বিশ্বাস হলো মূলত মানুষের মনে ধারণকৃত একটি ধারণা। কারো প্রতি ভরসা করার একমাত্র উপায় হলো বিশ্বাস। এই বিশ্বাস মনে ধারণ করার মাধ্যমেই আমাদের মধ্যে একে অন্যকে সাহায্য করার মানসিকতা গড়ে ওঠে। ঠিক তেমনি কোনো কাজ সম্পন্ন করার জন্য দলের প্রত্যেক সদস্যের মাঝে বিশ্বাসের জায়গা স্থাপন করে নেওয়াটা আবশ্যক।
দলে বিশ্বাস স্থাপন করা অত্যন্ত জরুরি; Source: 123rf.com
লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য প্রত্যেক সদস্যকেই অর্জিত আস্থার জায়গাটা ধরে রাখতে হয়। বিশ্বাস ছাড়া একটি দল কখনোই সাফল্যের সাথে এগিয়ে যেতে পারেনা। চলুন জেনে নেওয়া যাক দলের সাফল্যের জন্য বিশ্বাস কীভাবে সহায়তা করে।
মনস্তাত্ত্বিক সুরক্ষা তৈরি করে
একটি দলের সফলতা অর্জনের জন্য সদস্যদের মধ্যে পারস্পরিক বিশ্বাস ঠিক রাখাটা খুব বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কেননা বিশ্বাস মানুষের মাঝে মনস্তাত্ত্বিক সুরক্ষা তৈরি করে৷ যা তাদের একসাথে কাজ করার এক অদম্য ইচ্ছা জাগিয়ে তোলে। বিশ্বাস কীভাবে একটি দলকে সফলভাবে এগিয়ে যেতে সাহায্য করে সে সম্পর্কে গুগলের বিশ্লেষণে দেখা যায় যে, “দলের সাফল্যের এক নম্বর উপাদানই হচ্ছে মনস্তাত্ত্বিক সুরক্ষা”। লিডার ফ্যাক্টরের সিইও এবং আসন্ন “দ্য 4 স্টেজ অফ সাইকোলজিক্যাল সেফটি” বইয়ের লেখক Timothy R. Clark বলেন,
বিশ্বাস দলের প্রত্যেকের মনে মনস্তাত্ত্বিক সুরক্ষা নিশ্চিত করে; Source: venturebeat.com
“বিশ্বাস বলতে মূলত মানুষের আচরণের ভবিষ্যদ্বাণীকে বোঝানো হয়ে থাকে। আপনার ব্যবহারের নমুনার উপরই নির্ভর করবে আপনার প্রতি অন্যের বিশ্বস্ততা ও মানসিক নিরাপত্তার ভবিষ্যদ্বাণী। আমি যদি আপনার সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারি যে, আপনি আমার কোনে ক্ষতি করবেন না, শাস্তি দিবেন না বা অপমান করবেন না, তখন আমি আপনার সাথে কাজে সম্পৃক্ত হতে পারবো। আবার আমি যদি বিশ্বাস করতে না পারি যে আপনি আমাকে নিরাপত্তা দিতে পারবেন, তখন এই আস্থার অভাবটি আমার স্ব-সেন্সরিং প্রবৃত্তিটিকে প্ররোচিত করবে এবং আমি তখন নিজের নিরাপত্তা ও ব্যক্তিগত জীবনের ঝুঁকিগুলো পর্যবেক্ষন করবো।”
সুতরাং উচ্চ স্তরের আস্থা ছাড়া দলের সদস্যরা কিছুতেই মনস্তাত্ত্বিক সুরক্ষা বোধ করতে পারে না।
প্রশ্নোত্তরে উৎসাহ দেয়
কোনো বিষয়ে জানার জন্য বা কোনো কাজ শেখার জন্য, সেই বিষয়ে বিশেষজ্ঞ ব্যক্তির কাছে প্রশ্ন করাটা অত্যন্ত জরুরি। যেমনটা আমরা শিক্ষকদের নিকট করে থাকি। কিন্তু কর্মক্ষেত্রে অনেকেই এভাবে প্রশ্ন করতে পারে না। যদিনা তারা একে অপরের প্রতি বিশ্বাসযোগ্য হয়। কার্যত সকলেই স্বীকার করেন যে, তারা কর্মক্ষেত্রে যেকোনো কাজ, অ্যাসাইনমেন্ট বা প্রকল্প সম্পর্কে প্রশ্ন থাকা সত্ত্বেও প্রশ্ন করতে পারে না। কারন তারা প্রশ্ন করতে দ্বিধাবোধ করেন। মূলত এই ভয়গুলো বিশ্বাসের নিম্ন স্তরের প্রতিনিধিত্ব করে।
দলের সদস্যরা প্রায়শই কোনো প্রশ্ন করতে বা কোনো বিষয়ে স্পষ্টভাবে জানতে চাইতে দ্বিধাগ্রস্থ হোন। কারণ তারা মনে করে প্রশ্ন করলে অন্যরকম প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হবে বা তার সাথে নেতিবাচক সম্পর্ক তৈরি হবে। এর মূল কারণ হলো পারস্পরিক বিশ্বাসযোগ্যতার অভাব। যদিও বাস্তবতা হলো নিয়মিত জিজ্ঞাসাবাদের মাধ্যমে ভাল সিদ্ধান্ত গ্রহণ, বর্ধিত ফলাফল এবং যোগাযোগের মূল্যবান উন্নতি সাধন হয়। তাই আপনার সহকর্মীদের কাছে বিশ্বাসযোগ্য হওয়ার চেষ্টা করুন এবং যেকোনো বিষয় নিঃসংকোচে জানার ও বলার মতো পরিবেশ তৈরি করুন।
ব্যবসায়ের সুনাম বৃদ্ধি করে
বর্তমানে অনলাইন প্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রায়শই একটি সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। প্রতিষ্ঠানের খুব বেশি প্রচার ও বিশ্বাসযোগ্যতা না থাকলে, কোনো বিশেষ কারণবশত পণ্য বা সেবা দিতে দেরি হলেই কিছু কাস্টমার প্রতিষ্ঠানটি সম্পর্কে আপত্তিকর রিভিউ দিয়ে থাকেন। যেটা একটি বিশ্বাসযোগ্য প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কখনোই দিতে পারে না। এই বিশ্বাসের উপরই প্রতিষ্ঠানের সুনাম নির্ভর করে। তাই প্রতিষ্ঠানকে সুনামধন্য করে তুলতে হলে আগে বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করা জরুরি।
দলের অভ্যন্তরীণ বিশ্বাস প্রতিষ্ঠানের সুনাম বৃদ্ধি করে; Source: wealthbergrealestate.com
তাছাড়া প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের যোগাযোগ দক্ষতা থাকা চাই অত্যন্ত প্রখর। সহকর্মীদের থেকে শুরু করে কাস্টমার ও প্রতিষ্ঠান সম্পর্কিত অন্যান্য ব্যক্তিবর্গের সাথে সখ্যতা গড়ে তুলতে পারলেই প্রতিষ্ঠানকে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলা খুব সহজ হয়। আপনি যদি আপনার দলের সহকর্মীদের কাছে বিশ্বাসযোগ্য হতে না পারেন, তাহলে কাস্টমারদের কাছে কোনোভাবেই বিশ্বাস অর্জন করতে পারবেন না। তাই প্রতিষ্ঠানকে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে হলে সর্বপ্রথম প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরীণ ব্যক্তিবর্গকে বিশ্বাসী হতে হবে। কেননা আপনার প্রতি আস্থা থাকলেই কাস্টমার আপনার প্রতিষ্ঠানের প্রতি সহজে বিশ্বাস রাখতে পারবে।
উদ্ভাবন এবং দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহায়তা করে
মূলত কর্মক্ষেত্রে সাফল্য নির্ভর করে দলগত কাজের ক্ষেত্রে কতটা বিশ্বাস বিদ্যমান তার ওপর। কর্মক্ষেত্রে উচ্চ বিশ্বাসযোগ্য পরিবেশ নতুন কিছু উদ্ভাবন, গতিময় সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং দলের মধ্যে স্থবিরতা প্রতিহত করতে উৎসাহ প্রদান করে। ওয়ার্কপ্লেস থেরাপিস্ট ব্র্যান্ডন স্মিথ জোর দিয়ে বলেছেন যে, “বিশ্বাস দলগুলোকে কেবল ঝুঁকি নিতে নয়, বরং আরও দ্রুত অগ্রসর করতে সাহায্য করে। কেননা উচ্চ আস্থার পরিবেশে দলের সদস্যরা সবসময় ইতিবাচক অভিপ্রায় অনুধাবন করে।”
নতুন কিছু উদ্ভাবনের চেষ্টা করা, ব্যর্থ হওয়া এবং আবার চেষ্টা করার ইচ্ছে থাকা প্রয়োজন প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের। তাছাড়া ঝুঁকি গ্রহণের এই মনোভাবটিকে কম বিশ্বাসযোগ্য প্রতিষ্ঠানগুলো কখনোই সমর্থন করে না। যার ফলে তারা নতুন কিছু উদ্ভাবন করতে পারে না। কেননা নতুন কিছু উদ্ভাবনের জন্য অবশ্যই অনেক পরিশ্রম ও ঝুঁকি গ্রহণের মানসিকতা থাকা প্রয়োজন। এছাড়াও দলের সদস্যরা যদি একে অপরকে বিশ্বাস না করে, তবে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়াটা খু্ব কঠিন হয়ে যায়। যা একটি উন্নয়নশীল প্রতিষ্ঠানের জন্য খুবই হতাশাজনক।
কাজে সমন্বয় সাধন করতে সহায়তা করে
একটি প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন যোগ্যতা সম্পন্ন মানুষ কাজ করে। তাদের কেউবা স্বল্প প্রতিভাবান আবার কেউ অধিক প্রতিভাবান। কিন্তু কাজের সময় তাদের সবাইকে সমন্বিত হয়ে কাজ করতে হয়। দলের একজন যদি অপরজনের প্রতি এই বিশ্বাসটা না রাখতে পারে যে, ‘সে আমার দুর্বলতা নিয়ে আমাকে হেয় করবে না’। তাহলে সেই দল কখনোই উন্নতি করতে পারবে না। কেননা একটি দল মানেই একটি পরিবার। পরিবারের একজন কিছু না বুঝলে যেমন নিঃসংকোচে প্রকাশ করতে পারে এবং অন্যজন তা বুঝিয়ে দেয়। ঠিক তেমনি প্রতিষ্ঠানের প্রতিটি কর্মীকে এই স্বাধীনতা দেওয়া উচিত।
কাজে সমন্বয় সাধন করার জন্য বিশ্বাস খুবই গুরুত্বপূর্ণ; Source: webnmarketing.com
হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংগঠনিক ব্যবহারের একজন অধ্যাপক জেফ পোলজারের মতে,
“ব্যক্তিগত দুর্বলতা খুব সংবেদেনশীল একটি বিষয়। প্রকৃতপক্ষে নিজের সীমাবদ্ধতা স্বীকার করে নেওয়ার মধ্যে নেতিবাচক কিছুই নেই। পুরো ব্যাপারটাই হল নিজেকে অন্যের কাছে তুলে ধরা এবং বলতে চাওয়া যে আমার একটি বিষয়ে সাহায্য দরকার। কর্মক্ষেত্রে কেউ যদি নিজের দুর্বলতার কথা তার পাশের সহকর্মী কিংবা দলের অন্য সদস্যকে জানিয়ে সাহায্য আশা করে তখন কাজের পুরো পরিবেশ হয়ে ওঠে বন্ধুত্বপূর্ণ। সেই মুহূর্ত থেকেই কারও মাঝে কাজের প্রতি অনীহা অনুভব করার মতো কিছু থাকে না।”
Featured Image Source: ScienceForWork