স্মার্টফোন, কম্পিউটার কিংবা প্লে স্টেশনে ভিডিও গেমস খেলা এখনকার প্রজন্মের বিনোদনের অনেকটাই দখল করে নিয়েছে। যদিও এর পেছনে অনেক কারণ দায়ী তবুও জানা প্রয়োজন – অতিরিক্ত গেম খেলা কিংবা গেমের প্রতি আসক্তি আসলে আমাদের বর্তমান প্রজন্মের জন্য কতটুকু ক্ষতিকর। আর এটি অবশ্যই জানা দরকার অভিভাবকদেরও যারাও অনেকাংশে দায়ী এই গেমের প্রতি তাদের সন্তানদের আসক্তির জন্যে।
চলুন জানি তাহলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) কি বলছে এই গেম খেলা নিয়ে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য স্বংস্থা গেমিং আসক্তিকে অতিশীঘ্রই মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার তালিকায় যোগ করার কথা বিবেচনা করছেন। তারা মনে করেন, অতিরিক্ত গেম খেলা/গেমের প্রতি আসক্তির কারণে একজন ব্যক্তির আচরণগত পরিবর্তন দেখা যেতে পারে যা কিনা তার সাথে সম্পর্কিত অন্যানা ব্যক্তিদের বিদ্যমান সম্পর্কের ক্ষেত্রে ব্যঘাত সৃষ্টি করতে পারে এমনকি তা স্কুল কিংবা অফিসে মানুষের পারফরমেন্সেও ব্যঘাত ঘটাতে পারে। যদিও গেম কিছু মানুষের জন্য অনেক আকর্ষণীয় হয়ে থাকে এবং এতে তাদের জন্য কিছু মানসিক সুবিধাও থাকে। তবে শখ কিংবা বিনোদনের জন্য একটি নির্দিষ্ট মাত্রা থাকা উচিত, নতুবা সেটি পরিণত হবে আসক্তিতে এবং সৃষ্টি করবে নানান জটিলতা।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য মতে, ১১তম ইন্টারন্যাশনাল ক্লাসিফিকেশন অব ডিজিজেস (আইসিডি) এর চুড়ান্ত অনুমোদন কিংবা স্বীকৃতি এখন দেয়া হয়নি। তবে সেই তালিকায় অবশ্যই গেমের প্রতি আসক্তির বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত হবে (যা এখন একটি খসড়া তালিকা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে)। উক্ত খসড়া অনুযায়ী গেমের প্রতি আসক্তদের ক্ষেত্রে তিনটি আচরণবিধি তথা বৈশিষ্ট্যের উল্লেখ আছে। সেই তিনটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে – যদি কোন ব্যাক্তি তার গেম খেলার মাত্রা ছাড়িয়ে যায়/নিয়ন্ত্রণ হারায়, যদি তারা অন্যান্য আগ্রহ বা কার্যকলাপ এর চেয়ে গেমিংকে বেশি প্রাধান্য দেয় এবং তাদের খেলা চালিয়ে যেতেই থাকে এটা জানা সত্ত্বেও যে এতে তাদের ক্ষতি হচ্ছে/তাদের উপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। উক্ত বৈশিষ্ট্যগুলি যদি কোনো ব্যক্তির মধ্যে দেখা যায় তবে সেই ব্যক্তি গেমের প্রতি আসক্ত হয়ে গিয়েছে বলা ধরা হবে।
এটি ঠিক সেই তালিকায় পড়বে অর্থাৎ গেমের প্রতি আসক্তরা সেই তালিকায় থাকবে যে তালিকায় আছে অ্যালকোহল, মারিজুয়ানা, ক্যাফেইন, নিকোটিনের মতো পদার্থ ব্যবহারকারীরা এবং জুয়া খেলার খেলোয়াড়েরা যাদের ক্ষেত্রেও কোনো নেশাজাতীয় পদার্থের কারণে তাদের মানসিক বিকৃতি ঘটেছে। গেমের প্রতি আসক্তদের ক্ষেত্রে আইফোনের সামনে দুটো ডট/বিন্দু মেলাতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকা কিংবা কাস্টম মেড গেমিং পিসির সামনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে গেম খেলা সংক্রান্ত সকল কাজকেই বোঝায়। এ রকম কার্যকলাপ অর্থাৎ ঘণ্টার পর ঘণ্টা একই কাজ চালিয়ে যাওয়া (গেম খেলা) দেখেই একজন চিকিৎসক এবং মানসিক স্বাস্থ্য/রোগ বিশেষজ্ঞ একজন ব্যক্তিকে সহজেই চিহ্নিত করতে পারবেন যে, সে গেমের প্রতি আসক্ত কি না।
কিন্তু তার মানে এটা ভাবলেও চলবে না যে, সব গেমই আসক্তি (গেমের প্রতি নেশা) তৈরি করবে এবং তা একটি মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা/রোগ হিসেবে চিহ্নিত হবে। খসড়া অনুযায়ী, গেমের প্রতি একজন ব্যক্তিকে তখনই আসক্ত বলা যাবে যখন “তার আচরণগত, পারিবারিক, সামাজিক, শিক্ষাগত, পেশাগত বা কার্যকরী অন্য গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রগুলোতে উল্লেখযোগ্য ক্ষতি হওয়া সত্ত্বেও উক্ত ব্যক্তি তার গেম খেলা চালিয়ে যাবেন।” অন্য কথায়, ব্যক্তিগত সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং স্কুল বা প্রাতিষ্ঠানিক কাজের মধ্যে হস্তক্ষেপ করার জন্য এটি যথেষ্ট বড় একটি কারণ হয়ে দাঁড়াবে।
গেমের পেছনের মনোবিজ্ঞান
যদিও গেমের প্রতি আসক্তির বিষয়টি নিয়ে মনস্তাত্ত্বিক সম্প্রদায়ের মধ্যে বিতর্ক রয়েছে এবং তাদের মতে, গেমিং আসক্তি আসলে বিশেষ কোনো রোগ নয়।তবে এটিকে কিছু সময়ের জন্য মানসিক বিকৃতি বা পরিবর্তন বলা যেতে পারে। এখন পর্যন্ত আমেরিকান সাইকিয়াট্রিক এসোসিয়েশন এই গেমিং আসক্তিকে ব্যাধি/রোগ হিসেবে অন্তর্ভুক্তিকরণে নিষেধাজ্ঞা জানিয়েছে এবং এই বিষয়টি নিয়ে আরো গবেষণা চালিয়ে যেতে বলছেন বিশেষজ্ঞদেরকে। তবে সমস্যাটিকে চিহ্নিত করার জন্যে এটির পেছনে একজন গেমার কত সময় ব্যয় করছেন এবং কিভাবে ব্যয় করছেন এই বিষয়গুলি লক্ষণীয়। অর্থাৎ একজন সাধারণ গেমার বনাম একজন আসক্ত গেমারের একটি গেম খেলার মধ্যবর্তী সময়ের পার্থক্য থেকেই এটি বলে দেয়া সম্ভব যে, একজন ব্যক্তি গেমের প্রতি আসক্ত কিনা, হলেও কতটুকু এবং উক্ত ব্যক্তির ক্ষেত্রে কি মানসিক ব্যধি ট্যাগটি ব্যবহৃত হবে কি না।
যুক্তরাজ্যের নটিংহাম ট্রেন্ট ইউনিভার্সিটির গবেষকদের একটি গ্রুপ গত গ্রীষ্মে প্রকাশিত একটি পত্রিকার জার্নাল অব অ্যাডিকটিভ বিহ্যাভিয়ার অংশে লিখেছিলেন, “বিজ্ঞানী এবং গবেষকদেরকে এমন ব্যক্তির মধ্যে পার্থক্য গড়ে তুলতে হবে যাদের একপক্ষ প্রচুর পরিমাণ গেম খেলা সত্ত্বেও তাদের দৈনন্দিন জীবনে কোনো প্রকার সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন না অর্থাৎ অতিরিক্ত গেম খেলার প্রভাব তাদের উপরে নেই এবং আরেকপক্ষ যারাও প্রচুর পরিমাণে গেম খেলছে এবং প্রতিনিয়তই তাদের দৈনন্দিন জীবনে নানা রকম সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে।” এমন ব্যক্তিদের সম্পর্কে প্রচুর গল্প আছে যাদের গেমিং আচরণ তাদের দৈনন্দিন জীবনের জন্য সমস্যাজনক হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং আসক্ত মানুষেরা অনলাইনে গেম খেলার মধ্যে আঁটকে গিয়েছেন এবং তারা তাদের চাকরি হারিয়েছেন এবং তাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্কগুলোকেও অকালে বিনষ্ট করেছেন। আর এই গেমিং হচ্ছে এমন একটি বিষয় যা অনেকটা ছোঁয়াচে রোগের মতো যা অনেকটা হাত থেকে হাতের মাধ্যমে একজন থেকে অন্যজনে ছড়িয়ে পড়ে।
নটিংহাম ট্রেন্টের গবেষক দলের মতে, এই গেমিং আসক্তি হয়তো কখনো কখনো কিছু ক্ষেত্রে সমস্যা হিসেবে অকৃতকার্য হতে পারে। যেমন কোনো ব্যক্তি যিনি কিনা বিষণ্ণতা, উদ্বিগ্নতার সাথে সংগ্রাম করছেন এবং সংগ্রামে টিকে থাকার জন্যে কোনো প্রকার অ্যালকোহল জাতীয় নেশাকারক দ্রব্যকে বাদ দিয়ে গেমের প্রতি আসক্ত হয়েছেন যাতে তার উক্ত সমস্যা থেকে নিজেকে তিনি দূরে রাখতে পারেন অর্থাৎ এক্ষেত্রে গেমিং কিন্তু নিজেই কোনো একটি সমস্যার উপশম হিসেবে কাজ করছে।
উপকারিতা এবং ক্ষতি
জনস হপকিন্স ব্লুমবার্গ স্কুল অব পাবলিক হেলথের আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য বিষয়ক সহকারী অধ্যাপক ব্রুস লি’র মতে, গেমস খেলতে হুমকিস্বরূপ (বা সহায়ক) খেলাটির মাত্রা/মাপকাঠি বের করা প্রয়োজন। মি. লি ‘ফোর্বসের’ একটি কলামে এটিও লিখেছেন যে,”গেমিং এর অভ্যাসগুলো মানসিকভাবে উপকারী হতেও পারে।”
ইতিবাচক দিক দিয়ে, গবেষণাপত্র অনুযায়ী গেম খেলার কারণে বিষণ্ণতা, উদ্বিগ্নতার মতো বিষয়গুলোর উপশম হতে পারে, সমস্যা-সমাধান করার ক্ষমতা বাড়তে পারে এবং চোখ ও হাতের মধ্যে এক চমকপ্রদ সমন্বয়ের মতো বৈশিষ্ট্যগুলোকে বৃদ্ধি করতে পারে। প্রযুক্তিকে, যাকে আমরা গেমিং এর জন্যে ব্যবহার করার কথা ভাবছি, যেমন ভার্চুয়াল রিয়েলিটি যাকে মনস্তাত্ত্বিক থেরাপির কাজেও আমরা ব্যবহার করতে পারি। তবে এখনও মানুষ লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে গেমের জন্য একটি সুষম/উপযুক্ত সময় বের করতে, যাতে থাকবে না কোনো ক্ষতির আশঙ্কা। তবে গবেষকরা এখনও এই গেমিং সংক্রান্ত কার্যকলাপের ঝুঁকি এবং এর প্রভাবগুলো বুঝতে চেষ্টা করছেন। কারণ এটি সম্প্রতি এমন একটি সাধারণ চরিত্র হিসেব ফুটে উঠেছে এবং ৬৩% মার্কিন পরিবারের মধ্যে অন্তত একজন করে গেমার বের হচ্ছে, যা কিনা একটি প্রজন্ম বা কয়েক যুগ আগেও বিদ্যমান ছিল না।