আমরা জীবনকে যতটা সহজ মনে করি, জীবন আসলে এতটা সহজ নয়। জীবনে সুখ, স্বাচ্ছন্দ্য ও সন্তুষ্টির সাথে সাথে কখনো কখনো জটিল এবং কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়। এমন জটিল এবং কঠিন পরিস্থিতিতে কখনো কখনো দ্বারস্থ হতে হয় আইনের। জীবনের নানা সমস্যা আইনি প্রক্রিয়ায় সমাধান করে এগোতে হয়। আর এই সমাধান করার জন্য প্রয়োজন হয় একজন অভিজ্ঞ ও বিশ্বস্ত আইনজীবীর।
কিন্তু কিভাবে একজন অভিজ্ঞ ও যথার্থ আইনজীবী খুঁজে বের করা যায়? কোনো মানুষের সাথে সাক্ষাৎ করা বা কোনো বিষয়ে আলোচনা করার মতো একজন দক্ষ ও যোগ্য আইনজীবী খুঁজে বের করা এতটা সহজ নয়। অধিকাংশ মানুষ জানেন না, কিভাবে কোনো আইনি সমস্যায় পড়লে যথার্থ আইনজীবী খুঁজে বের করতে হয়।
আসলে আইনজীবী নিয়োগ দেয়ার প্রক্রিয়া সহজ। কিন্তু যথার্থ আইনজীবী নিয়োগ দিতে আরো অনেক বিষয় ভাবতে হয়, যেসব বিষয় নির্ধারণ করে নিয়োগকৃত আইনজীবী আপনার সমস্যায় যথার্থ আইনি সহযোগিতা করতে সক্ষম কিনা। আপনি যদি সঠিক আইনজীবী নিয়োগ দিতে ব্যর্থ হন, তাহলে প্রচুর টাকা খরচ করবেন, আইনি প্রক্রিয়ায় লড়তে থাকবেন, আর সময় ব্যয় হবে কিন্তু কাঙ্ক্ষিত সমাধান পাবেন না!
এই নিবন্ধে এমন কয়েকটি বিষয় নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব, যা একজন আইনজীবী নিয়োগ দেয়ার পূর্বে আপনাকে বিবেচনা করতে হবে। যদি এসকল বিষয় বিবেচনায় রেখে সঠিক আইনজীবী খুঁজে বের করতে পারেন তাহলে আপনার আইনি লড়াইয়ে সুবিচার পাওয়ার পথ অনেকটা সুগম হবে।
যোগ্যতা
ঠিক যেমন আপনি দাঁতের সমস্যার সমাধান করতে কোনো শিশুরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে যাবেন না। ঠিক একইভাবে নিশ্চয়ই আয়কর সমস্যার সমাধান করতে কোনো পারিবারিক আইনজীবী ভাড়া করবেন না। আপনাকে সঠিক আইনজীবী চিনে নিতে হবে।
উদাহরণস্বরূপ, ধরুন আপনি পারিবারিক সমস্যার সমাধান করতে একজন আইনজীবী নিয়োগ করতে চান। এই নিয়োগের পূর্বে আপনার সমস্যাটি যে পারিবারিক সমস্যার আওতাভুক্ত তা আপনাকে জানতে হবে এবং তার জন্য ঠিক এই ক্ষেত্রে অনুশীলন করা আইনজীবী নিয়োগ দিতে হবে।
অভিজ্ঞতা
আইনজীবী নিয়োগের জন্য আপনার সমস্যার সুনির্দিষ্ট ক্ষেত্র চিহ্নিত করার পর আপনাকে নিশ্চিত করতে হবে আপনি যাকে নিয়োগ করছেন তিনি আপনার সমস্যার যথাযোগ্য সমাধান করতে যথেষ্ট অভিজ্ঞতা সম্পন্ন। যিনি আপনার এই গুরুতর সমস্যাটি সূক্ষ্মভাবে বিশ্লেষণ করে এবং সঠিক পথে এগিয়ে আপনাকে ন্যায় বিচার পাইয়ে দিতে পারেন তাকেই নিয়োগ দিন।
আইন বিশেষজ্ঞ গ্যারি বলেন, কেবলমাত্র একজন অভিজ্ঞ আইনজীবী পারেন কোনো জটিল সমস্যার সমাধান করতে। যেমন কোনো অবিবাহিত তরুণের জীবনে সৃষ্ট কোনো সমস্যা আরেকজন অনভিজ্ঞ, অল্প বয়সী, অবিবাহিত তরুণ আইনজীবী অনেকাংশেই সমাধান করতে পারবেন। কিন্তু এই একই আইনজীবী পারিবারিক সমস্যা, সম্পত্তির ভাগ বাটোয়ারা, এবং জটিল ব্যবসায়িক সমস্যার সমাধান করতে অনেকাংশেই ব্যর্থ হবেন। কেননা এ বিষয়ে তার বাস্তব অভিজ্ঞতা খুবই কম। আবার সুনির্দিষ্ট যে সমস্যাটির কারণে আপনি আইনজীবী ভাড়া করছেন ঠিক একই রকম একাধিক সমস্যা ইতিপূর্বে আপনার ভাড়া করা আইনজীবী সমাধান করেছেন এ অভিজ্ঞতা থাকাও জরুরি। মোটকথা সুনির্দিষ্ট ক্ষেত্রের অভিজ্ঞ আইনজীবীই পারেন আপনার জটিল সমস্যার সঠিক সমাধান করতে।
সম্মানী
একজন আইনজীবী ভাড়া করার পূর্বে তার সম্মানী সম্বন্ধে জানতে চাওয়াটা মোটেও অসম্মানের নয় বা লজ্জা পাওয়ার বিষয় নয়। কেননা আপনি আইনজীবীকে ভাড়া করছেন টাকার বিনিময়ে। সুতরাং টাকার পরিমাণটা নিশ্চিত হয়ে নেওয়া বুদ্ধিমানের কাজ। একজন আইনজীবী বিভিন্নভাবে আপনার সাথে চুক্তি করতে পারেন; ঘন্টা ভিত্তিক তিনি পারিশ্রমিক নিতে পারেন, মামলার ধরন বুঝে নির্দিষ্ট পরিমাণ সম্মানী নিতে পারেন, অথবা কাজ, সময় এবং পরিশ্রমের ভিত্তিতে পর্যায়ক্রমে সম্মানী নির্ধারণ করতে পারেন। যেভাবেই হোক না কেন আপনাকে তা নিশ্চিতভাবে জেনে নিতে হবে।
তবে মোটাদাগে দুইটি বিষয় উল্লেখ্য
- একটি আনুমানিক অথবা নিশ্চিত সম্মানী
- অতিরিক্ত খরচ যেমন ফাইল কেনা, ফটোকপি, কাগজপত্র স্ক্যান, মেইলিং, ভ্রমণ ইত্যাদি খরচ।
সাধারণত আইনজীবীরা মামলার ধরন এবং আপনার অবস্থা বুঝে আলোচনার ভিত্তিতে সম্মানী নির্ধারণ করে থাকেন। এক্ষেত্রে স্বভাবতই বেশি অভিজ্ঞ আইনজীবীরা বেশি সম্মানী নিয়ে থাকে। কেননা তার ক্ষেত্রে সমস্যার যথার্থ সমাধান করার সম্ভাবনা অনেক বেশি থাকে। সুতরাং খরচের বিষয়টি খোলামেলা এবং আন্তরিকভাবে আলোচনা করে নিয়ে সঠিক ও অভিজ্ঞ আইনজীবী নিয়োগ করুন।
বিশ্বস্ততা এবং যোগাযোগ
আইনজীবী নিয়োগের ক্ষেত্রে বিশ্বাসযোগ্যতা একটি বড় নিয়ামক। আপনি যাকে নিয়োগ করতে যাচ্ছেন তাকে আপনি বিশ্বাস করতে পারবেন কিনা এবং তার সাথে কাজ করে নিরাপদ বোধ করবেন কিনা এটি প্রথমে বিবেচনা করা খুবই দরকারী। সুতরাং আইনজীবী নিয়োগের শুরুতেই আপনার চোখে বিশেষজ্ঞ, জ্ঞানী এবং বিশ্বাসযোগ্য কাউকে বেছে নিন।
আপনি যদি আপনার আইনজীবীর বলা কথা এবং পরামর্শের উপর ভরসা করতে না পারেন তবে তা আপনার জন্য খুবই পীড়াদায়ক হবে। কেননা আপনি তাকে টাকা দিবেন এবং আইনি প্রক্রিয়ায় লড়বেন অথচ আত্মতৃপ্তি পাবেন না, মন থেকে সব সময় একটা ভয় শঙ্কা নিয়ে চলবেন, অথবা আপনি নিজ থেকে আপনার সমস্যা যথাযথভাবে তাকে খুলেও বলতে পারবেন না। সব মিলিয়ে আপনার সমস্যাটি সমাধান করা আরো বেশী জটিল হয়ে উঠবে।
আইনজীবীর সঙ্গে আপনার সুসম্পর্ক এবং বিশ্বাসযোগ্যতার পরিবেশ সৃষ্টি করার কিছু কৌশল আছে। তবে অবশ্যই এক্ষেত্রে আপনাকে বিচক্ষণ হতে হবে। আপনার আইনি সমস্যাটি নিয়ে যখন প্রথমবার কোনো আইনজীবীর সাথে কথা বলবেন তখন তার কাজের ধরন বা আপনার প্রাথমিক প্রশ্নে তার অভিব্যক্তি, উত্তর আপনার ভালো লাগে না মন্দ লাগে সেটা প্রথমত বিবেচ্য বিষয়। এখান থেকে আপনার আংশিক সিদ্ধান্ত নিশ্চিত হয়ে যাবে যে, আপনি তাকে ভাড়া করছেন কি করছেন না।
এরপর তার সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বললেই সুনির্দিষ্ট বিষয়গুলোতে তার এবং আপনার দৃষ্টিভঙ্গির মিল অথবা পার্থক্য, আপনার ভাবনা এবং তার কাজের কৌশল, আপনার ধারণায় এই সমস্যাটি সমাধানের সম্ভাব্য সময় এবং আইনজীবীর প্রতিশ্রুতির মধ্যে মিল-অমিল, এসব বিষয়গুলো বিবেচনা করলেই খুব সহজেই আপনি বুঝে যাবেন এই আইনজীবী আপনার সমস্যাটি সমাধানের জন্য যথার্থ কিনা।
উপরিউক্ত বিষয়গুলো প্রাথমিকভাবে বিবেচনায় নিয়ে বিচক্ষণতার সাথে আইনজীবী খুঁজে বের করলে আপনার আইনি সমস্যার কাঙ্ক্ষিত এবং যথাযোগ্য সমাধান পাওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি থাকবে। তবে আইনজীবী নিয়োগের পর অবশ্যই তাকে সম্পূর্ণ সমস্যা খুলে বলতে হবে। ভুলেও আইনজীবীর সাথে তথ্যের লুকোচুরি করবেন না। তাহলে আপনার আইনজীবী আদালতে আপনার পক্ষে লড়তে গিয়ে খেই হারিয়ে ফেলবেন। আমার বিশ্বাস এই পরামর্শগুলো আপনাদের জীবনের সৃষ্টি হওয়া নানান সমস্যায় একজন যোগ্য আইনজীবী খুঁজে পেতে সহায়তা করবে।