ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা দিয়েই শুরু করছি। এক বান্ধবীর ভীষণ মন খারাপ। চুপচাপ বসে আছে সে। একটু পরেই দেখি ফোনের স্ক্রিনে কী যেন বেশ মনোযোগ দিয়ে তাকিয়ে দেখছে। জিজ্ঞাসা করাতে সে বললো, “নিজের ছবি দেখছি। নিজের ছবি দেখতে আমার বেশ ভালো লাগে। মন খারাপ হলেই আমি নিজের ছবি দেখি।”
সেদিন বেশ অদ্ভুত লাগলেও চারপাশে তাকিয়ে দেখলে বোঝা যায়, আসলে ব্যাপারটা অদ্ভুত না। সেলিফির এই যুগে কে আছে যে নিজেকে বা নিজের সৌন্দর্য পছন্দ করি না। নিজের প্রতি এই আকর্ষণ কমবেশি সবার থাকলেও,কারো কারো ক্ষেত্রে এই আকর্ষণের তীব্রতা এতটাই প্রবল যে, নিজেকে ছাড়া তারা অন্য কিছুর প্রতিই আকর্ষণ অনুভব করেন না। আত্ম-অহংকারে মানুষগুলোর চোখ বাঁধা থাকে। এ ধরণের মানুষকে ‘নার্সিসিস্ট’ বলা হয়ে থাকে। আর তাদের এই মানসিক রোগকে বলা হয় ‘নার্সিসিজম’।
নার্সিসিজম শব্দটি এসেছে গ্রীক পুরাণের (Myth) এক গল্প থেকে যেখানে নার্সিসাস নামের এক অপূর্ব সুন্দর বালকের কথা বলা হয়, যে কিনা নিজের রূপের প্রতি নিজেই আকর্ষিত ছিল। তার এই অপূর্ব সুন্দর রূপ এবং নিজের প্রতি আকর্ষণই তার মৃত্যু ডেকে আনে, গল্পানুসারে। সেই থেকে মনোবিজ্ঞানীরা নার্সিসিজম টার্মটি দিয়ে সেসব মানুষদের চিহ্নিত করেছেন যাদের রয়েছে নিজের প্রতি প্রবল আকর্ষণ। কিন্তু শুধুমাত্র নিজের প্রতি আকর্ষিত হলেই কি আমরা একজনকে নার্সিসিস্ট বলে আখ্যায়িত করতে পারি? না। কয়েকটি বিশেষ লক্ষণের উপস্থিতিই জানান দেয় মানুষটি আসলেই নার্সিসিস্ট কিনা। চলুন জেনে নেই যে ৫ টি উপায়ে শনাক্ত করতে পারব প্রকৃত নার্সিসিস্ট।
১. নিজেকে নিয়ে আলাদা আকর্ষণ
নিজের প্রতি আকর্ষণ একজন নার্সিসিস্টের প্রথম শর্ত। নার্সিসিস্ট বিভিন্ন ধরণের হতে পারে বলে জানিয়েছে হার্ভার্ড মেডিক্যাল কলেজের অধ্যাপক Craig Malkin। তিনি Psychology Today‘র একটি আর্টিকেলে বলেছেন, দুই ধরণের নার্সিসিস্ট সবচেয়ে বেশি লক্ষণীয়। প্রথমত এক দল যারা অত্যন্ত নিখুঁত। নিজেদের ব্যাপারে সর্বদা তাদের জিজ্ঞাসা থাকেই। নিজের সম্পর্কে খুঁটিনাটি জানতে তারা ব্যস্ত যা বাকিদের জন্য অত্যন্ত বিরক্তকর হয়ে ওঠে। আরেকদল হলো যারা সমালোচনা সহ্য করতে পারেন না। সর্বক্ষণ নিজের প্রতি যাতে অন্যদের দৃষ্টি থাকে, সেটা নিয়ে তারা চিন্তিত থাকেন।
২. সহমর্মিতার অভাব
Joseph Burgo একজন মনোবিজ্ঞানী এবং The Narcissist You Know বইয়ের লেখক নার্সিসিজম সম্পর্কে বিজনেস ইনসাইডারকে দেওয়া একটি আর্টিকেলে বলেছেন, একজন নার্সিসিস্ট হওয়ার অন্যতম শর্ত হলো, অন্য কোনো ব্যক্তি সম্পর্কে আকর্ষণের অভাব এবং যেকোনো আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে নিজেকে টিকিয়ে রাখতে চাওয়া। শুধু তাই নয়, অন্যের অনুভূতি নিয়ে নেই তাদের কোনো মাথাব্যথা। বলা যায় অনেকটা ‘Insensitive’।
উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, যদি দলবদ্ধভাবে কোনো আলোচনায় একজন নার্সিসিস্ট উপস্থিত থাকেন এবং আলোচনার বিষয়বস্তু সেই নার্সিসিস্ট ব্যক্তিকে নিয়ে নয় বরং অন্য কিছু হয় তবে নার্সিসিস্ট ধীরে ধীরে সেই আলোচনায় উদাসীন হয়ে পড়েন। এই কারণে একজন নার্সিসিস্ট কখনোই একজন সদালাপী ব্যক্তি নন, যদি না আলাপের বিষয়বস্তু তিনি নিজে হন। শুধু তাই নয়, বাস্তব জীবনের সাথে সাথে ভার্চুয়াল জীবনেও একজন নার্সিসিস্টের সাথে গভীর সংযোগ করা সম্ভব হয় না।
৩. প্রশংসার প্রতি লিপ্সা
নিজেদের প্রশংসা শুনতে সবাই পছন্দ করলেও, একজন নার্সিসিস্টের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা বাড়াবাড়ি রকমের। সাইকোথেরাপিস্ট ‘Kathleen Schafler’ বলেছেন, বাড়তি প্রশংসা একজন নার্সিসিস্টের পছন্দনীয়।
তিনি আরো বলেছেন, নার্সিসিস্ট ব্যক্তিরা সর্বদা মধ্যমণি হয়ে থাকতে পছন্দ করে। তাদের আগমনেই যেন সকলের টনক নড়ে উঠবে, এমনটাই তাদের চাহিদা।
৪. সমাজে পদমর্যাদা
মনোবিজ্ঞানী ‘Elinor Greenberg’ সাইকোলজি টুডের একটি আর্টিকেলে বলেছেন, একজন নার্সিসিস্টের সবচেয়ে ভয়ংকর ব্যাপার হচ্ছে পদমর্যদার প্রতি আকর্ষণ।
তিনি আরো বলেছেন, একজন নার্সিসিস্টের বক্তব্য থেকেই বোঝা যায় তিনি সামাজিক পদমর্যাদার প্রতি কতটা দুর্বল। তাদের বিভিন্ন মন্তব্য,
যেমন “আপনি কি জানেন আমি কত ধনী?” কিংবা “শহরের গুরুত্বপূর্ণ মানুষগুলো দলবদ্ধ হবে সেখানে। আমাকে থাকতেই হবে কেননা লোকে ভাববে আমি আমন্ত্রিত নই” ইত্যাদি প্রকাশ করে তাদের লালসা।
৫. আত্মকেন্দ্রিক
মনোবিজ্ঞানী Susan Heitler সাইকোলজি টুডেকে বলেছেন, একজন নার্সিসিস্ট সনাক্তকরণের প্রাথমিক উপায় হচ্ছে, সে অন্যের সাথে কথোপকথনে কতটা মনোযোগী এই বিষয় যাচাই এর মাধ্যমে। তিনি আরো বলেন, একজন নার্সিসিস্টের কাছে, সে নিজে কী বলতে চায় বা কী বিষয়ে কথা বলতে চায় এটি সবচেয়ে বেশী গুরুত্বপূর্ণ। কোনো সিদ্ধান্ত স্থাপনে, একজন নার্সিসিস্টের কাছে তার নিজের চাওয়া, নিজের সুবিধা বাদে অন্যের চাওয়া, সুবিধা-অসুবিধা এবং অনুভূতির ব্যাপারটা একেবারেই ঠুনকো।
নার্সিসিজম একটি মানসিক রোগ। এই রোগের কারণে নার্সিসিস্ট ব্যক্তিরা বন্ধু, পরিবার, স্বজন সকলের কাছেই বঞ্চিত হতে থাকে। ছোট থেকেই এই রোগকে বাড়তে দেওয়া উচিত নয় এবং এ রকম সমস্যা হলে একজন মনোবিজ্ঞানীর সাহায্য নেওয়াও প্রয়োজন।