ফ্রিল্যান্সার বা মুক্ত পেশাজীবীদের সম্বন্ধে বেশ কিছু ভুল ধারণা সমাজে প্রচলিত আছে। আমাদের চিরাচারিত বাঙালী সমাজ ফ্রিল্যান্সারদের এখনও ভালোভাবে গ্রহণ করেনি। আরও সহজ করে বললে, মাসে লাখ টাকার বেশি রোজগার করা ফ্রিল্যান্সারের চেয়ে ৩০ হাজার টাকা বেতনের চাকরিজীবী ছেলে কন্যাকে বিয়ে দেওয়ার জন্য অভিভাবকদের বেশি পছন্দ। অভিভাবকরা কেন এমন ধারণা পোষণ করেন? এর উত্তরে বলা যায়, মানুষ নিজে যে ব্যাপারে ভালো ধারণা রাখে না, তাতে কখনোই বিশ্বাস রাখতে পারে না। আমাদের বেশিরভাগ অভিভাবক ফ্রিল্যান্সিং ব্যাপারটা বোঝেন না। তারচেয়েও বড় কথা তারা ফ্রিল্যান্সারদের কাজের কোনো নিয়শ্চয়তা পায় না।
ফ্রিল্যান্সারদের সম্বন্ধে এমন আরও বেশ কিছু ভুল ধারণা সমাজে প্রচলিত আছে, যা একদমই ঠিক না। চলুন জেনে নিই আরও বিশদভাবে।
বাসায় বসে কাজ
ফ্রিল্যান্সাররা সাধারণত নিজের বাড়িতে বসে কাজ করেন। ঘরে বসে কাজ করা অনেকে পছন্দ করেন না। বাড়িতে থেকে একজন কর্মজীবী মানুষের কাজ সঠিক বলে গণ্য করতে চান না অনেকে।
বাড়িতে বা অফিসে যেখানে বসেই কাজ করা হোক – এটি একটা আপেক্ষিক ব্যাপার। ফ্রিল্যান্সারদের সাথে ডিল করতে বা কাজ বুঝে নিতে যেহেতু স্বশরীরে কেউ মুখোমুখি সাক্ষাত করতে আসে না, তাই কাজের জায়গা এখানে মুখ্য না। একজন ফ্রিল্যান্সার বাংলাদেশ থেকে কাজ করেন, তার ক্লায়েন্ট হয়তো কোনো আমেরিকান। তিনি যোগাযোগ করেন অনলাইনে, কাজ বুঝে নেন অনলাইনে আবার পেমেন্টও দেন অনলাইনে। কাজেই কোথায় বসে, কোন পোশাকে কাজ করা হচ্ছে এটা মুখ্য নয়, বরং ফ্রিল্যান্সারের জন্য বাড়তি সুবিধা। তারা বাসাবাড়িতেই একটি নির্দিষ্ট জায়গা ওয়ার্ক স্টেশন হিসেবে ব্যবহার করে।
তবে কেউ কেউ ব্যক্তিগতভাবে কাজ না করে টিম গঠন করে কাজ করেন। সেক্ষেত্রে টিম মেম্বারদের বসার জন্য অফিসের প্রয়োজন হয়। সুতরাং, অফিস নেই তাই কাজ অগুরুত্বপূর্ণ, এটা ভাবার অবকাশ নেই।
রাতে কাজ
ফ্রিল্যান্সারদের প্রতি স্বাভাবিক মানুষ বিরাগভাজন হওয়ার আরও একটি কারণ রাত জেগে কাজ করা। রাত জেগে ফ্রিল্যান্সিং করার কারণ অনলাইনে বেশিরভাগ ক্লায়েন্ট মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ব্রিটিশ বা ইউরোপ আমেরিকার। এই সব দেশে যখন দিন তখন আমাদের দেশে মাঝরাত। সুতরাং কাজ দেওয়ার জন্য নিশ্চয় কেউ রাত জাগবে না, বরং কাজ নেওয়ার প্রয়োজন যার সেই রাত জাগবে এটাই স্বাভাবিক। তাছাড়া এইসব উন্নত দেশ থেকে তাদের দিনের বেলা ওয়ার্কপ্লেসে বেশি বেশি কাজ পোস্ট হয়। সুতরাং, ইচ্ছায় অনিচ্ছায় আমাদের দেশের ফ্রিল্যান্সারদের ভাল কাজ পাওয়ার জন্য রাত জাগতে হয়। তবে কিছুদিন পুরনো হলে ভালো কোনো ক্লায়েন্ট পেয়ে গেলে আর রাত জাগা লাগে না।
অনেকে আছেন দিনে কোথাও চাকরি করেন, আর রাতে কয়েক ঘন্টা ফ্রিল্যান্সিং করেন বাড়তি কিছু আয়ের জন্য। অনেক বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থীরা নিজের খরচ জোগাতে ফ্রিল্যান্সিং করেন, তাদের জন্য রাতই উত্তম সময়। কেননা, দিনে ক্লাস এবং পরীক্ষা থাকে। তাছাড়া, রাতে কাজ করতে হয় এমন অনেক চাকরি আছে আমাদের দেশে। তারা রাতে ডিউটি করলে যদি সেটা সমাজের চোখে দৃষ্টিকটু না লাগে ফ্রিল্যান্সাররা জাগলে কেন লাগবে?
কাজের নিশ্চয়তা
আপনি আগামীকাল বেঁচে থাকবেন এই নিশ্চয়তা দিতে পারবেন? নিশ্চয়ই না। সুতরাং, নিশ্চয়তার প্রসঙ্গও অনেকটা আপেক্ষিক। আমাদের দেশে একসময় বেসরকারি চাকরিকে এমন নিশ্চয়তাহীন চাকরি বলা হত। কয়েক বছর আগে বেসরকারী চাকরিও চাকরি বলে গণ্য হতো না। সরকারী চাকরি ছিল সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ ও নিশচয়তার। এখন এই ধারণা পাল্টে গেছে, কেউ আর বেসরকারী চাকরিকে অবমূল্যয়ন করে না। অল্প দিনের মধ্যেই ফ্রিল্যান্সিং নিয়েও এমন সংশয় কেটে যাবে।
যদিও একক ফ্রিল্যান্সারের জন্য কিছুটা ঝুঁকি আছে। যদি তার ওয়ার্ক প্রোফাইল কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়, সেক্ষেত্রে তাকে আবার নতুন করে শুরু করতে হতে পারে। নতুন প্রোফাইল তৈরি করতে হবে। এই ঝুঁকি ছাড়া দৃশ্যত আর কোনো ঝুঁকি নেই।
তবে যারা কাজ জানে তাদের অবারিত সুযোগ। ফ্রিল্যান্সিং ক্ষেত্রটা বিশাল পৃথিবীর মতো। এর মধ্যে যত ইলেকট্রনই দেওয়া হোক না কেন বিদ্যুৎপিষ্ট হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। তেমন কাজ জানা মানুষ যত কাজই হারাক না কেন, নতুন কাজের অভাব নেই।
সস্তা কাজ, সবাই পারে
ফ্রিল্যান্সারদের ব্যাপারে বলা হয়, তারা কোন চাকরি না পেয়ে এই কাজ করে। তাদের কাজ সহজ ও সস্তা। এই ধারণা একেবারে অমূলক। বরং বলা যায়, ফ্রিল্যান্সিং সাধারণ চাকরির চেয়ে অনেক কঠিন। কেননা, এখানে নিজের সৃজনশীলতার প্রমাণ রাখতে হয় প্রতিনিয়ত।
আত্মীয়তার রেশ ধরে একটি চাকরি জুটাতে পারলেই জীবন নিশ্চিন্ত। কিন্তু এখানে এমন আবদারের কোনো জায়গা নেই। যথার্থ কাজ শিখে তবেই এখানে সফল হতে হয়। কোনো শর্টকাট নেই। ফ্রিল্যান্সারদের কাজ করতে রোজ প্রতিযোগিতা করতে হয় অন্য ফ্রিল্যান্সারের সাথে।
সাধারণ চাকরিতে অনেক সময় দেখা যায়, একজন ইঞ্জিনিয়ার আর একজন সাধারণ গ্র্যাজুয়েট একই বেতনে একই পদে কাজ করছেন। কিন্তু ফ্রিল্যান্সিংয়ে যার যার যোগ্যতা, দক্ষতা অনুযায়ী রোজগার করতে পারেন। এখানে কাজ জানাটাই আসল।
আমার এমন ফ্রিল্যান্সারের সাথে পরিচয় আছে যারা মাসে চার পাঁচ লক্ষ টাকা আয় করেন ফ্রিল্যান্সিং করে। কাজেই ফ্রিল্যান্সারদের সম্বন্ধে ভ্রান্ত ধারণা আর নয়। সবচেয়ে বড় কথা ফ্রিল্যান্সাররা আয় করেন মার্কিন ডলার, যা সরাসরি বৈদেশিক মুদ্রা। কোনো রকম আর্থিক বিনিয়োগ বা পণ্যের বিনিময় নয়, নিজেদের মেধা ও দক্ষতার পরিচয় দিয়ে ফ্রিল্যান্সাররা আয় করছেন লক্ষ লক্ষ ডলারের বৈদেশিক মুদ্রা, যা দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে অসামান্য অবদান রাখছে।