বিজ্ঞানী থমাস অালভা এডিসনকে বলা হয় অাবিষ্কারের অাবিষ্কর্তা। সারা জীবনে তিন মাস স্কুলে গেলেও তার অাবিষ্কার সংখ্যা হাজার ছাড়িয়ে। বৈদ্যুতিক বাতি, ফনোগ্রাফ, ব্যাটারি চালিত গাড়ী, গ্রামোফোন ইত্যাদি যন্ত্র তার অাবিষ্কারের মধ্যে অন্যতম। তিনি ছিলেন একাধারে বিজ্ঞানী, উদ্ভাবক এবং উদ্যোক্তা। অালভা এডিসনের গুরুত্বপূর্ণ সব অাবিষ্কার বদলে দিয়েছে পৃথিবী। চলুন জেনে অাসি এই মহাজ্ঞানীর জীবন সম্পর্কে।
সংক্ষিপ্ত পরিচিতি
টমাস অালভা এডিসন ১৮৪৭ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের ওহিও, মিলানে জন্মগ্রহণ করেন। এডিসনের বাবার নাম স্যামুয়েল অগডেন এডিসন এবং মা ছিলেন ন্যান্সি ম্যাথিউস। এডিসন ছিলেন তার বাবা মায়ের সবর্শেষ সন্তান।
বিবাহ
১৮৭১ সালের ২৫ ডিসেম্বর এডিসন মেরি স্টিলওয়লকে বিয়ে করেন। স্টিলওয়েলের তখন বয়স ছিল ১৬ বছর। এডিসনের ছিল ২৪। মেরিওন এসটেলা, থমাস অালভা এডিসন জুনিয়র এবং ইউলিয়াম লেসলি এডিসন নামে তাদের তিন সন্তান ছিল। মেরি স্টিলওয়েল ৯ অাগস্ট, ১৮৮৪ সালে মৃত্যুবরণ করলে এডিসন পুনরায় বিয়ে করেন। তার দ্বিতীয় স্ত্রী ছিলেন মিনা মিলার। থমাস অালভা এডিসনের দ্বিতীয় স্ত্রীর ঘরেও তিন সন্তান জন্ম নেয়। তাদের নাম-চার্লস এডিসন, মেডিলিইন এডিসন এবং থিওডর এডিসন।
পড়াশোনা
যুক্তরাষ্ট্রের ওহিওর মিলান থেকে ১৮৫৪ সালে এডিসনের পরিবার মিশিগানের পোর্ট হুরনে চলে অাসে। সেখানকার একটি স্কুলে এডিসন ভর্তি হন। ছোটবেলা থেকেই এডিসন ছিলেন কৌতূহলী বালক। সব সময় তার মাথায় নানান প্রশ্ন ঘুরপাক খেত। শিক্ষকদের একের পর এক প্রশ্ন করেই যেতেন তিনি। তার সব প্রশ্নের উত্তর দেওয়া সম্ভব হতো না শিক্ষকদের। তার অদ্ভূত সব প্রশ্নে বিব্রত হতেন শিক্ষকরা। স্কুলের ধরাবাঁধা পড়াশোনা তার ভালো লাগত না। এডিসনের পড়াশোনার প্রতি অমনোযোগ অার এমন অাচরণের জন্য স্কুল থেকে তার মায়ের কাছে চিঠি পাঠানো হয়।
চিঠি পেয়ে তার মা তাকে স্কুল থেকে একেবারে নিয়ে অাসে। মাত্র ১২ সপ্তাহ স্কুলে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল তার। টমাস অালভা এডিসন ছিলেন প্রচুর মেধাবী কিন্তু তার স্কুলের শিক্ষকরা তা অাঁচ করতে পারেননি। এডিসনের মা ছিলেন স্কুল শিক্ষিকা। পরবর্তী সময়ে তার মায়ের কাছেই বাসায় বসে পড়াশোনা শিখেন। এডিসন অল্প বয়সেই প্রচুর বই পড়েন। নিজের বাসায় বইয়ের পাঠাগার গড়ে তুলেন তিনি।
যেভাবে টেলিগ্রাফ তৈরি করলেন এডিসন
গ্র্যান্ড ট্রাংক রেল লাইনের কাছেই এডিসন রোজ পত্রিকা বিক্রি করতেন। একদিন লক্ষ্য করলেন একটি শিশু রেললাইনের খুব কাছ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। তখন পেছন থেকে ট্রেন অাসতে ছিল। দেখা মাত্রই এডিসন দ্রুত শিশুটিকে সরিয়ে নিলেন। বেঁচে যায় শিশুটি। ঐ শিশুটি ছিল ট্রেন স্টেশন মাষ্টারের ছেলে। স্টেশন মাষ্টার বেশ খুশি হয় এডিসনের প্রতি। খুশি হয়ে তিনি এডিসনকে পুরস্কার দিতে অাগ্রহ দেখান। কিন্তু এডিসন পুরস্কার নিতে রাজি হলেন না। তিনি স্টেশন মাষ্টারের কাছে টেলিগ্রাফ শেখা ইচ্ছা জানালেন। তিনি রাজি হলেন এডিসনের এমন অাগ্রহে। স্টেশন মাষ্টার ছিলেন টেলিগ্রাফ অপারেটর। কয়েক মাসের মধ্যে টেলিগ্রাফ শিখে ফেলেন এডিসন। সাথে সাংকেতিক লিপি এবং তার অর্থও রপ্ত করেন তিনি।এক সময় নিজেই হন টেলিগ্রাফ অপারেটর।
চাকরি
১৩ বছর বয়সেই কাজের সন্ধানে বেরিয়ে পড়েন এডিসন। শুরুতে খবরের কাগজ ফেরি করতেন রেলগাড়ীতে। খবরের কাগজের সাথে চকলেট এবং বাদামও বিক্রি করতেন এডিসন। জমানো টাকা দিয়ে অল্পদামে ছোট একটি ছাপাখানা কেনেন তিনি। ছাপাখানা যন্ত্রের সুবাদে তিনি একটি পত্রিকা বের করেন।
সংবাদ সংগ্রহ থেকে শুরু করে পত্রিকা বিক্রি করা পর্যন্ত সব কিছু তিনি একাই করতেন। পত্রিকাটির নাম ছিল ‘গ্র্যান্ড ট্রাংক হেরাল্ড’। এই পত্রিকা থেকে এডিসন ভালোই অায় করেন। টেলিগ্রাফি শেখার পর ১৫ বছর বয়সে নিজেই টেলিগ্রাফ অপারেটর হিসেবে কাজ শুরু করেন। পরের ৫ বছর তিনি অামেরিকার বিভিন্ন জায়গায় কাজ করেন। ১৮৬৬ সালে এডিসন কেন্টাকির লুইসভিলে অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসে কাজ করতেন। তারপর ১৮৬৮ সালে ওয়েস্টার্ন ইউনিয়ন কোম্পানিতে কাজ করেন। বোস্টন ছেড়ে নিউ ইয়র্কে অাসার পর ইন্ডিকেটর কোম্পানিতে ফোরম্যান হিসেবে কাজ করার সুযোগ পান এডিসন।
অালভা এডিসনের অাবিষ্কার
থমাস অালভা এডিসনের ছোটবেলা থেকেই গবেষণার প্রতি অাগ্রহ ছিল। মাত্র ৯ বছর বয়সেই তিনি বাড়িতে পরীক্ষা নিরীক্ষার জন্য ল্যাবরেটরি তৈরি করেন। অালভা এডিসন সারা জীবনে অসংখ্য যন্ত্র অাবিষ্কার করেন। পৃথিবী বদলে দেয়া তার কিছু অাবিষ্কার সম্পর্কে এখানে অালোচনা করা হলো।
ইলেক্ট্রনিক ভোটিং রেকর্ডার
১৮৭৯ সালে এডিসন বোস্টনে কাজ করার সময় ভোট গণনার একটি যন্ত্র অাবিষ্কার করেন। এ যন্ত্রের সাহায্যে অল্প সময়েই সুষ্ঠভাবে ভোট গণনা করা যেত।
বৈদ্যুতিক বাতি
অাঠারো শতকের দিকে পৃথিবীর প্রথম বৈদ্যুতিক বাতি অাবিষ্কার করেন বিজ্ঞানী হামফ্রে ডেভি। থমাস অালভা এডিসন যে বাতি অাবিষ্কার করেন তা বিজ্ঞানী ডেভির অাবিষ্কৃত বাতির চেয়ে অনেক বেশী অালো দিত। তিনি অল্প অালোর বাতির বদলে অধিক অালোর বাতি তৈরি করেন ১৮৭৮ সালে। বাতিতে তিনি প্লাটিনাম ফিলামেট ব্যবহার করতেন তাই তার তৈরি করা বাতি অন্য বাতির চেয়ে অালো দিত বেশী। এডিসন বাণিজ্যিক ভাবে প্রথম বাতি উৎপাদন শুরু করেন। এজ্যনই তাকে বাতির জনক বলা হয়।
ব্যাটারি
১৯৯৯ সালে অালভা এডিসনের অাবিষ্কৃত ব্যাটরি দিয়ে গাড়ী চালানো যেত। এডিসনের উদ্দেশ্য ছিল এমন এক ব্যাটারি তৈরি করা যা দিয়ে রিচার্জ ছাড়া ১০০ মাইল গাড়ী চালানো যাবে। তিনি প্রায় ১০ বছর পরে ব্যাটারি তৈরি এ প্রকল্পটি বাদ দিয়ে দেন। কারণ ততদিনে গ্যাসোলিন জ্বালানি মানুষের হাতের নাগালে চলে অাসে। তবে তার অাবিষ্কৃত ব্যাটারি ফেলা যায়নি বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কাজে ব্যবহৃত হয়েছে।
বৈদ্যুতিক মিটার
এডিসনের অন্যতম একটি অাবিষ্কার ছিল বৈদ্যুতিক মিটার। তিনি ১৯৮১ সালে বৈদ্যুতিক মিটার অাবিষ্কার করেন। এটি অাবিষ্কারের ফলে বিদ্যুুৎ অপচয় রোধ হয়। বাসা অথবা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে বিদ্যুৎ ব্যবহারের পরিমাপ এই মিটারের সাহায্যে করা যেত। মিটারটিতে দুটি পাত থাকতো। পাতগুলো ছিল দস্তার। যাতে জিংক সালফেটের মিশ্রণ ছিল। পাত ওজন করলেই বিদ্যুৎ ব্যবহারের পরিমাণ জানা যেত।
এসব ছাড়াও থমাস অালভা এডিসন ফনোগ্রাফ, ভিডিও ক্যামেরা, মাইক্রোফোন সহ অসংখ্য যন্ত্র অাবিষ্কার করেন।
মৃত্যু
থমাস অালভা এডিসন ১৮ অক্টোবর ১৯৩১ সালে নিউ জার্সির ওয়েস্ট অরেঞ্জ এ মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৮৪ বছর। তিনি বেঁচে থাকবেন তার সৃষ্টিতে অাজীবন।