নিজেদের বোকামির জন্য আমাদের ভীত হওয়া প্রয়োজন। লক্ষাধিক মানুষের আজ সেই ক্ষেত্রগুলো সম্পর্কে জ্ঞান নেই যেগুলো মানুষ পূর্বে জ্ঞান দিয়ে সবকিছু জয় করে এসেছে। স্কুলের সাধারণ বিষয়গুলো যেমন- পড়া, লেখা এবং গণিত — এসকল ক্ষেত্রে আজ আমাদের জ্ঞান সামগ্রিকভাবে শতবর্ষ আগের অবস্থা থেকে এগিয়ে আছে। কিন্ত যদিও আমরা আধুনিক প্রযুক্তির মাঝে আছি আমাদের মাঝে অনেকেই পিছিয়ে পড়ছেন এইসব ক্ষেত্রে।
এটা কীভাবে হচ্ছে? আমরা আমাদের প্রয়োজনে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করছি। এটাও বললে ভুল হয় না যে, আমাদের জীবনযাত্রা অনেকাংশেই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দিয়ে প্রভাবিত। অনেকেই দিনের অধিকাংশ সময় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দিয়ে চালিত অ্যাপ, প্রোগ্রাম, সাইট নিয়েই পড়ে থাকি। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা মানুষের বুদ্ধিমত্তার সাথে আজ প্রতিযোগিতা করছে এবং অনেক ক্ষেত্রেই তার স্থান দখল করছে। একে বলা হয় cognitive offloading ।
আমরা এখন অধিকাংশ মানুষই বুদ্ধিমত্তার চেয়ে প্রযুক্তিকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি – এর উপর নির্ভর করছি। যখন এটা হচ্ছে তার সাথে সাথে আমাদের জ্ঞানও ক্ষয়িষ্ণু হয়ে যাচ্ছে। যদি এই বিষয় কয়েক প্রজন্ম ধরে চলতে থাকে তবে মানুষের কিছু মৌলিক জ্ঞানই হারিয়ে যাবে।
IBM Watson এর চিফ টেকনোলজি অফিসার Bob High বলেন,
আমাদের আবিষ্কৃত কোনো যন্ত্র তখনই মূল্যবান হয়ে উঠছে যখন তা আমাদের হাতের মুঠোয় এসে আমাদের ক্ষমতা বাড়িয়ে তুলছে এবং সেসকল কাজ করে দিচ্ছে যা আমরা মানুষ হিসেবে করতে পারছি না।”
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রায়শই আমাদের নিজস্ব বুদ্ধিমত্তাকে সরিয়ে জায়গা করে নিচ্ছে
এক্ষেত্রে একটি সাধারণ উদাহরণ হচ্ছে বানান। আমরা আজকাল spell-check, auto-correct, voice-to-text in Message এবং auto-complete in Google ব্যবহার করছি যা অনেক ক্ষেত্রেই আমাদের বুদ্ধিমত্তার প্রতিস্থাপক এতে কোনো সন্দেহই নেই। অনেক সময় এগুলো ব্যবহার করতে করতে আমরা সহজ কিছু শব্দের বানানও ভুলে যাই, সহজতম হিসাবগুলো করতে পারি না। ভবিষ্যতের একটি উদাহরণ হবে শ্রবণের মাধ্যমে যন্ত্রনির্ভর অনুবাদ (audible machine-based language translation)। এই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রসার হবে কারণ আমরা এই ডিভাইসের মাধ্যমে ক্রমাগত কথা বলতে পারব যা অনুবাদ করতে পারবে এবং আমাদের কন্ঠকে যেকোনো ভাষায় রূপান্তর করতে পারবে। খুবই চমকপ্রদ, তাই না? এটা সম্পূর্ণ নির্ভর করে আমরা কি আমাদের বুদ্ধিমত্তা কে প্রতিস্থাপিত হতে দিব কি না তার উপর। তবে এটা মানুষের অন্য ভাষা শেখার বিকল্প হতে পারে না। বরং এটা আমাদের জন্য সুযোগ হবে পৃথিবীর আরো মানুষকে জানার এবং গুরুত্বপূর্ণ বার্তা সকলের কাছে আরো দ্রুত পৌছে দেওয়ার জন্য।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দিয়ে অসাধারণ কিছু হতে পারে যদি তার সঠিক ব্যবহার করা যায়। যখন আমরা বুদ্ধিমত্তা বাড়াতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্য নেই, তা আমাদের দক্ষতা বাড়ালেও সে দক্ষতাকে কাজে লাগে না। একে বলে বুদ্ধিমত্তার সম্প্রসারণ (intelligence amplification – IA)। যেমন দৃষ্টি সম্প্রসারণ (augmented vision) এমন একটি ধারণা যাতে যা আমরা ইতিমধ্যেই দেখে ফেলেছি এমন তথ্যই আমাদের সামনে উপস্থাপন করা হয়। এটি কখনো আমাদের নিজস্ব দৃষ্টির বিকল্প হতে পারে না।
আপনার নিজস্ব বুদ্ধিমত্তা অক্ষুণ্ণ রাখার তিনটি উপায়
১. ক্যালকুলেটর ছাড়া হিসাবনিকাশ করুন
ক্যালকুলেটর আমরা ব্যবহার করি সময় বাচানোর ক্ষেত্রে। কিন্তু তার মানে এই নয় যে এটি আমাদের অংক কষার ক্ষমতার পরিপূরক। ক্যালকুলেটর অথবা অন্যান্য গাণিতিক যন্ত্রের উপর নির্ভর না করে যোগ-বিয়োগগুলো নিজে করার চেষ্টা করুন। ২৭৫ দিয়ে ৭ গুণ করলে কত হয়? কিংবা ৩০৯৮ কে ২৩ দিয়ে ভাগ করলে কত? এমন অনেক হিসাবের জন্য আমরা ক্যালকুলেটর ব্যাবহার করে করে নিজেদের দ্রুত হিসাব করার ক্ষমতা যেমন কমিয়ে দিচ্ছি তেমনি নিজের ক্ষমতার উপর বিশ্বাস হারিয়ে ফেলছি। তাই কখনই পুরোপুরি যন্ত্রনির্ভর না হয়ে নিজের ক্ষমতার উপর বিশ্বাস রাখুন।
২. জিপিএস ব্যবহার না করেই ড্রাইভ করুন
গুগল ম্যাপ অথবা ওয়েজ আজকাল অহরহ ব্যবহার হচ্ছে। Uber কিংবা Lyft চালকদের জন্য এটি স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং সিস্টেম। এসকল বুদ্ধিমান অ্যাপ প্রতিনিয়ত খুঁটিনাটি বাঁকগুলোর পাশপাশি বাস্তবিক ছবিসহ আপডেট হচ্ছে। যদি আপনি এটি সবসময় সকল জায়গায় চলার ক্ষেত্রে ব্যবহার করে থাকেন তাহলে শুধু একবার রুট দেখে পরে তা নিজের মন থেকে স্মরণ করে চলুন। বারবার জিপিএস ব্যবহার করলে আপনি এর উপর নির্ভরশীল হয়ে পরবেন। অথবা ম্যাপ বা নেভিগেশন দেখেও চলতে পারেন। ম্যাপ বা নেভিগেশন দেখে চলা পরিপার্শ্বিক দেখে ও বুঝে চলার স্কিল তৈরি করবে, যা জিপিএস ব্যবহারে পাবেন না।
৩. নিয়মিত ব্রেইন টেস্ট করুন
সত্যটা হলো প্রযুক্তির উন্নতির সাথে সাথে আমাদের সামষ্টিক বুদ্ধিমত্তা কমে যাচ্ছে। আমরা অনেক বেশি গ্রহণ করছি। আমরা নিয়মিত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করছি, ইন্টারনেট ব্রাউজিং করছি এবং অনলাইনে অনেক কিছুই পড়ছি। এসকল কাজ পরিমাণে কম কিন্তু একি সময়ে অনেক কাজ করা হচ্ছে। আমরা কোনো কিছুর জন্য গভীরে অনুসন্ধান করছি না, বই পড়ছি না- যা সমস্যা হয়ে দেখা দিচ্ছে। গভীর অনুসন্ধান মস্তিকের অধিক মনোযোগ দেবার করার, স্মরণ করার এবং আগের জ্ঞান সুন্দরভাবে ব্যবহার করার ক্ষমতা বাড়ায়। এজন্য ‘ক্যামব্রিজ ব্রেইন সায়েন্স‘ এর এই টেস্টগুলো ব্যবহার করতে পারেন। যা আপনার ক্ষণস্থায়ী স্মৃতি, যুক্তিবোধ এবং ভাষাগত দক্ষতা কেমন সম্পর্কে ধারণা দিতে পারবে।
ফেসবুক গুগলের মতো লিডিং প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার পেছনে আজ অনেক ব্যয় করছে। আপনি হয়তো বলবেন মানুষের সাধারণ কিছু যোগ্যতা এই ডিজিটাল যুগে অপ্রচলিত হয়ে পরছে। আমরা হয়তো প্রযুক্তির মাধ্যমে অনেক জ্ঞানের শাখায় বিচরণ করতে পারছি, কিন্তু আমরা নিজেদেরুপর বিশ্বাস হারিয়ে ফেলছি। অনেক বেশি প্রযুক্তিনির্ভর হয়ে পরছি।
যাই হোক, এটি সত্যিই লজ্জার হবে যদি পরবর্তী প্রজন্ম নিজে নিজের বাসা চিনে ড্রাইভ করতে না পারে আর সেখানে চালকবিহীন গাড়ি ড্রাইভ করে যেতে পারে।
আসলে আমরা এমন এক যুগে বাস করছি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ছাড়া আমরা এক মুহূর্তও চলতে পারবো না। তাহলে একে ব্যবহার করেও ক্ষতি থেকে বাঁচতে হলে এর নিয়ন্ত্রিত ব্যবহার করতে হবে। এটি একটি বিশেষ ক্ষমতা, কিন্তু সেই ক্ষমতার অপব্যবহার কতটা ধ্বংসাত্মক হতে পারে না নিশ্চয়ই আমরা সকলেই কমবেশি জানি?
Featured Image source- www.beencrypted.com