নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে, হাত ঘামছে, কাঁপছে পা, গলা দিয়ে যেন স্বর বেরোচ্ছে না। শরীর বেশ অসুস্থ লাগছে, মাথা ঘুরঘুর করছে। কথার সাথে সাথে হাঁটু আর হাত কাঁপছে , এসবই মঞ্চভীতির লক্ষণ। যদি আপনি মঞ্চভীতির স্বীকার হয়ে থাকেন তবে আজকের এই আয়োজন আপনার জন্যই। মঞ্চভীতি বা ইংরেজীতে “Stage Fright” বেশ সাধারণ একটি ব্যাপার। হয়তো একা কিংবা বদ্ধ ঘরে বা ৮-১০ জন বন্ধুদের মাঝে বেশ চঞ্চল মানুষটিও মঞ্চে উঠে ভীষণ ভয় পেয়ে যায়। সামনে এত মানুষ আর যদি থাকে বিচারক তবে তো অবস্থা বেগতিক। হুট করে নিজের দিকে এতগুলো চোখের দৃষ্টি বুঝতে পেরে আমাদের মস্তিষ্ক আমাদের মধ্যে ভীতি তৈরী করে।
মঞ্চভীতি অত্যন্ত সাধারণ হলেও এর ফলাফল কিন্তু সাধারণ নয়। এই মানসিক অবস্থা থেকে যতদ্রুত বেড়িয়ে আসা যায় ততটাই ফলপ্রসু। মঞ্চভীতি কাবু করার আগে মঞ্চভীতিকে কাবু করে নতুন ভাবে নতুন উদ্যোমে এগিয়ে চলা উচিত। আজকে আলোচনার বিষয়বস্তু মঞ্চভীতি দূর করার কয়েকটি উপায় নিয়েই।
১. উৎসাহীবোধ করা
হার্ভার্ড বিজনেস স্কুলের একটি গবেষণায় দেখা গেছে যদি নিজের ভীতিকে উৎসাহে বা উত্তেজনায় রূপান্তর করা যায় তবে কাজ অনেকটাই সহজ হয়ে যায়। তারা আরো বলেছেন, “উদ্বেগই আসলে উত্তেজনার অংশ“। এটির কারণে নিজেকে বিচলিত হওয়া থেকে বের করে আনা সম্ভব হতে পারে। গবেষকরা বলেছেন, নিজেকে শান্ত করার চাইতে নিজের মধ্যকার চিন্তাকে বদলানোটা সহজ এবং অতি উত্তম। বিচলিত থাকা অবস্থায় নিজেকে ভুল বুঝিয়ে শান্ত না করে ভেতরকার ভীতিকে উত্তেজনার বিক্ষিপ্ত করার চেষ্টা করুন এতে উৎসাহবোধ আসবে।
২. চিন্তা প্রথম ৫ মিনিটের
মঞ্চের যেকোনো উপস্থাপনার প্রথম ৫ মিনিটই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং ভয়াবহ। প্রথম সে ভীতিকর ৫ মিনিট যদি কাটিয়ে নেওয়া যায় তবে খুব সহজেই পুরোটা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে। কারণ প্রথমেই আমাদের মস্তিষ্ক এতগুলো দৃষ্টি একসাথে নিয়ে অভ্যস্থ হতে পারে না যা ৫ মিনিট পরই হতে পারে।
অনেকটা মানিয়ে নেওয়া যাতে আমাদের শরীরও মানিয়ে যায় আর ভীতি দূর হতে থাকে। তাই যখন এই উপস্থাপনের জন্য অনুশীলন করা হবে প্রথম অংশের প্রস্তুতি যেন হয় সর্বোচ্চ সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। মঞ্চে অবস্থানের সময় শুরুতে নিজেকে বলতে হবে শুধুমাত্র ৫ মিনিট নিজেকে মানিয়ে নিতে হবে এরপর থেকে সব নিজেই এগোতে থাকবে । শুরুর ৫ মিনিট নিয়ে সর্বত্তম প্রস্তুতি থাকলে এবং তা সুন্দরভাবে উপস্থাপন করে যেতে পারলে পরের অংশটুকু পানির মতই সহজ হয়ে যাবে।
৩. আত্মসমালোচনায় নয় নিজের মনোযোগ হোক বিষয়ে
মঞ্চভীতি বেশ অদ্ভুত কিছু চিন্তার উদয় করতে পারে। যেমন মঞ্চে ওঠার পর নিজেকে কেমন দেখাচ্ছে এই নিয়ে মনের সাথে একটা যুদ্ধ লাগতে পারে। তাছাড়া যদি কোনো দর্শক ঘড়ির দিকে তাকায় তা আমাদের মস্তিষ্ক খুব দ্রুত জানান দেয় কতটা বিষন্নতার সৃষ্টি হচ্ছে পুরো ঘর জুড়ে এবং উপস্থাপনা শেষ হওয়ার আগেই আপনি নিজেই নিজেকে বোঝানো শুরু করেন সকলে কতটা অনুৎসাহী আপনার উপস্থাপনা নিয়ে এবং কতটা বিরক্ত।
এই ব্যাপার থেকে বের হয়ে আসার একমাত্র উপায় নিজের ওপর থেকে মনোযোগ সরানো। মনে রাখতে হবে, আপনাকে দেখতে দর্শক আসেনি, দর্শক জানতে বা দেখতে এসেছে আপনার উপস্থাপনা। আপনি যে বিষয় নিয়ে কথা বলছেন বা যা উপস্থাপন করছেন সেটি গুরুত্বপূর্ণ আপনার নিজের পোষাক বা রূপ নয়।
৪. সবচেয়ে খারাপের জন্য প্রস্তুত থাকা
নিজের মাথায় যদি সবচেয়ে খারাপ কী হতে পারে তা নিয়ে একটা ধারণা থাকে তবে তা নিয়ে একটা পরিকল্পনা বানিয়ে ফেলা উচিত। সেক্ষেত্রে অপ্রত্যাশিত ভাবে সে সকল ঘটনার সম্মুখীন হলেও তা থেকে বের হয়ে আসার উপায়টা জানা থাকবে। যেমন যদি কোনো ভাবে বোঝা যায় উপস্থিত দর্শকেরা বেশ বিরক্ত বা বেশ বিষন্ন তবে একটি ছোট কৌতুক আত্মস্থ করে যাওয়া সে সময়ের জন্য কঠিন কিছু হবে না।
নিজের মাথায় সকল খারাপ চিন্তা আনা কিন্তু আসলে এতটা খারাপ না। সব ধরণের অবস্থার জন্য প্রস্তুত থাকাই বুদ্ধিমানের কাজ। তাছাড়া একবার যদি মাথায় খারাপ চিন্তা নিয়ে ভাবা হয়ে যায় তবে আসলেই সেই পরিস্থিতিতে অতটা বিচলিত মনে হয় না নিজেকে কেননা এই নিয়ে চিন্তা করা আছে যা আমাদের মস্তিষ্কের জন্য নতুন পরিস্থিতি নয়।
ছোটবেলা থেকে সকলেই শুনে আসছি “শুভ বা মঙ্গল চিন্তা করা উচিত” কিংবা “অশুভ কথা ভাবতে নেই”। এগুলো আসলে ভুল ধারণা, সবসময় নিজেকে ভালোর জন্য তৈরী করা উচিত নয়। মঞ্চে হঠাৎ এমন কোনো পরিস্থিতির স্বীকার হওয়া গেলো যা নিয়ে ভাবা হয়নি আগে। কিন্তু যদি ওই পরিস্থিতি নিয়ে আগে থেকে একটা সুষ্ঠু পরিকল্পনা বানানো থাকে কিভাবে উতরে আসা যায় এই ব্যাপারে, তাহলে কিন্তু ওই বিপদকে বিপদ মনে নাও হতে পারে। তাই সবসময় সব কিছু জন্য চিন্তা করে রাখা প্রয়োজন।
৫. নিজের সাথে সুন্দর সম্পর্ক তৈরী করা
নিজের সাথে নিজের সম্পর্ক খারাপ হতে পারে এটা কখনো ভেবে দেখেছেন? হ্যাঁ, হতেই পারে যদি থাকে আত্মবিশ্বাসের অভাব। তখন মানুষের নিজের প্রতি ঘৃণা জন্মাতে থাকে এবং মস্তিষ্কে বসে যায় যে নিজেকে দিয়ে কিছু হবে না। তবে এই চিন্তা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। আত্মবিশ্বাসের সাথে সাথে নিজেকে ভালবাসতে হবে নিজেকে জানতে হবে। নিজের সকল ভুলভ্রান্তি থেকে শিক্ষা নিতে হবে এবং জেনে নিতে হবে নিজের ভয়গুলো। যাদের নিজেদের ওপর নিয়ন্ত্রণ নেই তারাই কেবল মাত্র অসফল। সাফল্যের একমাত্র চাবিকাঠি নিজেকে চেনা, নিজের ভয়গুলোকে চেনা। যখন একজন মানুষ নিজেকে পুরোপুরি চিনে যায় তার মধ্যে উদয় হয় আত্মবিশ্বাসের এবং দূর হতে থাকে সকল ভীতি।