দ্রুত শিখতে চান নতুন বিষয়? অনুসরণ করুন ফাইনম্যান টেকনিক

0

নোবেলজয়ী পদার্থবিদ রিচার্ড ফাইনম্যানের নাম শুনেছেন? কোয়ান্টাম মেকানিক্সের দূর্বোধ্য আর কঠিন বিষয়গুলোকে এই বিজ্ঞানী করে তুলতে পারতেন আকর্ষনীয়। ছাত্রদেরকে কঠিন বিষয়গুলো শেখাতে জুড়ি ছিলো না তার। তাই ফাইনম্যানের দুর্দান্ত সব লেকচার শোনার জন্যে অন্য বিষয়ের ছাত্ররাও হাজির হতেন তার ক্লাসে। ২০১৬ সালে ফাইনম্যানের নোবেল প্রাপ্তির ৫০ বছর পূর্তিতে বিল গেটস তার ব্লগে ফাইনম্যানকে তার জীবনের সেরা শিক্ষকদের একজন বলে উল্লেখ করেন। এমনই ভাবে শত ছাত্রের মুগ্ধতায় জড়িয়ে আছেন এই বিজ্ঞানী।

ছবিঃ নোবেলজয়ী পদার্থবিদ রিচার্ড ফাইনম্যান; ছবিসূত্রঃ curiosity.com

কিন্তু ঠিক কীভাবে রিচার্ড ফাইনম্যান এত দ্রুত কোনো কঠিন বিষয় শেখাতে পারতেন ছাত্রদেরকে? যেকোনো জিনিস দ্রুত শিখে আত্মস্থ করে নিতে ফাইনম্যান একটি পদ্ধতি ব্যবহার করতেন। আর ৪ ধাপের এই পদ্ধতিটি পরিচিত ‘ফাইনম্যান টেকনিক’ নামে। ফাইনম্যান টেকনিক ব্যবহার করে যেকোনো তথ্য অনেক দ্রুত আর কার্যকরীভাবে আত্মস্থ করার বেশকিছু প্রমাণও আছে। তাই এই পদ্ধতিটি শিক্ষার্থী তো বটেই শিক্ষকদের কাছেও বেশ জনপ্রিয়।

বিষয়টি বাছাই করুন

কিংবদন্তী পদার্থবিদ ফাইনম্যান যখন প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যলয়ের ছাত্র তখনই মূলত তিনি তার এই পদ্ধতি উদ্ভাবন করেন। এর ৪ ধাপের প্রথম ধাপটি হলো বিষয়টি বাছাই করা এবং পড়া শুরু করা। আলাদা খাতা বা নোটবুক তৈরি করে বিষয়টির ব্যপারে যা যা জানছেন বা শিখছেন তার সবকিছু লিখে ফেলুন। এমনকি নিজে কী চিন্তা করছেন তাও লেখা শুরু করুন। মূলত এটিই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। ফাইনম্যান বলতেন, “আমি যেকোনো বিষয়ের ব্যাপারে জানতে চাইলে সে বিষয়ে লেখা শুরু করতাম। যখনই দেখছি আমি এই বিষয়ে আর কিছু লেখতে পারছি না আমি আবার পড়া শুরু করতাম। পড়তে ভালো না লাগলে আবার লেখা শুরু করতাম”। তাই দেরি না করে যে বিষয়টি জানতে চান লেখা শুরু করুন। আটকে গেলে আবার পড়ুন।

যেকোনো বিষয় জানতে পড়ার কোনো বিকল্প নেই; ছবিসূত্রঃ Medium.com

পড়া শেষে আবার লেখতে বসে যান। এভাবেই যেকোনো নতুন বিষয়ে নিজের হাতেখড়ি করুন। পথে না নামলে যেমন পথকে চেনা যায় ঠিক তেমনি নতুন কিছু শিখতে শুরু করার সাথে সাথে এই বিষয়ে নিজের চিন্তাগুলোকে সাজাতে শুরু করা অনেক জরুরী।

নিজেকে শিক্ষক ভাবুন

ফাইনম্যান যখন প্রিন্সটনে পড়তেন তখন অনেক শিক্ষকের লেকচার ভালো লাগতো না। পদার্থবিজ্ঞান কিংবা গণিতের অনেক বিষয় শিক্ষক তার সামনে থাকা ছাত্রদের উপযোগী করে বুঝাতে পারছেন না বলেই তার মনে হতো। তাই নিজে তিনি যখন কোনো বিষয় পড়তেন এবং বুঝতে পেরেছেন বলে মনে করতেন তখন তিনি নিজেকে শিক্ষকের অবস্থানে কল্পনা করতেন। তিনি লেকচার দিলে কীভাবে তা ছাত্রদের বোধগম্য করে তোলা যায় এই ব্যাপারটি অনুশীলন করতেন। যখন দেখছেন ব্যাপারটি তিনি সামনের ব্যক্তিকে বুঝাতে পারছেন না তিনি নিশ্চিতভাবে ধরে নিতেন ব্যাপারটি তিনি নিজেই বুঝেননি। কারণ আরেক পদার্থবিজ্ঞানী আইন্সটাইনের মতে, “যে বিষয়টি আপনি আরেকজনকে বুঝাতে পারছেন না, সে বিষয়টি আপনি ঠিকঠাক জানেন না”।

নিজেই হয়ে উঠুন নিজের শিক্ষক; ছবিসূত্রঃ http://online2.byu.edu

যদি রিচার্ড ফাইনম্যানের মতো আপনিও ছাত্রজীবন থেকে শিক্ষকতার অনুশীলন করতে থাকেন তবে হয়তো আপনিও একদিন হয়ে উঠবেন তারই মতো ‘গ্রেট এক্সপ্লেইনার’।

বারবার ঝালাই করতে হবে নিজেকে

নৌকা প্রতিবার পানিতে নামাবার কিংবা উড়োজাহাজ প্রতিবার উড্ডয়নের আগে কর্তৃপক্ষ সাধ্যমতো দেখে নেয় কোনো ত্রুটি আছে কিনা। ঠিক তেমনি ফাইনম্যান তার লেখাগুলো কিংবা লেকচারগুলো যাচাই করে নিতেন বারংবার। তথ্যের অবাধ প্রবাহের এই সময়ে এই মূহুর্তে যা সঠিক পরের মূহুর্তে তা ভুল প্রমাণিত হতেই পারে। তাই ফাইনম্যান তার নিজের লেখায় নিজেই ভুল খুঁজে বেড়াতেন। তার মতে, “নিজের করা ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে নিজেকে সংশোধন করেতে পারাটাই সবচাইতে বড় শিক্ষা”। তাই নিজের ভুলগুলোকে আড়াল না করে বরং শিক্ষা নিতে শুরু করাই হলো নিজেকে ঝালাই করার সর্বোত্তম উপায়। বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের অনেকগুলোই হয়েছে পূর্ববর্তী আবিষ্কারের ভুলগুলোকে সংশোধনের মাধ্যমে। বিজ্ঞানীরা যখন কয়লাচালিত স্টিম ইঞ্জিনে থাকা ভুলগুলোকে নিয়ে কাজ শুরু করলেন তখনই বেরিয়ে এলো এর চেয়ে ভালো ইঞ্জিন আবিষ্কারের প্রক্রিয়াটি। তাই ফাইনম্যানের এই টেকনিকের তৃতীয় ধাপে এসে অনেকেই নিজেকে নিয়ে সন্তুষ্ট হয়ে যায়।

নিজের আত্মতুষ্টি নতুন করে কিছু শেখার রাস্তা চিরতরে বন্ধ করে দেয়। তাই জ্ঞান আহরণের জন্যে নিজেকে কল্পনা করতে হবে মরুভুমিতে হারিয়ে যাওয়া এক ক্ষুধার্ত পথিকের মতো।

বাস্তবের সাথে সংযোগ ঘটান

বিজ্ঞান, গণিত, সাহিত্য কিংবা অন্য যে বিষয়টিই আপনি শেখা শুরু করেছেন তাকে বাস্তব জীবনের সাথে সংযোগ ঘটাতে চেষ্টা করতে পারাটা অনেক জরুরী। নিত্যদিনের জীবনে ঘটে চলা কোনো ঘটনার সাথে পাঠ্যবইয়ের দুর্বোধ্য কোনো তত্ত্বের মিল খুঁজে বেড়াতেন রিচার্ড ফাইনম্যান। বাস্তব জীবনের সহজবোধ্য কোনো ঘটনার সাথে যখন কঠিন তত্ত্বের মিল পাওয়া যায় আর এর ফলে তত্ত্বটি মনে রাখা অনেক সহজতর হয়। আর এর ফলে কোয়ান্টাম মেকানিক্সের মতো কঠিন বিষয়টিও হয়ে উঠতে পারে সাধারণের কাছে প্রিয়।

চাকুরি বাজারের তীব্র প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে নতুন একটি ভাষা কিংবা প্রোগ্রামিং ল্যাঙ্গুয়েজের মতো একটি স্কিল থাকা এখন জরুরী হয়ে উঠছে। তাই দেরি কেন আপনি নতুন করে যে বিষয়টি শিখতে আগ্রহী কিংবা শেখা বিষয়টিকে যদি আবার ঝালাই করে নিতে চান তবে নোবেলজয়ী পদার্থবিদ রিচার্ড ফাইনম্যানের এই টেকনিকের জুড়ি নেই। নোটবুক নিয়ে বসে যান, শিখতে থাকুন, নিজেকে নিজের শিক্ষক ভাবুন আর বাস্তবের সাথে আপনার শেখাটাকে সংযোগ করে হয়ে উঠুন সেই বিষয়ে দক্ষ।

ফিচার ইমেজ সোর্সঃ Youtube.com

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *