সুন্দর ভাবে কথা বলতে পারা মানুষের সবচেয়ে সুন্দর এবং কার্যকর গুণগুলোর একটি। কথার মাধ্যমে মানুষ তার মনের ভাব প্রকাশ করে। আপনি যত সুন্দরভাবে কথা বলতে পারবেন আপনার মনের ভাব সকলের কাছে তত সহজে প্রকাশ পাবে। এই গুণটি দিয়ে আপনি যেমন নিজের কাজ আদায় করতে পারবেন তেমনি অন্যদের করতে পারবেন প্রভাবিত। আমরা খুব কম মানুষই এই গুণ নিয়ে জন্মাই। তবুও চারপাশে খেয়াল করে দেখবেন, অনেকেরই এই বিশেষ গুণটি রয়েছে। কিভাবে তারা পারে? সত্য কথা বললে- চেষ্টা এবং চর্চার মাধ্যমে। আপনি যদি নিজের ভেতরে এই গুণটি আত্মস্থ করতে চান। তাহলে পড়ে ফেলুন আমাদের আজকের আয়োজন। বহুজন ব্যবহৃত এবং পরীক্ষিত এই কয়টি নিয়ম চর্চার মাধ্যমে আপনিও হয়ে উঠতে পারেন একজন স্মার্ট বক্তা।
পৃথিবীতে চার ধরণের বক্তা রয়েছে। যেমন –
১.অসংলগ্ন ভাষক
এই ধরনের বক্তারা সাধারণত অসংলগ্ন কথা বলেন। তাদের বেশিরভাগ কথাই সাধারণত তাদের নিজেদের জ্ঞানের টার্ম ব্যবহার করেন। তাদের কথায় বেশিরভাগ জুড়ে থাকে ব্যক্তিগত অর্জনের কথা।
২.সংলগ্ন ভাষক
এই ধরনের বক্তারা কথা বলে বিষয়ের সাথে সংলগ্ন। তাদের কথায় আপনি পাবেন ভরসা কেননা তারা বেশ ভালোভাবে শব্দ দিয়ে বিভিন্ন ধরনের ফ্যাক্ট এবং মতামতের ব্যবহার করেন। যদিও আপনি তাদের কথায় অনুপ্রাণিত হবেন তবে সময়ের সাথে সাথে তা হারিয়ে যাবে।
৩.আর্টিকুলেট বা পরিষ্কার বক্তা
এই ধরণের বক্তারা পরিষ্কারভাবে কথা বলেন। তাদের কথা বার্তার ধরণ এবং শব্দ চয়ন দ্বারা আপনি প্রভাবিত হবেন। তবে এই ধরণের বক্তারা সাধারণত বিশেষ কোনো স্বার্থের উদ্ধারের জন্য তাদের এই বিশেষ গুণ ব্যবহার করেন।
৪.এলোকুয়েন্ট বা অনুপ্রেরণা দানকারীবক্তা
এই ধরণের বক্তাদের সেরা বক্তা হিসাবে ধরা হয়। এলোকুয়েন্ট বক্তাদের কথা শুধুই শব্দচয়নের উপর নির্ভর করে না বরং তাদের বডি ল্যাংগুয়েজ বা শারীরিক অঙ্গভঙ্গির উপরও নির্ভর করে। কথার সাথে বডি ল্যাংগুয়েজ এর সঠিক মেলবন্ধনের কারণেই এই শ্রেণীর বক্তারা আমাদের প্রভাবিত করতে পারেন। আমাদের দেশের বেশ কয়েকজন এলোকুয়েন্ট স্পিকার এর নাম আনা যায় যেমন- প্রফেসর আবদুল্লাহ আবু সাইয়িদ কিংবা শেখ মুজিবর রহমান। তারা প্রত্যেকেই তাদের ভাষণে সুন্দর শব্দের পাশাপাশি সহজ শব্দ এবং বডি ল্যাংগুয়েজ ব্যবহার করেছেন অসাধারণভাবে, আর আমাদের করেছেন অনুপ্রাণিত।
এলোকুয়েন্ট বক্তাদের জ্ঞান বা বোধের পরিমাপ করা কঠিন কেননা তারা সাধারণত স্মার্ট হন। তাদের ভুলগুলো ঢেকে যায় তাদের নিজেদের চেষ্টায় তৈরি করা বিশেষ কিছু গুণ দিয়ে। আপনি হয়তো আপনার চারপাশে এমন অনেক মানুষ খুঁজে পাবেন যারা প্রচন্ড মেধাবী কিন্তু সঠিক ভাবে কথা বলতে পারেন না, আবার অনেকে তেমন গুণী নয় তবুও তাদের কথাবার্তায় আপনি অবাক হবেন। আসলে এলোকুয়েন্ট বা সেরা বক্তা হতে পারাটা একটি বিশেষ গুণ বা স্কিল। আপনিও চেষ্টা এবং চর্চার মাধ্যমে এই গুণটি আত্মস্থ করতে পারেন।
কিভাবে এবং কোথা থেকে শুরু করবেন? নিচের ৯ টি বহুবার ব্যবহৃত এবং ফলপ্রসূ নিয়ম মেনে দেখুন, বাকিটা নিজেই অনুভব করবেন।
১. সঠিকভাবে দাঁড়ান এবং বসুন
আপনাদের সকলের মনে থাকার কথা স্কুলের শরীরচর্চার স্যারের কুচকাওয়াজ। “আরামে দাঁড়াও -সোজা হও “। এত বড় হবার পরও এই শিক্ষাটাই মেনে চলুন। বসবার বা দাঁড়ানোর সময় মেরুদন্ড সোজা রাখুন। সেরা বক্তা হবার জন্য প্রথমে এই গুণ অর্জন করতে হবে। এলোকুয়েন্স মানেই শুধু পরিষ্কার কথা বলতে পারার গুণ নয় পাশাপাশি সঠিক বডি ল্যাংগুয়েজ ব্যবহার করা। মেরুদন্ড সোজা করে রাখা হচ্ছে সব সেরা গুণের মূল।
আঁকা বাঁকা হয়ে বসে বা দাঁড়িয়ে কথা বললে আত্মবিশ্বাস কমে যায়। কথা বলার সময় কোনো কিছুতে হেলান দিয়ে দাঁড়ালে বা বসে কথা বললে শ্রোতারা অমনোযোগী হয়ে পড়ে। শ্রোতারা বুঝতে পারে আপনি যা বলতে চাচ্ছেন, সে বিষয়ে আত্মবিশ্বাসী নন, তাই বিভিন্ন জিনিসের সাথে ঠেস দিয়ে আত্মবিশ্বাসী হবার চেষ্টা করছেন। বৈজ্ঞানিকভাবে পরীক্ষিত যে, আপনি যখন সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বা বসে কথা বলেন তখন আপনার ফুসফুসে সঠিকভাবে বাতাস প্রবাহিত হয় এবং আপনি ঠাণ্ডা মাথায় পরিষ্কারভাবে কথা বলতে পারেন।
২. মাথা উঁচু রাখুন
কাঁধের মতো আপনার মাথা ঠিকভাবে রাখাও আপনার সেরা বক্তা হবার চেষ্টারই অংশ। “শিনা টান টান রাখুন” কিংবা ” চির উন্নত মম শির” এরকম অনেক প্রবাদ বাক্য আপনি শুনে থাকবেন জীবনে। আসলে সত্যি তাই , উঁচু শির আপনাকে দেবে আত্মবিশ্বাস এবং আপনার গর্ববোধ। আপনি যদি মাথা নিচু করে কিংবা ঘাড় বাঁকা করে থাকেন তবে আপনার কথা বলতে গিয়ে বেঁধে যাবে। তাই ঘাড় উঁচু করে আত্মবিশ্বাসের সাথে কথা বলুন, তাহলে শ্রোতারা হবে মনোযোগী।
৩. শ্রোতাদের বিষয়ে মনোযোগী হোন
আপনি তখনই একজন স্মার্ট বক্তা হবেন যখন শ্রোতারা আপনার কথা শুনবে। শ্রোতারা আপনার কথা তখনই শুনবে না যখন আপনি নিজে তাদের প্রতি মনোযোগী হবে না, কিংবা কথা বলার সময় এদিক ওদিক তাকান। আমাদের অনেকেরই এই সমস্যা রয়েছে। মিটিং-ভাষণ কিংবা প্রেজেন্টশনে আমরা আটকে যাই, নিচের দুটি টিপস ব্যবহার করে দেখতে পারেন।
- বড় হল ঘরে ভাষণের সময় কিংবা প্রেজেন্টশনের সময় অস্থির ভাবে আশেপাশে তাকাবেন না, ধীরে ধীরে তাকান। শ্রোতাদের মুখের দিকে তাকিয়ে কথা বলুন।
- বক্তৃতা বা কথা বলার সময় আপনার হাতের কাগজ বা নোট দেখতে হলে আস্তে মাথা নিচু করে দেখুন, অযথা মাথা নাড়াবেন না।
৪. আত্মবিশ্বাসের সাথে উঁচু গলায় কথা বলুন
সেরা বক্তার আরেকটি বিশেষ গুণ হলো ভারী গলায় এবং উচ্চ স্বরে কথা বলতে পারা। মরগান ফ্রিম্যান বা লিয়াম নেসনদের মতো অভিনেতারা শুধুমাত্র তাদের বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর দিয়ে আমাদের অনুপ্রাণিত করে চলেছেন। তবে সবাই জন্মসূত্রে এই বিশেষ গুণ না পেলেও চর্চার মাধ্যমে অর্জন করতে পারে। নিচের টিপস মেনে দেখতে পারেন
- অবসরে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলুন। কথা বলার চর্চা করুন।
- বুক ভরে নিশ্বাস নিন এবং ভরা গলায় কথা বলার চর্চা করুন, কণ্ঠনালী থেকে শব্দ পরিষ্কারভাবে বের করার চর্চা করুন।
অনেকের সামনে কথা বলার সময় উঁচু গলায় কথা বলুন, আর বড়রুমে হলে জোরে কথা বলে অথবা গলা খাঁকারি দিয়ে শ্রোতাদের মনোযোগ নিয়ে নিন। চাইলে জেনে নিতে পারেন পেছনের সবাই কি আপনাকে শুনতে পাচ্ছে কিনা। তবে একটা জিনিস অবশ্যই খেয়াল রাখবেন, জোরে কথা বলবেন মানে এই নয় যে চিৎকার করে বলতে হবে। চিৎকার করে কথা বললে শ্রোতা যেমন আগ্রহ হারাবে ঠিক তেমনি আপনি ও আত্মবিশ্বাস হারাবেন।
৫. সঠিক শব্দের ব্যবহার করুন এবং ব্যবহার করুন আপনার বডি ল্যাংগুয়েজ
কথার বলার সময় সঠিক শব্দ ব্যবহারের চেষ্টা করুন। প্রয়োজনে হাত ব্যবহার করে কথার বিশেষ পয়েন্টগুলো তুলে ধরুন। এই গুণটি আত্মস্থ করতে চাইলে সেরা ব্যক্তি কিংবা সেলিব্রেটিদের ফলো করতে পারেন। দেখুন তারা কিভাবে কথা বলেন কিংবা কিভাবে তাদের বডি ল্যাংগুয়েজ ব্যবহার করে। আপনি যদি নিজের বডি ল্যাংগুয়েজ ঠিক না রাখেন তাহলে শ্রোতারা আপনার কথায় আকৃষ্ট হবে না।
৬. শব্দের সাথে সঠিক বডি ল্যাংগুয়েজ ব্যবহার করা
আবারো মনে করিয়ে দিচ্ছি শব্দের প্রতি মনোযোগী হোন, শব্দের প্রতি জোর দিন। সাথে সাথে আপনার অঙ্গভঙ্গি সঠিকভাবে প্রকাশ করুন। যেমন, ধরুন আপনি স্টেজে কথা বলছেন, স্থির দাঁড়িয়ে না থেকে জায়গা পরিবর্তন করুন। এই বিশেষ ধাঁচ শ্রোতাদের বোঝাবে আপনি নতুন কিছু দিতে চলেছেন তাদের এবং তারা আগ্রহী হবে শুনতে।
৭. সহজ শব্দ ব্যবহার করুন
আপনি যদি সেরা বক্তা হতে চান তবে সহজ সুন্দর শব্দ ব্যবহার করুন। আপনাকে অবশ্যই কঠিন শব্দ ব্যবহারের মনোভাব দূর রাখতে হবে কেননা কঠিন শব্দ ব্যবহার আপনাকে স্মার্ট বানায় না বরং শ্রোতার আকর্ষণ নষ্ট করে। আস্তে আস্তে কথা বলতে চেষ্টা করুন কেননা শ্রোতা ঠিক মতো আপনার কথা বুঝতে না পারলে তারা মনোযোগ হারিয়ে ফেলবেন।
৮. কথার মাঝে বিরতি দিন
আমরা অনেকেই এই ভুল করে থাকি, মিটিং থেকে শুরু করে প্রেজেন্টেশানে নার্ভাস হয়ে দ্রুত কথা বলতে থাকি। আপনি যদি স্মার্ট বক্তা হতে চান তবে এই ভুল এড়িয়ে চলার চেষ্টা করুন। বুক ভরে নিশ্বাস নিয়ে ধীরে ধীরে কথা বলুন। এতে শ্রোতারাও শুনতে পারবে। বলা হয়ে থাকে, কথা বলার শুরুতে কয়েক মুহূর্তের বিরতি নিলে কিংবা গলা ঝেড়ে কাশলে শ্রোতারা চুপ হয়ে শুনতে আগ্রহী হয়। আপনি নিজে সময় নিন এবং শ্রোতাদের সময় দিন আপনার সেরা বক্তৃতা আত্মস্থ করতে। বিরতি দিয়ে কথা বলা মনোযোগ আকর্ষণের সেরা উদাহারণ। মার্টিন লুথার কিং এর ভাষণ ‘আমার স্বপ্নের ভাষণ বা I Have a Dream Speech’ শুনে দেখতে পারেন!
৯. বিভিন্ন ভাবে কথা বলুন
স্মার্ট বক্তার সর্বশেষ যে গুণ থাকা প্রয়োজন তা হচ্ছে বিভিন্নভাবে কথা বলতে পারা। বিভিন্নভাবে কথা বলার মানে এই নয় যে বিভিন্ন ভাষার একত্র ব্যবহার বরং বিভিন্ন গতিতে কথা বলতে পারা। মরগ্যান ফ্রিম্যানের গলায় এই বিশেষ গুণটি লক্ষ্য করা যায়। তিনি বিভিন্ন শব্দের প্রতি বিভিন্ন ভাবে জোর দেন এমনকি বিভিন্ন গতিতে কথা বলেন তিনি। আপনি যদি একভাবে কথা বলতে থাকেন তবে বিষয়টা যেমন একঘেয়েমির পরিবেশ তৈরি করে তেমনি শ্রোতার আকর্ষণ নষ্ট হয়। সবচেয়ে ভালো হয়, যদি আপনি বক্তব্যের গুরুত্ব বুঝে কথার গতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন। জেনে রাখুন –
- নতুন তথ্য দেবার সময় ধীরে কথা বলুন।
- কথার শুরুতে ধীরে কথা বলুন।
- কোন বিষয়ের সারমর্ম দেবার সময় দ্রুত বিষয়গুলো ফুটিয়ে তুলুন, এতে শ্রোতারা আপনার কথা যেমন মনোযোগ দিয়ে শুনবে তেমনি মনে রাখবে।
আর দশজনের মতো আমি আপনি মাঝে মাঝে কথার খেই হারাই পরিবেশের কারণে বা অভ্যাসের জন্য। তাই চেষ্টা এবং চর্চার মাধ্যমে নিজেকে একজন সেরা এবং স্মার্ট বক্তা বানিয়ে ফেলুন।