মায়ের সাথে লুকোচুরি – ভুইয়া মাহবুব লতিফ

0

গল্প/উপন্যাস তো দূরের কথা, লেখার অভ্যেস আমার কখনোই ছিলোনা। কিন্তু জার্মানীতে অবস্থানরত আমার শ্নেহের একজনের পীড়াপীড়িতেই কিছু লিখার চেষ্টা। আর লিখাটা যখন মাকে নিয়ে – কি লিখবো, কোথা থেকে শুরু করবো, তা ঠিক বুঝে উঠতে পাচ্ছিলাম না। বিষয়টা যেমন ব্যাপক, তেমনই কঠিন – কি যেন কি লিখি – মাকে না আবার খাটো করে ফেলি !

আমার জীবনে মার প্রভাব ব্যাপক। যেমন, আমি দেখতে মা’র মত, মার পছন্দের খাবার গুলো অনেকটা আমার খাবার – শুধু গরুর মাংশ ছাড়া। একদিন মাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম “মা আমি গরুর মাংস খাইনা কেন”? উত্তর ছিল “ছোট সময় থেকে তোরে দিলেও, খাইতি না — এই রকম কইরাই তোর না খাওনের ওব্বাস”। মার কিছু রোগও আমি পেয়েছি যেমন বুক-জালা/গ্যাস্ট্রিক, গায়ে এলার্জি, মাথা বেথা/সাইনাসের বেথা ইত্যাদি। মার রাগও কিন্তু কম পাইনি – যেমন প্রচন্ড রাগে হাতের কাছে কিছু থাকলে, তার উপর দিয়ে চালিয়ে দেওয়া। মা’র যে জিনিসটি আমি সবচাইতে বেশী পেয়েছি – তাহলো প্রচন্ড আবেগ। মনে পড়ে, ছোট সময় যখন মার সঙ্গে মহিলা সিটে সিনেমা দেখতাম (জানিনা এখন কি ব্যবস্থা, আমাদের সময় ৯/১০ বছরের ছেলেরা মা/বোনদের সঙ্গে মহিলা বক্সে সিনেমা দেখার অনুমতি ছিল), বিশেষ করে দুঃখের সিনেমা বা দুঃখের দৃশ্যে দুজনেই রীতিমত কান্নার প্রতিযোগীতায় নেমে পড়তাম। মা তার রূমাল দিয়ে বার বার আমার চোখ মুছে দিতেন। মনে আছে, নবম শ্রেনীতে স্কুলের বার্ষিক নাটকে ভিলেনের চরিত্রে সাবলিল অভিনয়ের সময় শত শত দর্শকের বিরূপ মন্তব্য মিললেও, দর্শকের আসনে বসা মা’র সমর্থন আমি নাটকের শেষ দৃশ্য পর্যন্ত পেয়েছি। আর শেষ দৃশ্যে যখন আমাকে বধ করা হলো, সমস্থ দর্শকের উল্লাস সত্যেও মার কান্নার আওয়াজ আমি মঞ্চ থেকেই পেয়েছিলাম !

মা’কে মনে করতে গিয়ে এই মূহুর্তে ছোটবেলার কিছু ঘটনা মনে বাজছে । বাবা দীর্ঘদিন যাবত রাজনৈতিক হত্যা মামলায় ফেরার। জমানো টাকা শেষ, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান হাতাছাড়া, জমিজমা চাষ করা হচ্ছে না দীর্ঘ দিন – কেউ বর্গাও নিচ্ছে না মাসের পর মাস। চারিদিকে অভাব আর অভাব। মা চেয়েচিন্তে কোন রকমে সংসারের ঘানি টানছেন। একবেলা খাইতো অন্যবেলা উপোস। নিয়মিত স্কুলে যাওয়াও হতো না। ৮ বছরের শিশু, তৃতীয় শ্রেনীর ছাত্র যে বয়েসে মার বুকে ঘুমানোর কথা, গল্প শুনার কথা – অন্ন আর পড়াশুনার কথা ভেবে, মুক্তাগাছায় বাবার এক বন্ধুর বাসায় জায়গীর রেখে আসলেন মা আমাকে! ভর্তি করালেন পৌরসভা সংলগ্ন একটি প্রাইমারী স্কুলে। সেদিন দেখেছিলাম, মা কত কষ্ট বুকে নিয়ে চোখের জলে আঁচল ভিজিয়ে রেখে এসেছিলেন আমায়! মনে পড়ে, প্রতিমাসের আমাকে দেখতে যাওয়ার নির্দিষ্ট দিনগুলোতে – কি আনন্দেই না কাটতো । মা এটা/সেটা আমার পছন্দের খাবারগুলো কিনে নিয়ে যেতেন। সারাদিন গল্প করতাম, কে কি বলেছে – কি কি করেছি ইত্যাদি ইত্যাদি। বিদায় বেলা মা আমাকে বুঝিয়ে/সুঝিয়ে রওয়ানা দিলেও, আমি বাড়ীর পিছন দরজা দিয়ে বের হয়ে তার পিছু পিছু বাস-ষ্ট্যান্ড পর্যন্ত অনুসরণ করতাম। উনি আমাকে দেখে ফেলবেন ভেবে, আমি রাস্তা ছেড়ে খেতের আইল ধরে উনার দৃষ্টির আড়ালে সামনে এগুতাম। আর বাস ছেড়ে দেওয়ার পর, ফেরার পথে কোন গাছের নিচে বসে দীর্ঘক্ষন অজোরে কাঁদতাম। যে বাসায় থাকতাম, তাদের অনেকগুলো ছেলেমেয়ের বড় সংসার – তাদেরই খাবার জুটতো না ঠিকমত, তারপরের ওরা যা খেত আমাকেও তাই খেতে দিত। মনে পড়ে, বিচি কলা দিয়ে দুটো রুটি – গলা দিয়ে নামতো না, পানি দিয়ে গিলে ফেলতাম। মা মাঝে মাঝে জানতে চাইতেন, আমাকে কি খেতে দেন? মা কাঁদবে ভেবে কখনো এগুলো বলতাম না।

মনে পড়ে ষষ্ঠ শ্রেনীতে স্কুলের হোস্টেলে থাকাকালীন, পালিয়ে কতবার যে বংশাই পার হয়ে মার সঙ্গে ঘুমিয়েছি। পরের দিন সকালে হোস্টেল সুপার-কাম-শিক্ষকের ভয়ে আমি যখন জড়সড়, আমাকে অভয় দিয়ে মা বলতো – “রশীদরে সকালে আমি ঢাইকা আইনা বইলা দিমুনি, আমি ওরে কুলে/কাহে নেই নাই? ওর এত আস্পর্ধা, আমার বাবারে কিছু কয়?” যখন ময়মনসিংহ আনন্দ মোহন কলেজে হোষ্টেলে থেকে পড়তাম, মা কতই না ব্যতিব্যস্ত ছিলেন আমার খাওয়া নিয়ে। হোষ্টেলে পিয়নের স্ত্রীকে বোন বানিয়ে, তাকে দিয়ে আমার স্পেশাল ঝাল ছাড়া খাওয়ার ব্যবস্থা করিয়েছেন প্রায় দুবছর। রাজশাহীতে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার সময়ও গিয়ে হাজির হয়েছেন হোষ্টেলে — কি খাচ্ছি, কেমন আছি জানতে।

দেশ ছেড়েছি প্রায় ১৬ বছর, প্রতি দু’বছর অন্তর দেশে যাই । নিয়মিত দেশে যাওয়াটা মধ্যপ্রাচ্য থেকে সহজ হলেও, সুদুর কানাডা থেকে একটু কঠিনই হয়ে যায়। তবুও মা’র পীড়া-পীড়িতে ২০১২ সালে জানুয়ারীতে পরিবারের সবাইকে নিয়ে দেশে যাই। মার ইচ্ছে ছিল আমার ছোট বাচ্চাটাকে দেখার। স্কাইপিতে কথা এবং দেখায় যেন তার মন ভরতে ছিলোনা । দু’মাসের ছুটি, খুবই আনন্দে কেটেছে – কখন যে শেষ হয় গেছে বুঝতেই পারিনি। ১৩ মার্চ ফিরতি ফ্লাইট, প্রতিবারের মত যাওয়ার দিন কাছে আসলে যা হয় – মা ভাই/বোন, ভাবীর কান্না শুরু। তবে, বরাবরের মত আমার কঠোর নির্দেশ, বেশী লোক যেন বিমান বন্দর না যায় – আর মা তো নয়-ই। কিন্তু এবার কেন যেন আর মানা করিনি। মা কাঁদতে কাঁদতে বিদায় দিতে আসলেন – শুধুই কান্না আর কান্না। এ যেন সেই ছোট সময়ে মায়ের বিদায় বেলা আমার কান্না । পার্থক্য শুধু একটাই – সেই সময় দুজনেই কাঁদতাম, আর এমূহুর্তে শুধু মা একা। বিদায়ের সময় মা বরাবরের মত বলতেছিলেন – “তুমি আর মনে অয় আমারে দেখতে পারবানা না, আমার জন্য দোয়া কইরো বাবা” — আমি বললাম “এগুলো কি বলেন? হায়াত মউত আল্লার হাতে, এটা বয়স মানে না।” — আমি হেসে বলি “আপনিতো প্রতিবারই বলেন, আপনি হয়তো বাঁচবেন না”। মা বললেন -“হে সব বারেই কই – কিন্ত এইবার টা আলাদা, তুমি দেইখো এইবার আমাকে আর পাবা না”। ——– যাহোক, চেক-ইন করার পর আবার একা বের হয়ে আসলাম। পা ছুঁয়ে সালাম করে ভিতরে ঢুকতে যাবো মা বলে উঠলেন “নাইমাকে আবার একটু দেহাইলা না?” – আমি বললাম “ওদেরকে ইমিগ্রেশনের দরজায় রেখে এসেছি, এখন তো সময় নাই – হাতে অনেকগুলো ব্যাগ। কিছুক্ষন আগেই তো দেখলেন, দোয়া করেন ওদের জন্য।” বুঝিয়ে ঘুরে হাটতে শুরু করলাম। মনটা যেন কেমন অস্থির লাগতেছিল, মনে হচ্ছিল মা’র চোখগুলো আমাকে অনুসরণ করছে, আমার পিঠে আছরে আছরে পড়ছে । ইমিগ্রেশনের দরজায় ঢুকার মূহূর্তে স্ত্রী বললাম – “দুই মিনিট, নাইমাকে দাও – আমি এখনি আসছি।” বলেই এক দৌড়ে চলে আসলাম মার কাছে। মা আদর করলেন, দোয়া করলেন। – ফিরে এলাম, একবারের জন্য আর পিছন ফিরে তাকাইনি। তাকালে হয়তো ধরা পড়ে যেতাম, কারন ঐ মূহূর্তে আমার কাছে রূমাল বা মা’র আঁচল কোনটাই ছিল না।

১৩ তারিখ রওয়ানা দিয়ে ১৪ তারিখ টরোন্টো পৌঁছলাম। ০৪ দিন বাসায় আরাম করে দিন/রাত্রির পার্থক্যের ধকল কাটিয়ে ১৯ তারিখ অফিস শুরু করলাম । অফিস থেকে ফিরে আসার কয়েক মিনিটের মাথায় আমার জীবনের দ্বিতীয় এবং চরম শোকের সংবাদটি শুনলাম। মূহুর্তেই অনুভব করলাম, দুটি অশ্রুসজল অতৃপ্ত চোখ আমাকে খুজছে, আমাকে অনুসরণ করছে। আমি আমার হৃদয়ের সীমানায় যতদূর দৃষ্টি যায়, মাকে খুঁজতে লাগলাম – কিন্তু কোথাও পেলাম না ! এখন আর শুধুই বিমানে উঠে আমাকে চোখ মুঁছতে হয় না। এ কাজটি করতে হয় কখনো গাড়ী চালাতে, কখনো মাঝরাতে উঠে, কখনো বা বাথরুমে – সবার অগোচরে, যখনই কানে বাজে “বাবা, বলেছিলাম না, এইবারের টা আলাদা”।

(শুধূই প্রার্থনা–” রাব্বির হাম হুমা কামা রাব্বা ইয়ানি ছাগিরা” হে প্রভু, আমার পিতা-মাতাকে ভাল রেখ, শান্তিতে আদরে সূখে রেখ, যেভাবে তারা আমাদেরকে রেখেছেন আমাদের শৈশবে; কিংবা তারচেয়েও অনেক অনেক বেশি।)

ভুইয়া মাহবুব লতিফ, টরোন্টো, কানাডা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *