আমরা কেউই কোনোরকম বিপদে পড়তে চাই না। কবে কখন কার কোন বিপদ আসে বলা যায় না। তাই আগে থেকে যদি নিজেদের প্রস্তুত রাখা যায় তবে বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে জীবন বাঁচানো সম্ভব হয়। আজ জানা যাক এমনই কিছু কৌশল যা আপনাকে এই ৭ ধরনের বিপজ্জনক পরিস্থিতি থেকে বাঁচাবে।
১. বিল্ডিং বা পাহাড়ের ভাঙা অংশের নিচে আটকা পড়লে
রানা প্লাজার সেই মর্মান্তিক দুর্ঘটনার কথা ভোলেননি নিশ্চয়ই। ভূমিকম্প, ভূমিধ্বস বা নির্মাণে ত্রুটির জন্য এ ধরণের দুর্ঘটনা আমাদের দেশে প্রায়ই ঘটছে। তাই জীবন বাঁচাতে জেনে রাখা দরকার কোনো বিল্ডিং এর ভাঙা অংশের নিচে আটকা পড়লে বা কোনো পাহাড়ে ঘুরতে গিয়ে পাহাড়ের গুহায় বা বড় পাথরের নিচে আটকা পড়লে কী করা উচিত। এ ধরণের পরিস্থিতিতে সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো অক্সিজেনের স্বল্পতা। তাই চেষ্টা করতে হবে ঐ অক্সিজেনের সর্বোচ্চ ব্যবহার করে জীবন রক্ষা করা।
এরকম সংকীর্ণ জায়গায় আটকা পড়লে আগুন বা ম্যাচ জ্বালানো যাবে না। এতে অক্সিজেনের পরিমাণ কমে যাবে। গভীরভাবে প্রশ্বাস নিয়ে ধীরে ধীরে নিঃশ্বাস ছাড়তে হবে। এতে যেটুকু অক্সিজেন ঐ বাতাসে থাকবে সেটাই অনেকক্ষণ আপনাকে বাঁচিয়ে রাখবে। ভয়ে বা উত্তেজনায় চিৎকার করলে নিজেরই ক্ষতি। এতে আপনার হার্টবিট বেড়ে শ্বাস-প্রশ্বাসও বাড়িয়ে দেবে। অপেক্ষা করুন। আশেপাশে উদ্ধারকর্মী বা কারোর আওয়াজ পেলে তখন চিৎকার করুন। যদি সম্ভব হয় তবে জামা খুলে মুখটা জামা দিয়ে পেঁচিয়ে নিন। এতে ধুলা ও বিষাক্ত গ্যাস সহজে ক্ষতি করতে পারবে না।
২. হিংস্র জন্তুর সামনে পড়লে
আপনি একা হেঁটে যাচ্ছেন, রাস্তায় পিছু নিচ্ছে একটি আবার কখনো একপাল কুকুর। এমন মানুষ পাওয়া যাবে না যার সাথে একবারও এরকম হয়নি। গ্রামের নির্জন রাস্তায় আপনাকে একা পেলে একপাল শেয়াল ঘিরে ধরলেও অবাক হওয়ার কিছু নেই। অথবা বন-জঙ্গলে ঘুরতে গিয়ে সামনে পড়তে পারে বুনো জন্তু এমনকি বাঘও। সামনের কুকুর-শেয়াল অথবা জন্তুটি যদি হিংস্র হয় এমন পরিস্থিতিতে কী করা উচিত তা জানা থাকলে জন্তুর আক্রমণ বা আঘাত থেকে নিজেকে বাঁচাতে পারবেন কোনো প্রকার অস্ত্র ছাড়াই।
প্রথমে যে ব্যাপারটা করবেন তা হলো, কখনোই পেছনে ঘুরে পালাবেন না। এতে জন্তুটিও আপনার পিছু নিবে। আর জন্তু যদি পাল সহ থাকে তবে দৌড়ে পালানোর চিন্তাটা একেবারেই হবে নিজের পায়ে কুড়াল মারার সমান। যদি শেয়াল বা বুনো জন্তুর পাল আপনার সামনে থাকে চেষ্টা করুন কোনো ঝোপের আড়ালে যেতে বা কাছাকাছি কোনো গাছে উঠে পড়তে। জন্তুর পাল আপনাকে ঘিরে ফেললে আপনার জন্য বের হওয়া মুশকিল হয়ে যাবে। জন্তু যদি নিজে থেকে আক্রমণ না করে, তবে আঘাত করে বা কিছু ছুঁড়ে মেরে উত্তেজিত করবেন না। বরং চেষ্টা করুন জন্তুর চোখে চোখ রাখতে আর এই ফাঁকে এক পা এক পা করে পিছিয়ে যেতে।
হাতের কাছে ছাতা থাকলে মেলে ধরা যেতে পারে, আর লাঠি থাকলে আঘাত না করে চোখে চোখ রেখে লাঠির ভয় দেখান আর পিছাতে থাকুন। জন্তুর থেকে কিছুদূর পিছিয়ে এলে সুযোগমতো পালাতে পারবেন। সামনে হিংস্র জন্তু এসে পড়লে বা আঘাত করতে চাইলে চিৎকার করুন যত জোরে আর যত হিংস্রভাবে পারেন। এতে কিছুটা হলেও জন্তুটি বাধা পাবে। মোট কথা, যতটুকু সম্ভব মাথা ঠান্ডা রেখে জন্তুর মোকাবিলা করলে সমস্যা থেকে বেঁচে যাবেন সে যাত্রায়।
৩. পানিতে ডুবলে
জলযানে নিয়মিত যাতায়াত যারা করেন তাদের পানিতে নামার আগে প্রত্যেকেরই উচিত সাঁতার শিখে নেওয়া। শখের বশে পানিতে নেমে অথবা জলযান ডুবে প্রতি বছর প্রাণ হারানো মানুষের সংখ্যা কিন্তু কম নয়। এর মধ্যে অনেকের সাঁতার জানা থাকে না আবার ডোবার সময় অনেকে বিভিন্নভাবে আহত হন। ফলে সাঁতার জানলেও ঐ অবস্থায় নিজের জীবন বাঁচানো কঠিন হয়ে পড়ে। পানিতে ডুবলে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হচ্ছে শ্বাস নিয়ন্ত্রণ। যেহেতু পানিতে ভেসে থাকতে প্রচুর শক্তির ব্যয় হয়, তাই গভীরভাবে শ্বাসের মাধ্যমে বেশি করে অক্সিজেন নিতে হবে আর ছাড়তে হবে ধীরে ধীরে। সাঁতার জানা থাকে তো ভালো না থাকলেও চেষ্টা করতে হবে হাত বা পায়ের নড়াচড়ার মাধ্যমে কোনোভাবে ভেসে থাকার। আশেপাশে ভেসে বেড়ানো কোনো অবলম্বন যদি পান তবে সেটিও ভাসতে সাহায্য করবে।
যদি অগভীর পানিতে থাকেন, তবে ডুব দিয়ে তল ছুঁয়ে দুই পা দিয়ে পানির তলের মাটিতে যত জোরে সম্ভব ভর দিয়ে তীর বরাবর উপরের দিকে লাফ দিতে হবে। এতে করে আস্তে আস্তে তীরের দিকে আগানো যাবে। আর গভীর পানিতে থাকলে পা গুটিয়ে বুকের কাছে এনে আবার দূরে সরিয়ে সাঁতার দিতে হবে।
৪. সাপে কাটলে
শীতে হাইবারনেশনের জন্য সাপ কম দেখা গেলেও গ্রীষ্ম ও বর্ষাকালে আমাদের উপমহাদেশে সাপের ব্যাপক উপদ্রব দেখা দেয়। এই সাপগুলোর বেশিরভাগই বিষাক্ত। ঘরের কোণে, ঘাস-লতার আড়ালে বা পানিতে লুকিয়ে থাকা সাপের ছোবলে আমাদের দেশে বছরে গড়ে প্রাণ হারায় প্রায় ১৫০ জন মানুষ। তাই জেনে রাখা দরকার সাপে কামড়ালে কী করতে হবে।
সাধারণত সাপে কামড়ালে সেখানে ব্যাথা শুরু হয়। আস্তে আস্তে ব্যাথার পরিমাণ যেমন বাড়ে তেমনি ঐ স্থানে চামড়ার রঙ বিষ ছড়িয়ে পড়ার কারণে লাল বা নীল হয়ে যায়। কিছুক্ষণের মধ্যেই জায়গাটা ফুলে আরো নীলচে হয়ে যায়। আক্রান্ত ব্যক্তির প্রচন্ড মাথাব্যাথা শুরু হয়, দেহের তাপমাত্রা বেড়ে যায়, বমি বমি ভাব হয় এমনকি অজ্ঞান হয়ে যায় দ্রুতই। তাই যদি বোঝা যায় কাউকে সাপে কামড়েছে, দ্রুত চেষ্টা করতে হবে হাসপাতালে নিতে। কিন্তু সবসময় তা সম্ভব হয় না। তখন প্রথমে যে কাজটা করতে হবে তা হলো বিষ যাতে ছড়িয়ে না পড়তে পারে সেটা নিশ্চিত করতে হবে।
কামড়ের স্থান থেকে একটু উপরে দড়ি বা কাপড় শক্ত করে বেঁধে দিতে হবে যাতে বিষ বেশি দূর না ছড়ায়। আরেকটি কাজ করা যেতে পারে তা হলো অন্য কেউ আক্রান্ত স্থান থেকে মুখ দিয়ে চুষে বিষ যদি বের করতে পারে। যদিও কাজটা খুবই বিপজ্জনক তবুও সাবধানতার সাথে বিষ বের করা ছাড়া আক্রান্ত ব্যক্তিকে বাঁচানো কঠিন হয়ে যায়। একবার মুখ দিয়ে ২-১ সেকেন্ড চুষে ঐ তরল ফেলে মুখ ধুয়ে নিতে হবে ভালোভাবে। এভাবে প্রাথমিকভাবে ব্যবস্থা নিলে সাপের কামড়ের প্রভাব অনেকখানি কমিয়ে আনা যায়। এরপরও চেষ্টা করতে হবে হাসপাতালে নিয়ে দ্রুত বিষ বের করতে।
৫. হিংস্র জন্তুর কামড় খেলে
বন্ধুর পোষা বিড়ালকে আদর করতে গেলেন, রেগেমেগে দিলো এক আঁচড়। অথবা রাস্তায় পাগলা কুকুরের খপ্পরে পড়ে কামড় খেয়ে ক্ষতের দেখা দিলো। তখন কী করবেন? এটা নিশ্চয়ই জানেন জন্তুর কামড় থেকে জলাতঙ্ক সহ নানান প্রাণঘাতী রোগ হতে পারে। এটা ভেবে উত্তেজিত না হয়ে ভালভাবে খেয়াল করুন কোথায় কোথায় আঘাত লেগেছে।
যদি রক্ত পড়ে পরিষ্কার কাপড় দিয়ে চেপে রক্ত পড়া বন্ধ করতে হবে সবার আগে। তারপর গরম পানি দিয়ে জায়গাটা ভালোভাবে ধুয়ে ফেলুন। এরপরে এন্টিসেপটিক লাগান আক্রান্ত স্থানে, নয়তো দ্রুত ইনফেকশন ছড়াতে পারে। প্রাথমিকভাবে এই ব্যবস্থাগুলো নিয়ে হাসপাতালে যান ভ্যাক্সিনের জন্য। তবে আক্রমণকারী জন্তুটি যদি কোনো রোগে আক্রান্ত বা হিংস্র হয়, তবে আপনার আঘাতের স্থানের রক্ত পড়া বন্ধ হতে চাইবে না। আক্রান্ত স্থানে রক্ত জমে ফুলে লাল হয়ে থাকবে। বেশি দেরি করলে জলাতঙ্ক হতে সময় লাগবে না। তাই এই প্রাথমিক ব্যবস্থাগুলো নিয়ে যত দ্রুত সম্ভব হাসপাতালে যাওয়া উচিত।
৬. যেকোনো কাঠে আগুন ধরানো
পাথর ঘষে আগুন জ্বালানোকে ধরা হয় পৃথিবীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার। খাদ্যের জন্য হোক আর রাতে আলো বা নিরাপত্তার জন্যেই হোক আগুন অপরিহার্য একটি ব্যাপার। হাতের কাছে কাঠ বা কাগজ পেলে তো জ্বালানোই যায় আগুন। কাঠটি যদি ভেজা হয় তবে আগুন ধরানো হয়ে যাবে অসম্ভব ব্যাপার। ভেজা কাঠ জ্বালানোর এক দারুণ পন্থা হলো সুইডিশ টর্চ পন্থা।
বনে জঙ্গলেই যাদের বসতি কিংবা যাদের কাজের জন্য প্রচুর কাঠ পোড়াতে হয় তাদের কাছে বেশ জনপ্রিয় এই পদ্ধতি। ভেজা কোনো গাছের ডাল, গুঁড়ি বা যেকোনো কাঠকে খাড়াভাবে ৪-৫ ভাগে ভাগ করতে হবে। ঠিক যেন কাঠ কেটে তারা আঁকছেন এমন। এরপর ঐ কাটা অংশের মধ্যে শুকনা খড়, পাতা বা কাগজ দিয়ে আগুন ধরাতে হবে। এভাবে কাঠটি ভেজা থাকলেও আস্তে আস্তে এটি পুড়তে শুরু করবে। বর্ষাকালে এই পদ্ধতি দারুনভাবে কাজে দেয় যদি আপনি রান্নার কাজে কাঠ ব্যবহার করে থাকেন।
৭. যেকোনো বিপদ এড়াতে সারভাইভাল বক্স
বিপদ বলে কয়ে আসে না। তাই সবসময় কাছে একটি সারভাইভাল বক্স রাখা উচিত। নিজের বিপদে তো বটেই, এগিয়ে যেতে পারবেন অন্যের বিপদে। একটা ছোট্ট বাক্সে- ম্যাচ বাক্স, অ্যালুমিনিয়াম ফয়েল, একটি ব্লেড বা ছুরি, একটি ব্যান্ড এইড, একটি বড়শির হুক, প্রয়োজনীয় কয়েকটি ঔষধ, কম্পাস, মোমবাতি, সুতা, ইনজুরি টেপ, কয়েকটা টিস্যু নিলেন। ব্যস! হয়ে গেলো আপনার সারভাইভাল বক্স। তবে আপনার প্রয়োজন অনুসারে যোগ করতে পারেন আরো কিছু। যেকোনো বিপদে বাক্সের জিনিসগুলোই আপনাকে অনেকখানি সাহায্য করবে জীবন বাঁচাতে।