ব্যবসায় সফল হতে হলে সব সময় যথাযথ প্রস্তুতি থাকতে হয়। অমনোযোগী কর্মীদল এবং প্রবল প্রতিযোগিতা অনেক সময় উদীয়মান স্টার্টআপ ধ্বংস করে দিতে পারে। তবে গবেষণা বলছে, নগদ অর্থ প্রবাহের সমস্যার কারণে এর চেয়ে বেশি সংখ্যক স্টার্টআপ বন্ধ হয়ে যায়। এক জরিপ মতে, ২৯ শতাংশ ক্ষুদ্র ব্যবসার ব্যর্থতার প্রধান কারণ, নগদ অর্থ প্রবাহের ঘাটতি। ব্যবসা পরিচালনা এবং কর্মীদের নিয়মিত বেতন ভাতা দেওয়ার জন্য পর্যাপ্ত নগদ অর্থ না থাকলে সম্ভাবনাময় পণ্য এবং উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ থাকা সত্ত্বেও যেকোনো স্টার্টআপ বন্ধ হয়ে যেতে পারে।
আবার মূলধন ঠিক রেখে নগদ অর্থ প্রবাহ নিশ্চিত করতে হলে উদ্যোক্তাকে জানতে হবে, কে বা কী তাকে এই ব্যবসায় অনুপ্রাণিত করেছে এবং কীভাবে তিনি আরো বড় দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিতে পারেন।
ওয়েলথকোয়েস্টের প্রেসিডেন্ট এবং ‘লিভিং এ রিচ লাইফ’ বইয়ের লেখক জেমস লিনহপ বলেন,
আপনাকে বিশ্বাস করতে হবে যে, এই পৃথিবীতে আপনিই একমাত্র ব্যক্তি, যে কাজটি করতে পারেন। সুতরাং আপনাকেই সবকিছু করতে হবে। বাস্তবে যদি আপনি নিজের গতিপথ থেকে বেরিয়ে এসে বিভিন্ন কাজ করতে পারেন, তবে নিশ্চয় আপনি অন্যদের উন্নয়নেও কাজ করতে পারবেন।
কেন উদ্যোক্তাদের পিছিয়ে আসতে হয়?
উদ্যোক্তারা মনে করেন, তারা সাধারণ মানুষের চেয়ে ভালো অর্থনৈতিক জ্ঞান রাখেন। কেননা অন্যরা চুপচাপ বসে থাকলেও তারা ইতোমধ্যে ব্যবসা শুরু করেছেন এবং বড় বড় অর্থনৈতিক হিসাব নিকাশ করছেন। কিন্তু এই উপলব্ধিই কি যথেষ্ট?
উদ্যোক্তাদের অবশ্যই অর্থ ব্যবস্থাপনার ব্যাপারে যথেষ্ট জ্ঞান রাখতে হবে। কেননা সাধারণ কর্মীদের যেখানে শুধু নিয়োগকর্তার প্রদত্ত অর্থের ব্যবস্থাপনা নিয়ে চিন্তা করতে হয়, সেখানে একজন উদ্যোক্তাকে সম্পূর্ণ প্রতিষ্ঠান পরিচালনা এবং তার পরিবার ব্যবস্থাপনা নিয়েও চিন্তা করতে হয়। সকল বিপণন পরিকল্পনা, নতুন উদ্যোগ এবং পারিবারিক খরচের হিসাব এক টেবিলে বসে নিষ্পত্তি করতে হয়। সুতরাং ব্যবসা পরিচালনা এবং অর্থ ব্যবস্থাপনার যথাযথ জ্ঞান না থাকলে অচিরেই উদ্যোক্তার ব্যবসা লাগামছাড়া হয়ে পড়ে।
এই পরিণতি এড়ানোর জন্য উদ্যোক্তাদের কিছু মৌলিক নীতি অনুসরণ করতে হয়। নিচে এ বিষয়ে আরো বিস্তারিত আলোচনা করা হল।
১. ক্রেডিট স্কোর সম্বন্ধে সঠিক ধারণা
নতুন ব্যবসা শুরু করার পর নিরাপদ বিনিয়োগ এবং তহবিল সুরক্ষিত রাখার জন্য উদ্যোক্তাদের ভাল ক্রেডিট স্কোর প্রয়োজন হয়। ক্ষুদ্র ব্যবসায় ঋণ নেয়া এবং সময়মতো ঋণ পরিশোধ করা যেকোনো ছোট স্টার্টআপকে বড় করে তুলতে পারে, আবার এর অন্যথা হলে স্টার্টআপ ধ্বংসও হয়ে যেতে পারে। কেননা স্কোর খারাপ হলে যেমন বিনিয়োগ বন্ধ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। আবার যত ভালো স্কোর থাকে, তত বেশি বিনিয়োগ পাওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে।
এক্ষেত্রে ঝুঁকি এড়ানোর জন্য যে নীতি অনুসরণযোগ্য তা হল, একাউন্টে অধিক অর্থ জমা রাখার পরিবর্তে সময়মতো সকল বিল পরিশোধ করতে হবে এবং পুরনো একাউন্টগুলো চালু রাখতে হবে। একাউন্টে অধিক অর্থ জমা রাখলে ভাল ক্রেডিট স্কোর পাওয়া যায়, এই ধারণাটি ভুল। বরং সকল লেনদেন সময়মত সম্পন্ন করে একাউন্ট চালু রাখতে পারলেই ক্রেডিট স্কোর ভালো থাকে।
যাদের ক্রেডিট স্কোর ভালো নয়, তারা চাইলে অনলাইন থেকে ভালো ক্রেডিট স্কোর তৈরি এবং তা বজায় রাখার নির্দেশিকা সংগ্রহ করতে পারেন। এমনকি চাইলে ক্রেডিট স্কোর সম্পর্কিত কোনো প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতাও নিতে পারেন।
২. অপ্রত্যাশিত খরচের প্রস্তুতি
সফল উদ্যোক্তারা খুব দ্রুতই বুঝতে পারেন যে, বিভিন্ন জায়গা থেকে খরচের হিসাব আসা কখনোই বন্ধ হয় না। এমনকি অপ্রত্যাশিতভাবেও কোনো কোনো খরচ সামনে এসে হাজির হয়। যেকোনো কোম্পানি নিশ্চয়ই শ্রমিক খরচ, খুচরা সরবরাহকারী খরচ, বিজ্ঞাপন ব্যয় এবং সরকারি বেসরকারি সকল বিলের হিসাব করেন। কিন্তু বীমা এবং অন্যান্য অপ্রত্যাশিত খরচের হিসাব তো আগেভাগে করে রাখা সম্ভব হয় না।
অফিসের একজন কর্মী কাজ করতে গিয়ে হঠাৎ দুর্ঘটনাকবলিত হলে কোম্পানির করণীয় কী হবে? ওই ব্যক্তির ক্ষতিপূরণ দিতে যথেষ্ট বীমা নিশ্চয়তা কি কোম্পানির আছে? অথবা যদি কেউ কোম্পানির পণ্য বা সেবা অন্যায় কাজে ব্যয় করে এবং এই কারণে কোম্পানির বিরুদ্ধে কোনো মামলা হয়, তাহলে কোম্পানির কী করণীয় হবে? এই আইনি জটিলতা মোকাবেলা এবং তার ব্যয় বহন করার ক্ষমতা কি কোম্পানির আছে?
সুতরাং এ জাতীয় ঝুঁকি এড়াতে মূলধন এবং অর্থ প্রবাহ নিশ্চিত করার সাথে সাথে অপ্রত্যাশিত যেকোনো খরচের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। এজন্য ব্যবসা শুরু করার আগে একজন বিশ্বস্ত এবং অভিজ্ঞ আইনজীবীর সাথে সম্ভাব্য সকল আইনি বিষয় নিয়ে পরামর্শ করতে হবে। এছাড়া বিশ্বের যে অঞ্চলে বা দেশে ব্যবসা করা হচ্ছে, সে অঞ্চলের রাষ্ট্রীয় এবং সামাজিক আইন সম্বন্ধে সচেতন থাকতে হবে।
৩. ব্যবসার অর্থ এবং ব্যক্তিগত অর্থ পৃথকীকরণ
ব্যবসায় সফল হতে হলে ব্যবসায়িক অর্থ এবং ব্যক্তিগত অর্থের মধ্যে তফাত জানতে হবে। ব্যক্তিগত অর্থ ব্যবহার করে ব্যবসা শুরু করতে হয়, কিন্তু ব্যবসায়িক অর্থকে ব্যবসায়িক দৃষ্টিকোণ থেকেই কাজে লাগাতে হয়। ব্যবসা শুরু করার সময় এবং বিদ্যমান ব্যবসায় নতুন মাত্রা যোগ করতে ব্যক্তিগত অর্থ বিনিয়োগ করুন। তবে কোনোভাবেই একগুঁয়ে বা জেদী স্বভাবের বশবর্তী হয়ে কোনো অলাভজনক খাতে বিনিয়োগ করবেন না।
যদি ক্রমশ ব্যালেন্স শিট খালি হতে দেখেন এবং সামনে কোনো সম্ভাবনা না দেখেন, তবে ভুলেও সেই খাতে দ্বিতীয়বার বিনিয়োগ করে ব্যক্তিগত সম্পদ নষ্ট করবেন না। অনেক উদ্যোক্তা ব্যক্তিগত সম্পদের সুরক্ষার বিষয়টি উপেক্ষা করেন। ফলশ্রুতিতে ব্যবসায় লোকসান হওয়ার সাথে সাথে ব্যক্তিজীবনেও তিনি ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হন।
৪. আবেগ এবং প্রচেষ্টার পার্থক্য
সফলভাবে ব্যবসা পরিচালনা করা সত্যিই কঠিন। বিশেষ করে যখন খারাপ সময় আসে এবং ভবিষ্যৎ অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে, তখন কিছু কিছু উদ্যোক্তা হাল ছেড়ে দেন। কিন্তু যারা সত্যিই তার কাজকে ভালোবাসেন, তারা হাল ছাড়েন না। বরং প্রতিষ্ঠানকে সফল করতে তারা যেকোনো কিছু করতে রাজি থাকেন। এই শ্রেণীর মানুষের জন্য ওয়ারেন বাফেট একবার বলেছিলেন, “সব সময় সফল থাকার মূলে রয়েছে কাজের প্রতি গভীর প্যাশন।”
তবে মার্ক কিউবারের মতে, প্যাশন ভুল শব্দ হতে পারে। তিনি বলেন,
অনেক মানুষ আবেগ নিয়ে কথা বলেন, কিন্তু আসলে কোথায় ফোকাস করতে হবে, তা আবেগের বিষয় নয়। সফল হতে হলে আপনাকে চেষ্টা চালাতে হবে। সুতরাং আবেগকে অনুসরণ করবেন না, বরং আপনার প্রচেষ্টাকে অনুসরণ করুন।
তবে আবেগ বা প্রচেষ্টা যার বশবর্তীই হোন না কেনো, কখনো কোম্পানির বস হওয়ার জন্য কাজ করবেন না। কঠিন সময় অতিক্রম করে সফল হওয়ার জন্যই কাজ করুন।
উদ্যোক্তাদের জন্য বেশিরভাগ অর্থনৈতিক পরামর্শ বিনিয়োগ এবং বিপণন সম্পর্কে হয়ে থাকে। কিন্তু আসল ব্যাপার হলো মনস্থির করা। নিজের সীমানা নির্ধারণ করে অন্যদের কাছ থেকে শিখতে পারলে এবং অপ্রত্যাশিত সমস্যা মোকাবেলার প্রস্তুতি থাকলে সাফল্যের সম্ভাবনা অনেকাংশে বেড়ে যায়।
Feature photo: churchill wealth management