখান থেকে ফ্রি ওয়াই-ফাই সুবিধা দেওয়া হয়।
ওয়ারলেস লাইটিং
ওয়াই-ফাই ছেড়ে সামনে আসছে লাইফাই প্রযুক্তি। আলোর মাধ্যমে তথ্য আদান প্রদানের এই থিওরি নিয়ে আসেন নিকোলা টেসলা। তিনি চেয়েছিলেন তারবিহীন ভাবে আলো জ্বালাতে।
অন্যান্য আবিষ্কার
কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকা এই মানুষটা সব সময় কাটিয়েছেন গবেষণায়, কল্পনা আর ভাবনা জুড়ে। তথ্য মতে, সারা পৃথিবীতে ২৬টি দেশে ৩০০ এর বেশি পেটেন্ট রয়েছে নিকোলা টেসলার নামে। যেহেতু তিনি ফটোগ্রাফিক মেমোরির অধিকারী ছিলেন তাই তার অনেক কাজ খুঁজে পাওয়া যায়নি কাগজে। নিকোলা টেসলা এক্সরের আধুনিকায়নে সবচেয়ে বেশি অবদান রেখেছেন। যার জন্য এক্সরে এতটা সহজলভ্য আজ।
তার অন্যান্য কাজের মাঝে রয়েছে ব্লেড ব্যাতীত টারবাইন। তার আরেকটি বড় কাজ হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র–কানাডার যৌথ উদ্যোগে তৈরি নায়েগ্রা জলপ্রপাতের উপর বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র নির্মাণে ইঞ্জিনিয়ারিং সহায়তা প্রদান করা এবং তার হাত ধরেই নায়াগ্রা জলপ্রপাত থেকে এসি কারেন্ট ছড়িয়ে পড়ে আমেরিকায়।
ব্যক্তি জীবন
৬ ফুট ২ ইঞ্চি উচ্চতার দীর্ঘাকার মানুষ ছিলেন তিনি। ছিলেন প্রচন্ড গর্বিত, চটপটে ও বুদ্ধিমান মানুষ। তার কাপড় পরিধান, চাল চালন উঠা বসা তাকে নিয়ে গিয়েছিল তখনকার সেলিব্রেটিদের তালিকায়। গবেষণার জন্য বিয়ে করেননি। তার ছিল অদ্ভুত কিছু সমস্যা। যেমন ইনসমনিয়া, শুচিবাই অত্যাধিক গোছানো। শোনা যায়, ভদ্রলোক এক সপ্তাহে টানা ৮৪ ঘণ্টা না ঘুমিয়ে কাজ করেছেন। এছাড়া দিনে তো মাত্র ৩ ঘণ্টার ঘুম তার অভ্যাস। তিনি ৩ সংখ্যাকে খুব ভালোবাসতেন এবং তিনি নাকি আকাশ থেকে তথ্য পেতেন তার গবেষণার জন্য!
জীবনাবসন
৮৬ বছর বয়সে জানুয়ারির ৭, ১৯৪৩ সালে নিউইয়র্ক হোটেলের ৩৩২৭ নিঃসঙ্গ অবস্থায় মারা যান এই সেরা আবিষ্কারক, বিজ্ঞানী। তার মৃত্যু তাকে দিয়েছে শান্তির চিরনিদ্রা আর আমাদের দিয়ে গেছেন সুন্দর ভবিষ্যৎ। তাই তো তাকে সম্মান জানাতে বহু গল্পে, সিনেমায় উঠে আসছেন তিনি আমাদের মাঝে। এই সময়ের সেরা উদ্যোক্তা এলন মাস্ক তার নামানুসারে ইলেকট্রিক গাড়ি কোম্পানির নাম দেন “টেসলা মোটরস”!