নেটওয়ার্কিং বলতে প্রথমেই আমাদের মাথায় কম্পিউটার বা ইন্টানেটের নেটওয়ার্ক এর কথা আসে। নেটওয়ার্ক মানে যুক্ত বা সংযুক্তি। বেশ কিছু উপাদান একে অন্যের সাথে পরস্পর যুক্ত হয়ে তৈরি করে একটি নেটওয়ার্ক। আমরা ব্যক্তি জীবনেও তেমনি তৈরি করি সামাজিক নেটওয়ার্ক। ছোটবেলা থেকে শুরু হয় আমাদের এই সামাজিক নেটওয়ার্কিং এর যাত্রা।
স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ও কর্মক্ষেত্র এসব জায়গায় আমরা পরিচিত হই অনেক মানুষের সাথে, যাদের মধ্যে অনেকের কথা আমাদের আর মনে থাকে না। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে কিংবা প্রয়োজনে আপনি তাদের দরকার বোধ করেন। আবার আপনি হয়তো কোনো দরকারে যোগ্য ও বিশ্বাসী লোক খুঁজছেন, আপনার পুরনো চেনা জানা মানুষই হয়তো আপনাকে সহায়তা করতে পারতো যদি আপনি তাদের চিনতেন বা মনে রাখতেন।আর তখনই দরকার পড়ে সামাজিক নেটওয়ার্কিং এর। সামাজিক নেটওয়ার্কিং এর মাধ্যমে আপনি আপনার চেনা জানা গণ্ডীর বাইরের মানুষদেরও চিনতে পারবেন, তাদের কাছ থেকে শিখতে এবং জানতে পারবেন। তাই খুব অল্প বয়সেই শুরু করুন আপনার সামাজিক নেটওয়ার্কিং।
আমরা অনেকেই চেষ্টা করি সুন্দর ও অর্থপূর্ণ একটি নেটওয়ার্ক তৈরি করতে কিন্তু সময়ের সাথে সাথে আপনার নেটওয়ার্ক ভাঙছে, মিলিয়ে দেখুন তো আপনিও কি এমন কোনো ভুল করছেন কিনা?
১.ফলো আপের অভাব
ক্যারিয়ারের শুরুতে আমরা প্রচন্ড চেষ্টা করি নতুন নতুন মানুষদের সাথে পরিচিত হতে, নিজের একটি শক্তিশালী নেটওয়ার্ক গড়ে তুলতে। আমরা লক্ষ্যে পৌঁছালে সেই চেষ্টায় ভাটা পড়ে, যেন আমরা সব জেনে গেছি বা শিখে গেছি। আর এটাই সবচেয়ে বড় ভুল। তাই বলা যায় নেটওয়ার্কিং এর সবচেয়ে বড় ত্রুটি হলো- নিজে একটা ভালো অবস্থানে যাবার পর কিংবা সেরা নেটওয়ার্কারদের কিছুদিন ফলো করার পর,পরবর্তীতে আর ফলো না করা। যেমন ধরুন,বাংলাদেশের একজন সেরা সামাজিক নেটওয়ার্কিং ব্যক্তিত্বকে আপনি ফলো করেন, দু’বছর পর কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছানোর পর আপনি তাকে ফলো করা কমিয়ে দিলেন, ভাবলেন সব তো জানি আর শিখেও ফেলেছি – এটাই আমাদের ভুল। আমরা কমবেশি সবাই এই ভুলটাই করে থাকি। আপাতদৃষ্টিতে মনে হবে এটি বড় কোনো ভুল না তবে আসলে এটাই সবচেয়ে বড় সমস্যা। নেটওয়ার্কিং শুরু করলে লেগে থাকবেন আর লেগে না থাকলে শুরুতেই নেটওয়ার্কিং করা ছেড়ে দিন।
২. অস্পষ্ট এবং অনাকর্ষণীয় বিজ্ঞাপন
যদিও সামাজিক নেটওয়ার্কিং হচ্ছে সামাজিক সম্পর্ক তৈরি করা। তবে আপনি যদি নিজেকে এবং আপনার দক্ষতাকে আপনার পার্টনারের কাছে ঠিকমতো তুলে না ধরেন তবে আপনি পারবেন না আপনার লক্ষ্যে পৌঁছাতে। এক্ষেত্রে ইউনিক সেলিং প্রোপোজিশন আপনার ব্যবসায়িক দক্ষতাকে সঠিকভাবে তুলে ধরতে পারে। এছাড়া ইউনিক সেলিং প্রোপোজিশন দরকার যাতে লোকজন জানতে পারে এবং বুঝতে পারে আপনার সম্পর্কে এবং তাদের আগ্রহের জন্ম নেয়। আপনি হয়তো বিভিন্ন সেমিনারে যাচ্ছেন, বিভিন্ন ধরনের মানুষের সাথে পরিচিত হচ্ছেন অথচ কেউই আগ্রহী হচ্ছে না আপনার প্রোডাক্ট সম্পর্কে। এর কারণ আপনি সঠিকভাবে তুলে ধরেননি আপনার তথ্য। অপেশাদার ব্যবসায়ীরা ও এই ভুল করেন নিয়মিত। তবে আপনারা নিচের ফর্মুলা দিয়ে আপনার ব্যক্তিগত ইউনিক সেলিং প্রোপোজিশন তৈরি করতে পারেন। এখানে আমরা ব্রায়ানের অসাধারণ ইউনিক সেলিং প্রোপোজিশনের কথা তুলে ধরছি, তিনি এভাবে সেল করেন-
“আমি কাজ করি (কাঙ্ক্ষিত বাজারকে) নিয়ে এবং আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে আপনাদের এইভাবে (যেসব সুবিধা আপনি দেবেন) সহায়তা করা।”
তার এই বিজনেস প্রস্তাব খুবই সাধারণ এবং পরিষ্কার এবং এখন তো সরাসরি অর্জনের গল্প। ব্রায়ান বলেন,“আমি কাজ করি ব্যস্ত উদ্যোক্তাদের জন্য, তাদের মার্কেটিং এর কাজ আমি করি ৯০ দিনের মাঝেই। ”
ব্রায়ানের এই বিজ্ঞাপন তাকে যেমন দিয়েছে নেটওয়ার্কিং এর জগতের খ্যাতি তেমনি ব্যবসায়িক প্রসার। তাই আপনি চেষ্টা করবেন সঠিকভাবে এবং আলাদাভাবে বিজনেস প্রপোজিশন তৈরি করতে।
৩.নেটওয়ার্কিং এবং কোল্ড কলিংকে গুলিয়ে ফেলা
এই ভুল সম্পর্কে বলার আগে আমাদের আগে বলতে হবে নেটওয়ার্কিং এবং কোল্ড কলিং এর পার্থক্য। সামাজিক নেটওয়ার্কিং হচ্ছে মূলত সামাজিক সম্পর্ক তৈরি যা মূলত দুজন ব্যক্তির মাঝে পারস্পারিক প্রয়োজন ও দক্ষতার প্রচার এবং ব্যবহার করা। আর কোল্ড কল হচ্ছে কাউকে আগ্রহী করা বিশেষ ভাবে ফোন–মেসেজ বা সরাসরি কাউকে প্ররোচিত করানো বিশেষ কাজ বা প্রোডাক্টের প্রসার।
অনেকেই নেটওয়ার্কিং এবং কোল্ড কলকে গুলিয়ে ফেলেন বিশেষ করে কোল্ড কলের টিপসগুলো যখন সামাজিক নেটওয়ার্কিং এর জন্য ব্যবহার করতে যান। অনেকেই এই ভুলটা করে থাকেন, নেটওয়ার্কিং এর সময়েও আপনি চান কোল্ড কল এর মতো নিজের সম্পর্কে তুলে ধরতে বা আপনার প্রোডাক্টের প্রসার ঘটাতে। মনে রাখবেন, সামাজিক নেটওয়ার্কিং হচ্ছে সম্পর্ক তৈরি করা এবং অন্যদের সম্পর্কে জানা। এখানে আপনি প্রশ্ন করবেন আপনার পার্টনার সম্পর্কে, তার সম্পর্কে আগ্রহী হবেন এবং পাশাপাশি কিভাবে আপনার দক্ষতা দিয়ে তাকে সাহায্য করবেন, ফলশ্রুতিতে আপনাদের মধ্যে একটি অর্থপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি হবে এবং সবশেষে আপনিও পাবেন সুবিধা। মোদ্দা কথা, নেটওয়ার্কিং এর মাধ্যমে আপনি আপনার ভবিষ্যৎ ব্যবসা এবং দক্ষতার প্রচার এবং প্রসারের সুবিধা পাবেন আরেকজনকে সহায়তার মাধ্যমে। আর আপনি যদি সেখানে শুরুতেই আপনার ব্যবহার প্রচার–প্রসারের চিন্তা করেন তাহলে সম্পর্ক তৈরির বদলে আপনি হারাবেন একজন ভবিষ্যৎ ক্রেতা।
৪.রেফারেল পার্টনারের প্রয়োজনে দ্রুত সাড়া না দেওয়া
এই ভুল সম্পর্কে আমরা জানি এবং কিছুটা হলেও বুঝি, তারপরও আমরা এই ভুলটা করি। এই ভুল আমাদের ব্যক্তিগত সামাজিক নেটওয়ার্কের ধ্স নামায়। আপনার নেটওয়ার্কের নতুন রেফারেল পার্টনারের ডাকে দ্রুত সাড়া না দেওয়াটা হয়তো খুব সধারণ সমস্যা, তবে এই সমস্যা অনেকে ক্ষেত্রে বিরক্তিকর এবং পরবর্তীতে সমস্যার সৃষ্টি করে। আপনার সামাজিক নেটওয়ার্ক গড়ে উঠে মূলত রেফারেন্সের মাধ্যমে।
যখন কোনো রেফারেন্সের মাধ্যমে কেউ ডাকে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আমরা দোটানায় ভুগে সাড়া দেই না সময়মতো। এটি যেমন আমাদের নতুন সামাজিক নেটওয়ার্ক গড়ে তুলতে বাধা দেয় তেমনি যার কাছ থেকে আপনি রেফারেন্স পেয়েছিলেন তার সাথেও আপনার সম্পর্কের অবনতি হবে। আপনার নেটওয়ার্ক পার্টনারকে আপনার গুরুত্বপূর্ণ ক্লায়েন্ট হিসাবে গণ্য করা উচিত। ব্যস্ততার কারণে ফোন ধরতে না পারলে আপনার নেটওয়ার্ক পার্টনারকে অবশ্যই পরে নিজে থেকে ফোন দিবেন, এই সাবধানতা সব সময় মেনে চলবেন কেননা এই বিশেষ গুণ আপনার দায়িত্ববোধ এবং আস্থার প্রকাশ ঘটায়।
একটু চারপাশে মনোযোগ দিয়ে তাকালেই দেখতে পারবেন আপনার আশেপাশে অনেকেই খুব দ্রুত একটি নেটওয়ার্ক গড়ে তুলছে, এর কারণ তারা কোনো জায়গা থেকে রেফারেন্স পেয়েই অল্প ক’দিনের মাঝেই রেফারাল ব্যক্তির সাথে যোগাযোগ করে। একটি প্রবাদের কথা বলা যায় “যদি তুমি নাক ডাক তাহলেই তুমি হারবে।” অর্থাৎ আপনি যদি রেফারাল পার্টনারের সাথে খুব দ্রুত নিজে থেকে যোগাযোগ না করেন তারা আপনার কথা ভুলে যাবে কিন্তু আপনি যদি খুব দ্রুত যোগাযোগের চেষ্টা করেন তাহলে তারা আপনার বিষয়ে আগ্রহী হবে। আপনি যদি রেফারাল এর নাম ফোন নাম্বার জানেন তবে অবশ্যই তার সাথে আগে যোগাযোগ করে নেবেন, খেয়াল রাখবেন অসময়ে আবার ফোন করে বসবেন না।
৫.সম্পর্কের অপব্যবহার
নেটওয়ার্কের মূল লক্ষ্য হচ্ছে বিভিন্ন ধরণ আর পেশার মানুষের সাথে একটি অর্থপূর্ণ এবং বিশ্বাসযোগ্য সম্পর্ক তৈরি করা। তবে অনেকেই এই সম্পর্কের অপব্যবহার করে থাকেন নানাভাবে। তবে পরের গল্পটি শুনে কিছুটা হলেও সম্পর্কের অপব্যবহার সম্পর্কে একটি ধারণা পাবেন।
এক ভদ্রমহিলা তার পুরনো সহকর্মীর ৫০ তম জন্মদিনের দাওয়াত পান। পুরনো সহকর্মী একই নেটওয়ার্কের সদস্য এবং তারা একই সাথে অনেক দিন কাজ করেছিলেন। তাই শ্রদ্ধা এবং বিশ্বাসের থেকেই ভদ্রমহিলা গিয়েছিলেন জন্মদিনের পার্টিতে। পার্টিতে এসে দেখেন একজন বিশিষ্ট ব্যক্তিকে ঘিরে অতিথিরা বসে আছেন এবং তার কথা শুনছেন। তিনি যোগ দেবার পর বুঝতে পারেন আসলে এটি শুধু জন্মদিন পার্টির নামে একটা ছোটোখাটো একটি ব্যবসায়িক পার্টি। ব্যবসায়িক সুবিধা পাবার জন্য তিনি জন্মদিনকে ব্যবহার করে অতিথিদের দাওয়াত দেন। এরপর থেকে ভদ্রমহিলা দূরত্ব ঠিকই রেখেছিলেন। তবে ভদ্রমহিলা আক্ষেপ করে বলেছিলেন- জন্মদিন পার্টিতে আনন্দের ছিল শুধু কোম্পানির ডায়েট জুস!
তাই কখনোই এই ধরণের ভুল করবেন না। ইচ্ছাকৃত ভাবে আপনার নেটওয়ার্কের পার্টনারকে ব্যবহার করবেন না। বিশ্বাস এবং শ্রদ্ধা হচ্ছে নেটওয়ার্কিং রিলেশনের মূল বিষয়। আপনি যদি গল্পের মতো দাওয়াত করে এনে ব্যবসায়িক স্বার্থোদ্ধার করেন তবে খুব দ্রুতই আপনাদের মধ্যকার সম্পর্কের অবনতি ঘটবে, কেননা বিশ্বাসের উপর নির্ভর করেই নেটওয়ার্কিং রিলেশন তৈরি হয়েছিল এবং আপনি যখনই অবিশ্বাসের সাথে কাজ করবেন, তখনই আপনার উপর পার্টনার বিশ্বাস হারাবে এবং আপনাদের সম্পর্কের অবনতি ঘটবে।
আপনি যদি বিভিন্ন ভাবে চেষ্টা করার পরও বেশ শক্ত ও অর্থবহ একটি নেটওয়ার্ক গড়ে তুলতে না পারেন তবে উপরের পাঁচটি ভুলের বিষয়ে সচেতন হোন এবং সমাধানগুলোকে কাজে লাগিয়ে দেখুন। আপনার নেটওয়ার্কিং এর অগ্রগতি সম্পর্কে ধারণা করতে পারবেন।