ফিনল্যান্ড ইউরোপের সবচেয়ে উত্তরে অবস্থিত দেশগুলোর একটি। আমাদের অনেকের কাছে ফিনল্যান্ড নকিয়ার জন্মস্থান হিসেবে পরিচিত। নর্ডিক বা নর্দান ইউরোপিয়ান দেশগুলো তাদের উন্নতমানের জীবনযাপন, অপরূপ প্রকৃতি এবং উদার রাজনীতির জন্য যেমন পরিচিত, তেমনি তাদের শক্তিশালী শিক্ষাব্যবস্থার জন্য সমাদৃত।
প্রতি বছর বিভিন্ন দেশ থেকে অনেক শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষা ও প্রশিক্ষণ গ্রহণের উদ্দেশ্যে ফিনল্যান্ডে পাড়ি জমান। এদেশে সাক্ষরতার হার শতকরা ১০০ ভাগ।
ফিনল্যান্ডে পড়াশোনার জন্য দু’ধরনের বিশ্ববিদ্যালয় আছে। একটি হলো বিশ্ববিদ্যালয় বা ইউনিভার্সিটি আর অন্যটি ইউনিভার্সিটি অব এপ্লাইড সায়েন্স।
ফিনল্যান্ডের পড়াশোনা ভাষা দুটি ফিনিশ এবং সুইডিশ। কিন্তু দেশটির প্রত্যেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ইংরেজি কোর্স বাধ্যতামূলক হওয়ায় এখানের সবাই ইংরেজি ভাষার সাথে পরিচিত।
ফিনল্যান্ডের অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে উচ্চশিক্ষার জন্য ইংরেজি কোর্স রয়েছে। তবে বেশির ভাগ কোর্সই ফিনিশ কিংবা সুইডিশ ভাষায় পড়ানো হয়, বিশেষ করে ব্যাচেলর পর্যায়ে। তবে এপ্লাইড সায়েন্স ইউনিভার্সিটিতে ফিনিশ ভাষার পাশাপাশি ইংরেজি ভাষায়ও বেশ কয়েকটি ব্যাচেলর কোর্স রয়েছে। ভর্তির আবেদন করার আগে আপনি যে কোর্সটি করতে চাচ্ছেন তা ইংরেজি, সুইডিশ না ফিনিশ ভাষায় পড়ানো হয় তা জেনে নিতে হবে।
ফিনল্যান্ডে উচ্চশিক্ষার জন্য যেতে চাইলে ফিনিশ ভাষা শিখে নিলে আপনার জন্য ভালো হবে। কারণ আপনি যদি ফিনিশ কিংবা সুইডিশ ভাষায় পারদর্শী হয়ে থাকেন তাহলে ব্যাচেলর পর্যায়ে রয়েছে শিক্ষার অবারিত সুযোগ। এছাড়াও ফিনল্যান্ডের মানুষের সাথে ভালোভাবে মেলামেশা করা এবং চাকরি জন্য ফিনিশ ভাষার প্রয়োজন পড়ে।
এখানে স্নাতক পর্যায়ে ভর্তি হওয়ার জন্য ভর্তি পরীক্ষা দিতে হয় এবং ইংরেজি ভাষায় দক্ষতা থাকার প্রমাণ হিসেবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে টোফেল বা আইএলটিএস স্কোর প্রয়োজন হয়।
ফিনল্যান্ডের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য বিশ্ববিদ্যালয় হলো
- University of Helsinki
- Aalto University
- Arcada University of Applied Sciences
- Haaga-Helia University of Applied Sciences
- Helsinki Metropolia University of Applied Sciences
যেসব বিষয়ে পড়াশোনার সুযোগ রয়েছে
শিল্পকলার ইতিহাস, সামাজিক গবেষণা পদ্ধতি, অর্থনীতি, রাষ্ট্র ও সমাজ, গণতন্ত্র ও বৈশ্বিক পরিবর্তন উন্নয়ন অধ্যয়ন, গণমাধ্যম ও বিশ্ব যোগাযোগ, সংবাদমাধ্যম অধ্যয়ন, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যিক আইন, আন্তর্জাতিক গণআইন, মেডিকেল ফিজিক্স অ্যান্ড ক্যামেস্ট্রি, জনস্বাস্থ্য, প্যাথলজি, মহাকাশ গবেষণা, বায়োক্যামেস্ট্রি, খাদ্যবিজ্ঞান, খাদ্য রসায়ন, জীব-প্রযুক্তি, জৈব তথ্যপ্রযুক্তি, বাস্তুবিদ্যা, পরিবেশবিজ্ঞান, জীববৈচিত্র্য, জৈব রসায়ন ও রাসায়নিক বিশ্লেষণ, জৈব রসায়ন ও রাসায়নিক জীববিজ্ঞান, তড়িত তথ্যপ্রযুক্তি, ফলিত গণিত পরিসংখ্যান ইত্যাদি।
এবার চলুন জেনে নিই, যে ৬টি কারণে উচ্চশিক্ষার জন্য ফিনল্যান্ডকে বেছে নিতে পারেন-
১। উন্নত শিক্ষা ব্যবস্থা
ফিনিশ ডিগ্রির মান বেশ ভাল এবং এর গ্রহণযোগ্যতা পৃথিবী জুড়ে। ব্যাচেলর কোর্সের মেয়াদ ৩-৪ বছরের। এখানে মুখস্থ ভিত্তিক পড়াশোনা না করিয়ে ব্যবহারিক পড়াশোনা করানো হয়।
গ্রাজুয়েশনের সময় কেউ উপস্থিত না থাকতে পারলে তার বাসায় সার্টিফিকেট পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এখানে পাস করতে হলে শতকরা ৫০ শতাংশ মার্ক পেতে হবে।
অ্যাপ্লাইড সায়েন্স ইউনিভার্সিটিতে শিক্ষকদের নিয়োগ দেওয়া হয় মূলত স্বল্প সময়ের জন্য। এদের চাকরি নির্ভর করে শিক্ষার্থীদের মতামতের ওপর। একারণে সব সময় শিক্ষকেরা ভালো পড়াশোনা করানোর চেষ্টা করেন।
আর বিশ্ববিদ্যালয়ে শুধুমাত্র পিএইচডি ডিগ্রিধারীদের নিয়োগ দেওয়া হয় শিক্ষক ও গবেষক হিসেবে।
মাস্টার্স কোর্সের মেয়াদ সাধারণত ২ বছরের হয়। এখানে অনার্সেও থিসিস করতে হয়। ফিনল্যান্ডে এমবিএ করতে হলে কমপক্ষে তিন বছরের চাকরির অভিজ্ঞতা প্রয়োজন। কারণ এটা প্রফেশনাল ডিগ্রি। আর আমাদের দেশে যে এমবিএ করা হয় সেটা মূলত একাডেমিক ডিগ্রি।
ফিনল্যান্ডে পড়াশোনা করার জন্য শুধুমাত্র খাতা ও কলম ছাড়া আর কিছুই কিনতে হয় না, সব কিছু ফ্রি ব্যবহার করা যায়। সবাই ক্লাস শেষে লাইব্রেরিতে গিয়ে ক্লাসের অ্যাসাইনমেন্ট বা প্রজেক্ট ওয়ার্ক শেষ করে। প্রত্যেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই রয়েছে লাইব্রেরি। লাইব্রেরি থেকে যেকোনো বই বা জার্নাল ধার নেয়া যায়। তবে তা ১৪ দিনের ভেতর ফেরত দিতে হবে, অন্যথায় জরিমানা গুনতে হবে। লাইব্রেরিতে কোনো বই পাওয়া না গেলে, শুধুমাত্র লাইব্রেরিয়ানকে জানালেই হবে এবং কিছুদিনের মধ্যে বই হাজির হয়ে যাবে।
২। আবাসনের সুবিধা
এদেশে শিক্ষার্থীদের থাকার জন্য হোস্টেল আছে। বেশিরভাগ শিক্ষার্থীরা এ ধরনের হোস্টেলে বসবাস করে। আর হোস্টেলগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছাকাছি হওয়ায় যাতায়াত খরচ অনেকটা কমে যায়।
৩। কাজের সুযোগ
অর্থনৈতিক দিক দিয়ে ফিনল্যান্ড পৃথিবীর অন্যতম একটি সবল দেশ। এখানে শিক্ষার্থীদের জন্য রয়েছে কাজ করার প্রচুর সুযোগ, যা ইউরোপের অন্যান্য দেশের তুলনায় নিঃসন্দেহে অনেক ভালো। এখানে শিক্ষার্থীরা সাধারণত সপ্তাহে ২০ ঘণ্টা কাজ করার সুযোগ পেয়ে থাকে। সেই সাথে বন্ধের সময় ফুল টাইম কাজ করতে পারে।
৪। নিরাপদ শহর
বিশ্বের নিরাপদ দেশের তালিকায় ফিনল্যান্ডের অবস্থান ছয় নাম্বারে। এখানে অপরাধের মাত্রা খুবই সীমিত।
৫। বিশ্বের সবচেয়ে সুখী দেশ
জাতিসংঘের জন্য তৈরি হ্যাপিনেস রিপোর্ট প্রকাশ করেছে সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট সলিউশনস নেটওয়ার্ক। ২০১৫ সাল থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত পৃথিবীর ১৫৬টি দেশ থেকে সংগ্রহ করা তথ্যের ভিত্তিতে এই বছরের প্রতিবেদন তৈরি হয়।
এই প্রতিবেদনে ছয়টি তথ্যকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছিল। এসব তথ্য হলো, একটি দেশের জনগণের আয়, স্বাধীনতা, বিশ্বস্ততা, আয়ু, সামাজিক সহযোগিতা এবং উদারতা। এসব তথ্যের ভিত্তিতেই ফিনল্যান্ডকে সবচাইতে সুখী দেশ হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়েছে এ বছর।
৬। আকর্ষণীয় স্থান
ফিনল্যান্ড শহরের পরতে পরতে ছড়িয়ে আছে সৌন্দর্য। এই দেশে সবকিছু আছে, যেমন- সুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্য, বিশাল সমতলভূমি, পরিষ্কার এবং আকর্ষণীয় শহর, আকর্ষণীয় ল্যাপল্যান্ড।
ফিনল্যান্ডের আকর্ষণীয় স্থানসমূহ হলো,
হেলসিংকি
ফিনল্যান্ডের রাজধানী হেলসিংকি৷ এই বন্দর শহরের স্থাপত্যশৈলি, অনেক রেস্তোরাঁ আর বারের জন্য জনপ্রিয়।
সুমেরুপ্রভা
পরিষ্কার আকাশে অরোরা বা সুমেরুপ্রভা দর্শন এক রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা৷ ফিনল্যান্ডের উত্তরাঞ্চলের ল্যাপল্যান্ডে বছরের ২০০ রাতেই সুমেরুপ্রভার দেখা যায়৷
সওনা
সওনা বা বাষ্প স্নানাগার ফিনল্যান্ডবাসীদের জীবনের অংশ৷ ফিনল্যান্ডের প্রায় প্রতিটি জায়গায় আপনি সওনা পাবেন৷
শৈল উপকূল
ফিনিশ এই উপকূলটি দেশটির দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত৷ লাখো ছোট ছোট পাথুরে দ্বীপ রয়েছে সেখানে৷
Featured Image: worldtravelguidlines.net