প্রতি সপ্তাহে সাইবার অপরাধ নিয়ে কথা হচ্ছে পত্রিকায়, টক শোতে। আজ এই কোম্পানী হ্যাক করছে কাল ওই কোম্পানীর সাইট বন্ধ, কোটি কোটি ব্যবহারকারীর নাম, পাসওয়ার্ড বা ক্রেডিট কার্ড নম্বর চুরি করেছে। এই তো কিছুদিন আগে বাংলাদেশ ব্যাঙ্ক থেকে চুরি হয়ে গেল মিলিয়ন ডলার সাইবার ক্রাইমের মাধ্যমে। আপনার ফিঙ্গার প্রিন্ট জমা হয়ে আছে বিভিন্ন মোবাইল কোম্পানির সার্ভারে। সেখান থেকে আপনার তথ্য চুরি হয়ে আপনি ফেঁসে যাচ্ছেন। বিভিন্ন ভাবে বিকাশে হয়রানির শিকার হচ্ছে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ। এই সব গল্প আমাদের দেশের, হ্যাকার বা সাইবার অপরাধীরা অনেক সময় গ্রুপ আকারে কাজ করে আবার অনেকে একাই।
এখন তাই বলে কি কম্পিউটার ইন্টারনেট ব্যবহার করবো না তাই কি হয় এই সময়ে? বলে তো বাঘের ভয়ে কি সুন্দরবন দেখতে যাবো না? আমরা ঠিকই ব্যবহার করবো তবে আমরা যদি একটু সতর্ক থাকি তাহলে অনেক ভাবে নিজেদের তথ্য সাবধানে রাখতে পারবো তেমনি নিজেরা থাকবো সুরক্ষিত। তাই আজ আপনাদের জন্য নিয়ে এলাম বেশ কিছু টিপস, আমি নিজে ব্যবহার করছি ব্যবহার করছি।
১. সফটওয়্যার বা রোবটিক পাসওয়ার্ড ব্যবহার করুন
মানুষের মস্তিষ্ক শুধুমাত্র অনেক পাসওয়ার্ড মনে করতে পারে, কিন্তু পাসওয়ার্ড বানানোর ক্ষেত্রে মস্তিষ্ক খুবই নিম্নমানের কাজ করে। মানুষের মস্তিষ্ক অক্ষর এবং সংখ্যা দিয়ে জটিল কম্বিনেশন তৈরি করতে পারে না। তাই একটা জিনিস খেয়াল করে দেখবেন যে, আমরা একই পাসওয়ার্ড বিভিন্ন জায়গায় ব্যবহার করি। গুগল থেকে শুরু করে সোশাল সাইটগুলোতে ঘুরে ফিরে একই পাসওয়ার্ড ব্যবহার করি। তাই আপনার মতো আমিও প্রায়ই একাধিক সাইট জুড়ে একই পাসওয়ার্ড পুনঃব্যবহার করেছিলাম। এর কারণ আমরা কঠিন ধরনের পাসওয়ার্ড বিভিন্ন জায়গায় দিয়ে উলোট পালট করে ফেলি।
আবার আমরা অনেকেই পাসওয়ার্ড এর জায়গায় নিজেদের জন্মস্থানের নাম, জন্ম তারিখ ব্যবহার করি। এই ধরনের হলে আপনি এবং আপনার ব্যক্তিগত সব তথ্য ঝুঁকির মাঝে আছে। কারণ কী? কারণ একবার যদি যে কোন হ্যাকারওয়েবসাইটের থেকে আপনার ইমেইল, ফোন নাম্বার, ঠিকানা এবং পাসওয়ার্ড চুরি করে ফেলে তাহলেই কেল্লা ফতে। তারপর তারা ইমেইল ব্যবহার করে আপনার অন্যান্য ব্যবহার করা সাইটগুলোতে লগইন করতে চেষ্টা করবে। তারা একই পাসওয়ার্ড ব্যবহার করার চেষ্টা করবে যতক্ষণ না তারা আপনার তথ্য পেয়ে যায়। আপাতদৃষ্টিতে খুব একটা সমস্যা না মনে হলেও এটি আপনার জীবন ধ্বংস করে দিতে পারে। কারণ আমাদের অনেকেই ফেসবুক, গুগল, টুইটার এবং অনলাইন ব্যাংক অ্যাকাউন্টের জন্য একই পাসওয়ার্ড ব্যবহার করি।
তাহলে এই সমস্যার সমাধান কী, একটি পাসওয়ার্ড ম্যানেজার! আপনার দরকার একটি পাসওয়ার্ড ম্যানেজার যেটি আপনার কম্পিউটার এবং মোবাইল ডিভাইসগুলোতে থাকবে এবং সেই পাসওয়ার্ড ম্যানেজার আপনার হয়ে বড় এবং জটিল ধরনের র্যান্ডম পাসওয়ার্ড তৈরি করে দেবে। শুধু তাই নয় এখনকার পাসওয়ার্ড ম্যানেজার গুলো চাইলে এক ক্লিকে আপনার দরকারী সাইট গুলোতে স্বয়ংক্রিয়ভাবে পাসওয়ার্ড দিয়ে লগ ইনে সাহায্য করে। বর্তমান সময়ের সবচেয়ে জনপ্রিয় পাসওয়ার্ড ম্যানেজার হচ্ছে 1 প্যাসওয়ার্ড এবং লাস্টপাস।
২. ইউ টু এফ(U2F) সিকিউরিটি পেন্ড্রাইভ সাথে রাখুন
মাঝে মাঝেই প্রয়োজনে অন্যের কম্পিউটার ব্যবহার করতে হয়। প্রয়োজনের কারণে আমরা অন্যের কম্পিউটার দিয়ে লগইন করলেও অজ্ঞতার কারণে আমাদের আমাদের সব তথ্য জমা হয়ে থাকে ওয়েবসাইটের মেমোরিতে। তাই হঠাত প্রয়োজনের তাগিদে কিনে নিতে পারেন ইউ টু এফ (U2F) সিকিউরিটি কি। এই কি বা চাবি হচ্ছে অনেকটা পেনড্রাইভের মতো দেখতে ছোট যন্ত্র যেখানে আপনার লগইন সম্পর্কিত সকল তথ্য যেমন ইমেইল আইডি এবং পাসওয়ার্ড জমা থাকে। আপনি এই যন্ত্রটি পেনড্রাইভের মতো করে ইউএসবি হিসাবে ব্যবহার করে অন্যের কম্পিউটারে লগইন করতে পারেন। নিজের তথ্য সাবধানে রাখতে তাই অন্যের ডিভাইসে লগইন করলে কাজ শেষে ব্রাউজিং হিস্টোরি থেকে মেমরি ডিলিট করে দেবেন।
৩. ২ স্টেপ ভেরিফিকেশন সুবিধা চালু করুন
আপনার অ্যাকাউন্ট সুরক্ষার অন্য আরেকটি উপায় হলো দুই স্টেপের ভেরিফিকেশন সুবিধা চালু করা। গুগল থেকে শুরু করে ফেসবুক, ড্রপবক্স, টুইটার সহ বেশিরভাগ কোম্পানির এই ২ স্টেপ ভেরিফিকেশন সুবিধা রয়েছে। ২ স্টেপ ভেরিফিকেশন এর বিষয়টা হলো আপনি যে ফোন নাম্বার দিয়ে আপনার অ্যাকাউন্ট খোলা বা সুরক্ষিত করা, প্রতিবার নতুন লগইনের সময় ঐ নাম্বারে চলে যাবে একটি এককালীন ব্যবহার যোগ্য কোড। এই কোড দিয়েই আপনি পারবেন নতুন করে লগইন করতে। এই ভেরিফিশনের সবচেয়ে বড় সুবিধা হচ্ছে আপনার আইডি, ইমেইল বা পাসওয়ার্ড চুরি হয়ে গেলেও ঐ কোড না পেলে লগইন করা যাবে না। তাই নতুন কোন সাইটে অ্যাকাউন্ট খোলার সাথে সাথে ২ স্টেপ ভেরিফিকেশন চালু করতে ভুলবেন না।
৪. ওয়েব ক্যামেরার উপর একটি স্টিকার লাগিয়ে রাখুন
আপনি যদি ল্যাপটপ ব্যবহারকারী হন তবে ল্যাপটপের ওয়েব ক্যামেরার ব্যাপারে সতর্ক থাকবেন। হ্যাকার থেকে শুরু করে দুষ্কৃতিকারীরা বিভিন্ন হ্যাকিং সফটওয়্যার দিয়ে ইন্টারনেটের মাধ্যমে আপনার ওয়েবক্যামকে ব্যবহার করতে পারে। তারা আপনার ওয়েবক্যাম দিয়ে ছবি তোলার পাশাপাশি ভিডিও রেকর্ড করতেও সক্ষম। শুনলে অবাক হবেন সারা পৃথিবী জুড়ে এরকম সাইবার অপরাধের জন্য অনেক পরিবারের ধ্বংস হয়ে গেছে। আপনি যদি একজন নারী ব্যবহারকারী হন তবে আপনাকে হতে হবে আরো সতর্ক। তাই দরকার না হলে আপনার ওয়েবক্যামের উপর স্টিকার লাগিয়ে রাখুন।
৫. আপনার ডিভাইসের ডিস্ক এনক্রিপশন চালু করুন
আপনি যদি আপনার ল্যাপটপ বা ফোন হারিয়ে ফেলেন এবং আপনার হারিয়ে যাওয়া ডিভাইসের ডিস্ক এনক্রিপশন চালু না থাকে, তবে যে ডিভাইসটি খুঁজে পাবে সে আপনার সমস্ত তথ্য উদঘাটন করে নিতে পারবে। এখানে বলে রাখা ভালো যে ডিস্ক এনক্রিপশন হচ্ছে ডিভাইসের হার্ড ডিস্কের অজ্ঞাত কোড নিয়ন্ত্রিত নিরাপত্তা সুবিধা। এই এনক্রিপশন চালু থাকলে অন্য কেউ আপনার ডিভাইস খুঁজে পেলেও কোড ছাড়া আপনার যন্ত্র ব্যবহার করতে পারবে না। আইফোন এবং আইপ্যাডে ডিস্ক এনক্রিপশনটি চালু করা থাকে। তবে উইন্ডোজ, অ্যানড্রয়েড, ম্যাক সফটওয়্যারে এ আপনাকে নিজে থেকে সেই সুবিধা চালু করে নিতে হয়। তাই নতুন ডিভাইস বা যন্ত্র কেনার পর পরই ডিস্ক এনক্রিপশন চালু করে নিন।
৬. আপনার টেলিফোন কল এবং টেক্সট বার্তা এনক্রিপ্ট বা সুরক্ষিত রাখুন
আমরা বর্তমানে মুঠোফোন ব্যবহার করি। বার্তা থেকে শুরু করে ফোন, ইমেইল ছবি আদান প্রদান কী না হচ্ছে পকেটের এই ক্ষুদে যন্ত্র দিয়ে। তেমনি এই ক্ষুদে যন্ত্র দিয়েই আপনার তথ্য চুরি করা সম্ভব হচ্ছে। আমরা টেলিফোন করতে বা বার্তা আদান প্রদানে ব্যবহার করি মোবাইল অপারেটরের ইন্টারনেট প্যাকেজ। এখন মোবাইলে অপারেটরের সব ইন্টারনেট প্যাকেজে বার্তা ভেঙ্গে ভেঙ্গে চলে যায় প্রাপকের কাছে। তাই যে কোনো সময়
যে কেউ এই সব তথ্য চুরি করতে পারে আপনার অজান্তেই।
এই ধরনের সাইবার অপরাধের জন্য খুব দামী প্রযুক্তির দরকার হয় না। সামান্য কিছু সস্তা প্রযুক্তি দিয়েই মোবাইল হ্যাক করা সম্ভব এখন। এখন তো সাইবার অপরাধীরা নিয়মিতভাবে অন্যের ফোনে আড়ি পাতছে। ক’দিন পর পর উচ্চপদস্থ ব্যক্তিদের স্কাইপি ফোনালাপ বের হচ্ছে নিয়মিতভাবে। তাই ফোনের ব্যাপারে সাবধানে থাকুন। তবে আজকাল বেশ কিছু সিকিউর প্রোগ্রাম যেমন হোয়াটস এপ কিংবা ফেইস টাইম এই অ্যাপগুলো বেশ সিকিউর। তাই তথ্য আদান প্রদানের ব্যাপারে সতর্ক হোন।