ফুটবল ইতিহাস বদলে দেওয়া ১০টি গোল

0

ফুটবল গোলের খেলা। ফুটবল মাঠে ২ দলের ২২ জন খেলোয়াড় ৯০ মিনিট ফুটবলের পেছনে মাঠ জুড়ে দৌড়ে বেড়ান শুধুমাত্র গোলের জন্য। গোল কখনো আনন্দের হয়, কখনো গোলও হয় একটি জাতির দুঃস্বপ্নের মূল। ফুটবলের ইতিহাসে এমন কিছু গোল রয়েছে যা বদলে দিয়েছে ফুটবলের ইতিহাস। তৈরি করেছে নতুন ইতিহাস। সেই গোল হতে পারে বিশ্বকাপ ফাইনালের অথবা গোল চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ফাইনালের। ফুটবল ইতিহাসে কয়েক হাজার গোল রয়েছে। কয়েক হাজার গোলের মধ্যে থেকে ইতিহাস বদলে দেওয়া ১০টি গোল বেছে নেওয়া খুবই কঠিন। ফুটবল ইতিহাস ঘেঁটে ১০টি গোল বেছে নেওয়া হয়েছে যেগুলো বদলে দিয়েছে ফুটবলের ইতিহাস।

২০০৫ সালে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ফাইনালে স্টিভেন জেরার্ডের গোল

২০০৫ সালের চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ফাইনাল এসি মিলানের জন্য এক চিরস্থায়ী ক্ষত হয়ে আছে। কিন্তু লিভারপুলের জন্য সেটি অনুপ্রেরণা। তুরস্কের ইস্তাম্বুলে অনুষ্ঠিত ২০০৫ সালে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ফাইনালের ম্যাচটি ইতিহাসের অন্যতম সেরা ফুটবল ম্যাচ। রাফায়েল বেনিতেজের লিভারপুল ছিল সেই ম্যাচে ‘আন্ডারডগ’, অন্যদিকে কার্লো আনচেলেত্তির এসি মিলান ছিলো শক্তিশালী এক দল। প্রথমার্ধে এসি মিলান লিভারপুলকে বিধ্বস্ত করে দিয়ে তার শক্তিমত্তা জানান দেয়। প্রথমার্ধেই ৩-০ গোলে এগিয়ে যায় মিলানের দলটি। কিন্তু দ্বিতীয়ার্ধেই দাবার ঘুঁটি উল্টে যায়।

জেরার্ডের সেই গোল; Source: independent.ie

লিভারপুল মাত্র ৬ মিনিটের মধ্যে ৩ গোল পরিশোধ করে ম্যাচে সমতা আনে। নির্ধারিত সময়ে সমতা থাকায় ম্যাচ গড়ায় পেনাল্টিতে। পেনাল্টিতে লিভারপুল শক্তিশালী এসি মিলানকে হারিয়ে শিরোপা জিতে নেয়। পরবর্তীতে এই ম্যাচটির নাম হয় ‘মিরাকল অব ইস্তাম্বুল’। লিভারপুলের ঘুরে দাঁড়ানোর শুরুর গোলটি ছিল অধিনায়ক স্টিভেন জেরার্ডের। জেরার্ডের গোলটি সত্যিকারের এক ‘মিরাকল’, যে কারণে ম্যান অব দ্য ম্যাচ হয়েছিলেন স্টিভেন জেরার্ড।

২০১৪ বিশ্বকাপ ফাইনালে মারিও গোটশের গোল

বিশ্বকাপ ফাইনালে আর্জেন্টিনা এবং জার্মানির আরও একবার দেখা হয় ব্রাজিলে। দুইদল গোলের জন্য মরিয়া হয়ে খেলতে থাকে কিন্তু কাঙ্ক্ষিত গোলের দেখা কেউ পাচ্ছিলো না।

মারিও গোটশের বিশ্বকাপজয়ী গোল; Source: joe.ie

৮৮ মিনিটে জার্মানির কোচ জোয়াকিম লো মিরোস্লাভা ক্লোসার বদলি হিসেবে মাঠে নামান মারিও গোটশেকে। কোচ অনুপ্রেরণা দেওয়ার জন্য গোটশেকে বলেন,

বিশ্বকে দেখিয়ে তুমি মেসির চেয়ে সেরা।

মারিও গোটশে ১১৩ মিনিটে আর্জেন্টাইনদের হৃদয় চিরে ম্যাচের একমাত্র গোলটি করেন এবং ১৯৯৬ সালের পর জার্মানরা বড় কোনো শিরোপা জয় করে। গুরুর কথা রেখে মারিও গোটশের করা গোলটি ইতিহাস বদলে দিয়েছে কারণ প্রথম বারের মতো ইউরোপের কোনো দল লাতিন আমেরিকায় বিশ্বকাপ জয় করেছে।

২০১৪ সালে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ফাইনালের শেষ মূহুর্তে সার্জিও রামোসের গোল

সার্জিও রামোস রিয়াল মাদ্রিদ এবং স্পেনের এক জীবন্ত কিংবদন্তী। দলের জন্য যখন যেটি প্রয়োজন, রামোস ঠিক সেই কাজটি করতে খুবই পটু। যেমন ২০১৪ সালে উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ফাইনালে অ্যাথলেটিকো মাদ্রিদের বিপক্ষে ম্যাচটির কথাই ধরা যাক। ৯৩ মিনিট পর্যন্ত রিয়াল মাদ্রিদের নগর প্রতিদ্বন্দ্বী অ্যাথলেটিকো মাদ্রিদ ১-০ গোলে এগিয়ে ছিল।

রামোসের সেই গোল; Source: sportskeeda.com

ম্যাচ শেষের মাত্র কয়েক সেকেন্ড বাকি। দিয়েগো সিমিওনির অ্যাথলেটিকে মাদ্রিদ তখন বিজয় উল্লাসের বাঁশি শোনার অপেক্ষায়। কিন্তু সেই মূহুর্তে অ্যাথলেটিকো মাদ্রিদের বিজয় উল্লাসের পথে বাঁধা তৈরি করেন সার্জিও রামোস। রিয়ালের ত্রাণকর্তা হিসেবে ম্যাচে সমতা সূচক গোলটি করেন তিনি। ম্যাচ গড়ায় অতিরিক্ত সময়ে। অতিরিক্ত সময়ে অ্যাথলেটিকো মাদ্রিদকে বিধ্বস্ত করে ৪-১ গোলের মধ্য দিয়ে শিরোপা জিতে নেয় রিয়াল মাদ্রিদ। সার্জিও রামোসের শেষ মূহুর্তের গোল অ্যাথলেটিকো মাদ্রিদের হৃদয় ভেঙে দিয়ে রিয়ালের হয়ে ইতিহাস লেখেন।

বেলজিয়ামের বিপক্ষে পেলের বাইসাইকেল কিকে গোল

ফুটবলে সবচেয়ে আকর্ষণীয় গোল বাইসাইকেল কিকে গোল। ফুটবল ইতিহাসে খুব কম সংখ্যক গোল রয়েছে বাইসাইকেল কিকে। ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো, ইব্রাহিমোভিচ, ওয়েইন রুনি সহ অনেকেই বাইসাইকেল কিকে গোল দিয়েছেন। ফুটবলের রাজা পেলের বাইসাইকেল কিকে গোলটি সবচেয়ে অনন্য।

পেলের সেই বাইসাইকেল কিক; Source: sportskeeda.com

১৯৬৮ সালে বেলজিয়ামের বিপক্ষে বাইসাইকেল কিকে দৃষ্টিনন্দন এক গোল করেন। লেফট উইং থেকে উঁচু করে দেওয়া বলটি শরীরকে হাওয়ায় ভাসিয়ে বাইসাইকেল কিকে গোলটি দেন পেলে। গোলকিপারের সাথে পুরো বিশ্ব পেলের গোলটি দেখে একদম বোকা বনে যান।

লিভারপুলের বিপক্ষে মাইকেল থমাসের শেষ মূহুর্তের গোলে আর্সেনালের লিগ জয়

১৯৮৮-৮৯ সালের ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে আর্সেনাল এবং লিভারপুলের দ্বৈরথ ছিলো দেখার মতো। শিরোপার লড়াইয়ে এগিয়ে থাকা লিভারপুল এবং আর্সেনালের ম্যাচ দিয়ে পর্দা নামে মৌসুমের এবং সেইসাথে বিজয়ী দলের নামও নিশ্চিত হয়। ১৯৮৯ সালের ২৬ মে অ্যানফিল্ডে দুই দল মুখোমুখি হয়। শিরোপা জিততে হলে আর্সেনালকে সেই ম্যাচে ২ গোলের ব্যবধানে জিততে হবে।

মাইকেল থমাস; Source: southlondonclub.co.uk

কিন্তু লিভারপুলের ঘরের মাঠ অ্যানফিল্ডে ‘আন্ডারডগ’ আর্সেনাল পারবে না বলেই ধরে নিয়েছিলো সবাই। কিন্তু ১ গোলে এগিয়ে থাকার পর ৮৯ মিনিটে আর্সেনালের পক্ষে দ্বিতীয় গোল করেন মাইকেল থমাস। লিভারপুলের ঘরের মাঠে লিভারপুলের সমর্থক এবং খেলোয়াড়দের হৃদয় ভেঙে ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের শিরোপা জিতে নেয় গানাররা। সেই মাইকেল থমাস আর্সেলানের চিরস্থায়ী এক ভালোবাসার মানুষে রূপ নেন।

আগুয়েরোর শেষ মিনিটের গোলে ম্যানসিটির শিরোপা জয়

২০১২ সালে সার্জিও আগুয়েরোর গোলে ম্যানচেস্টার সিটি ৪৪ বছর পরে ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের শিরোপা জয় করে। দুর্বল কুইন্স পার্ক রেঞ্জার্স বা কিউপিআরের বিপক্ষে ঘরের মাঠে জিতলেই শিরোপা নিশ্চিত হতো ম্যানসিটির। কিন্তু ৯০ মিনিট পর্যন্ত ২-১ গোলে পিছিয়ে ছিলো ম্যানসিটি। ৯০ মিনিটের পর এডেন জেকো সমতা সূচক গোলটি করার পর ৯৩ মিনিটে আর্জেন্টাইন সুপারস্টার লিগ জয়ী গোলটি করেন।

শিরোপা জয়ী গোলের পর সার্জিও আগুয়েরো; Source: dailymail.co.uk

ইত্তিহাদ স্টেডিয়ামের কানায় কানায় পরিপূর্ণ সিটির সমর্থকরা উল্লাসে মেতে ওঠে। আগুরেরোর সেই গোলে শিরোপা জয়ের পরের মৌসুম থেকে দুর্বল দল থেকে শক্তিশালী দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে ম্যানসিটি।

ওলে গানার সলশেয়ারের গোলে ম্যানইউয়ের চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জয়

অ্যালেক্স ফার্গুসন ১৯৯৯ সালে দারুণ এক মৌসুম কাটিয়েছেন। ম্যানইউয়ের হয়ে ১৯৯৯ সালে ট্রেবল জয় করেছিলেন। কিন্তু চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জয় ছিলো অনেক রোমাঞ্চকর। ক্যাম্প ন্যূতে বার্সেলোনার বিপক্ষে সেমিফাইনালে ভাগ্যক্রমে জয় পায় ফার্গির দল। কিন্তু ফাইনালে বায়ার্ন মিউনিখের বিপক্ষে ১-০ গোলে পিছিয়ে থেকেও ২-১ গোলের জয় তুলে নেয়।

গোলের পর ওলে গানার সলশেয়ার; Source: manutd.com

শেষ ৩ মিনিটে ম্যানইউ বায়ার্নের জালে ২ গোল জড়ায়। ৯০ মিনিটে যখন টেডি শেরিংহাম গোল করে ম্যাচে সমতা আনেন। তখন সবাই ভেবেছিল, ম্যাচ হয়তো পেনাল্টিতেই গড়াবে। কিন্তু সলশেয়ার হয়তো অন্য কিছু ভেবেছিলেন। তাই তো তিনি শেষ মূহুর্তে গোল করে ম্যানইউকে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ শিরোপা এনে দেন। তার কারণেই ১৯৯৯ সালে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড ‘ট্রেবল’ জয় করে।

ইনিয়েস্তার গোলে স্পেনের বিশ্বকাপ জয়

২০১০ বিশ্বকাপ যেমন প্রথমবারের মতো আফ্রিকায় অনুষ্ঠিত হয়েছিলো, তেমনি স্পেনও প্রথমও বারের মতো শিরোপা জয় করে নিয়েছিলো। বিশ্বকাপ জয়ের জন্য স্পেনের সোনালি প্রজন্মের কাছে দক্ষিণ আফ্রিকা বিশ্বকাপ ছিলো সেরা সুযোগ।

গোলের পর আন্দ্রেস ইনিয়েস্তার উল্লাস; Source: aol.co.uk

সেই সুযোগটি কাজে লাগাতে ভুল করেনি স্প্যানিশরা। ফাইনালে আন্দ্রেস ইনিয়েস্তার গোলে প্রথমবারের মতো বিশ্ব জয় করে ইকার ক্যাসিয়াসের স্পেন। তবে ফাইনালে নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে গোলের দেখা পেতে ১১৬ মিনিট পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছে স্পেনকে। ১১৬ মিনিটে আন্দ্রেস ইনিয়েন্তার একমাত্র গোলে বিশ্বকাপ জয়ের মুকুট পড়ে স্পেন ফুটবল দল।

ইউরো ফাইনালে মার্কো ভ্যান বাস্তেনের গোল

নেদারল্যান্ডের মার্কো ভ্যান বাস্তেন ফুটবল ইতিহাসে অন্যতম সেরা এক খেলোয়াড় ছিলেন। নেদারল্যান্ডের এই প্রতিভাবান ফুটবলার ১৯৮৮ সালে ইউরো ফাইনারে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিপক্ষে অসাধারণ এক গোল করেন।

মার্কো ভ্যান বাস্তেনের বিখ্যাত সেই ভলি; Source: irishtimes.com

ভ্যান বাস্তেন ১৯৮৮ সালে ইউরোতে মোট ৫টি গোল করেছিলেন যার মধ্যে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে হ্যাটট্রিক, সেমিফাইনালে জার্মানির বিপক্ষে ১টি গোল এবং ফাইনালে অসাধারণ এক ভলি থেকে অনন্য এক গোল। তার গোলের উপর করে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিপক্ষে ২-০ গোলের জয়ে ইউরো শিরোপা জিতে নেয় নেদারল্যান্ড।

১৯৮৬ বিশ্বকাপে ম্যারাডোনার আলোচিত ২ গোল

আপনি ম্যারাডোনাকে ভালোবাসেন বা নাই বাসেন কিন্তু আপনি তাকে বাদ দিয়ে ফুটবল ইতিহাস রচনা করতে পারবেন না। ১৯৮৬ বিশ্বকাপে ম্যারাডোনা ছিলেন নায়ক এবং খলনায়ক। আর্জেন্টিনার নায়ক ম্যারাডোনা ইংল্যান্ডের কাছে চিরদিনের খলনায়ক হয়েছেন।

ম্যারাডোনার সেই বিখ্যাত ‘হ্যান্ড অব গড; Source: thesefootballtimes.co

১৯৮৬ সালে মেক্সিকোতে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপে ম্যারাডোনার নেতৃত্বে শিরোপা জয় করে আর্জেন্টিনা। ১৯৮৬ বিশ্বকাপ পুরোপুরি নিজের করে নিয়েছিলেন ম্যারাডোনা। বিশেষ করে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে করা ম্যারাডোনার ২টি গোল ফুটবল ইতিহাসে অনন্য হয়ে আছে। প্রথম গোলটি ছিল চরম বিতর্কিত, যেটির নাম হয়েছে ‘হ্যান্ড অব গড’। অপর গোলটিকে বলা হয় সর্বকালের সেরা গোল

১৯৮৬ বিশ্বকাপের সময় আর্জেন্টিনা এবং ইংল্যান্ড ছিল চরম বৈরী ২টি দেশ। ফকল্যান্ড দ্বীপ নিয়ে দুই দেশ যুদ্ধে জড়ায় এবং সেই যুদ্ধে আর্জেন্টিনা হেরে যায়। সেই হারের প্রতিশোধ ছিল ১৯৮৬ বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে জয়। এই ম্যাচে আর্জেন্টিনা একটি ফুটবল দলের চেয়ে দেশটিকে হারানোর প্রতি বদ্ধপরিকর ছিলো। তার নেতা ছিলেন ম্যারাডোনা। ১৯৮৬ বিশ্বকাপকে ম্যারাডোনা রূপ দিয়েছেন সবচেয়ে আলোচিত ১ বিশ্বকাপ।

Featured Image: de.m.wikipedia.org

 

SOURCE: GLAM.WORLD

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *