উইলিয়াম সিলভেস্টার হারলি: অভিনব এক উদ্যোক্তা

হারলি ডেভিডসন মোটরবাইকের কথা নিশ্চয়ই শুনেছেন! এর একজন সহ প্রতিষ্ঠাতা হলেন উইলিয়াম সিলভেস্টার হারলি  আমেরিকার একজন মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার। তিনি ১৮৮০ সালের ২৯ ডিসেম্বর জন্মগ্রহণ করেন এবং মৃত্যুবরণ করেন ১৯৪৩ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর। তিনি বিশ্বখ্যাত হারলি ডেভিডসন মোটর কোম্পানির সহ প্রতিষ্ঠাতা।

শৈশব

১৮৮০ সালের ২৯শে ডিসেম্বর মিলওয়াকি, উইস্‌কন্সিনে উইলিয়াম হারলি সিনিয়র ও ম্যারি স্মিথের ঘরে জন্ম নেন তিনি। ১৮৬০ সালে তারা মা-বাবা ইংল্যান্ড থেকে যুক্তরাষ্ট্রে চলে আসেন। উচ্চাকাঙ্ক্ষী এবং ব্যবসায়িক মনোভাব থাকায় হারলি ১৫ বছর বয়সে সাইকেলের কারখানায় কাজ নিয়ে তিনি তার পেশাজীবন শুরু করেন। ছোটবেলায় তার সাথে তার এক বন্ধুও কাজ করতেন যার নাম ছিলো আর্থার ডেভিডসন। তিনিও হারলির মতো যন্ত্রপাতি দিয়ে কারিগরি কাজ করতে ভালবাসতেন। এছাড়াও তাদের দু’জনেরই সাইকেলের প্রতি ছিলো গভীর ভালোলাগা এবং দু’জনে মিলে মনস্থিরও করেছিলেন যে তারা এমন একটি যান্ত্রিক সাইকেল বানাবেন যা চলাতে সহজ হবে।

ছবিসূত্র: dadsvintageads.blogspot.com

শীঘ্রই তারা দুই বন্ধু গ্যাসোলিন ইঞ্জিন দ্বারা পরীক্ষা নিরীক্ষা শুরু করেন এবং নিজেদের সাইকেলেও তা প্রয়োগ করা শুরু করেন। হারলি তার জীবন উন্নতির পথে নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিলেন।  তাই তিনি যোগ দেন কলেজে।  আর তিনিই তার বংশের প্রথম ছিলেন যিনি কলেজে যোগদান করেছিলেন। এভাবেই তিনি ১৯০৭ সালে ইউনিভার্সিটি অব উইস্‌কন্সিন-ম্যাডিসন থেকে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং এর ডিগ্রী লাভ করেন। কলেজে থাকাকালীন তিনি ম্যাআডিসন আর্কিটেক্টস্‌ অফিস এবং একজন হোটেলের পরিচারক হিসেবে কাপ্পা সিগমা ফ্রেটার্নিটি হাউজে আজ করতেন।

একজন প্রশিক্ষিত নকশাকার হিসেবে হারলি কলেজের পাট চুকিয়ে মিলওয়াকি ফিরে যান এবং তার যান্ত্রিক সাইকেল তৈরি স্বপ্ন পূরণ করার জন্য পুনরায় ডেভিডসনের সাথে কাজ করা শুরু করেন। এরপর তাদের সাথে যোগ দেন ডেভিডসনের বড় দুই ভাই ওয়াল্টার এবং উইলিয়াম। ওয়াল্টার ছিলেন  রেলপথ যন্ত্রচালক, যিনি সেই প্রতিষ্ঠানে একজন দক্ষ কারিগর হিসেবে কাজ করেন এবং উইলিয়াম কাজ করতেন যে ঘরে যন্ত্রপাতি স্থাপন করা হয় সেখানকার মুখ্য কর্মী হিসেবে।

ছবিসূত্র: posters.cz

হারলি ডেভিডসন মোটর কোম্পানি

১৯০৩ সালে এই চারজন মিলে শুরু করেন হারলি ডেভিডসন মোটর কোম্পানি যা তারা ডেভিডসনদের বাসার পেছনের উঠানের ছোট চালায় পরিচালনা করতেন। সেখানে হারলি সবচাইতে বেশি বেতন পেতেন কারণ এই মোটরবাইকের মূল ধারণাটি আসলে তার কাছ থেকেই আসে।

সেই প্রথম বছরে তাদের কোম্পানি তিনটি মোটরবাইক তৈরি করেন যার মধ্যে ছিলো ক্র্যাঙ্ক (যন্ত্রকে ঘোরানোর বাঁকানো হাতল) এবং প্যাডেল এবং ছিলো সিঙ্গেল সিলিন্ডার মোটর।

এর পরবর্তী কয়েক বছর, কোম্পানিটি তাদের মোটরবাইকের ধারণাটি পরিমার্জিত করেন এবং নতুন ব্যবসায়ের দিকে হাত বাড়ান। ১৯০৯ সাল নাগাদ কোম্পানিটির নিজের কারখানা হয়ে যায় এবং তারা পঁয়ত্রিশ জন কর্মীকে নিয়োগ দেন। তারা প্রতি বছর এক হাজারেরও বেশি মোটরবাইক তৈরি করতেন। কোম্পানির অধিকাংশ ক্রমবিকাশেই কৃতিত্বের অধিকারী ছিলেন হারলি। তিনি ছিলেন একজন পরিপূর্ণ ব্যক্তি যিনি বিশ্বের প্রথম দুই সিলিন্ডারযুক্ত মোটরবাইক ইঞ্জিন তৈরি করেন। আর এতে তিনি ব্যয় করেছেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা। এই কাজটি তিনি করেন ১৯০৭ সালে এবং এর মাত্র কয়েক বছরের মধ্যেই তিনি তার প্যাটেন্ট  করা ভি-টুইন ইঞ্জিন কোম্পানিকে উন্নতির পথে নিয়ে যায়। তখন তারা বছরে ৩,২০০ মোটরবাইক তৈরি করেন।

ছবিসূত্র: bankableinsight.com

এর পরবর্তী কয়েক দশকে হারলি ডেভিডসন তাদের বিক্রয় এবং জনপ্রিয়তাতে অনেকটাই এগিয়ে যান। শুধু কি তাই? তাদের এই মোটরবাইকের চাহিদা ছিলো যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীতেও! প্রথমবার যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনী কর্তৃপক্ষ ফরমায়েশ করেন ১৯১৬ সালের মেক্সিকো-যুক্তরাষ্ট্রের সীমান্তের এক খণ্ডযুদ্ধে এবং পরবর্তীতে বিভিন্ন বৈশ্বিক যুদ্ধে।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শুরুতে, কোম্পানির মোট উৎপাদনের অর্ধেকের এক তৃতীয়াংশ যুদ্ধের সহযোগিতার জন্য পাঠানো হয়েছিলো। আর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনী বিদেশে মৈত্রী শক্তির ব্যবহারের জন্য ষাট হাজারেরও বেশি হারলি ডেভিডসন মোটরবাইকের ফরমায়েশ দেন। কোম্পানি এবং সেনাবাহিনীর এই মধ্যকার চুক্তির সবকিছু হারলি নিজেই দেখাশোনা করতেন।

ছবিসূত্র: Pinterest

১৯৫০ সালের দিকে এবং যুদ্ধের পরে শুধুমাত্র তাদের মোটরবাইকই বৈশ্বিক বাজারে যুক্তরাষ্ট্রের একমাত্র মোটরবাইক ছিলো। তার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত হারলি এই কোম্পানির প্রধান প্রকৌশলী এবং কোষাধ্যক্ষ হিসেবে কাজ করেন। যান্ত্রিক বিষয়টি তিনি কোম্পানির সাফল্য ও নিত্য নতুন মোটরবাইকের উদ্ভাবনের মাধ্যমেই প্রমাণ করেন। তিনি শুধু একজন অতীব আগ্রহী রেসারই ছিলেন না, বরং নতুন সব মোটরবাইক পরীক্ষা-নিরীক্ষায় তার গভীর আসক্তি ছিলো।

ব্যক্তিগত জীবন এবং মৃত্যু

হারলি ১৯১০ সালে অ্যানা জ্যাশথুবারকে বিয়ে করেন। এই দম্পতির ছিলো তিন সন্তান- অ্যান মেরি, উইলিয়াম জুনিয়র ও জন। হারলি হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ১৯৪৩ সালের ১৮ই সেপ্টেম্বর মৃত্যুবরণ করেন। তখন তার বয়স ছিলো ৬২ বছর। হলিক্রস সিমেট্রিতে তাকে সমাহিত করা হয়। আর তার সমাধিস্তম্ভ করা হয় মিলওয়াকিতে। অবসর সময়ে তিনি গলফ্‌ খেলতে, শিকার করতে এবং মাছ ধরতে ভালোবাসতেন। এছাড়াও তিনি ছবি আঁকা এবং বন্যপ্রাণী আলোকচিত্রবিদ্যার জন্যও বেশ জনপ্রিয় ছিলেন।

ছবিসূত্র: elystandard.co.uk

সম্মাননা

১৯৯৮ সালে ওহিও, কলোম্বাসে মোটরসাইকেল হল অব ফেইমে তাকে অভিষিক্ত করা হয়। ২০০৩ সালে বিখ্যাত এই মোটরবাইক কোম্পানির শতাব্দী স্মরণে কেমব্রিজশ্যায়ারের লিটলপোর্টে হারলি-ডেভিডসন মূর্তি স্থাপন করা হয়। এই কোম্পানিটির সহ প্রতিষ্ঠাতা উইলিয়াম সিল্ভেস্টার হারলির পিতা উইলিয়াম হারলি ১৮৩৫ সালে লিটলপোর্টের ভিক্টোরিয়া স্ট্রিটে জন্মগ্রহণ করেন। যদিও তিনি পরবর্তীতে ১৮৫৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রে স্থায়ীভাবে থাকার জন্য চলে আসেন।

ছবিসূত্র: YouTube

লেবার হল অব অনার

হারলি, আর্থার ডেভিডসন, উইল্যাম এ ডেভিডসন এবং ওয়াল্টার ডেভিডসন নিজেরাই এটি ব্যবহার করতেন এবং তাদের পণ্যে বিশ্বাস রাখতেন। এছাড়াও তারা তাদের কর্মীদের কাজের প্রতি উৎসর্গ ও মানসম্পন্ন মোটরবাইক উৎপাদনের জন্য বেশ ভরসা করতেন। এই চারজন ব্যক্তিকে তাই লেবার হল অব ফেইম সম্মানে অভিষিক্ত করা হয়।

Feature Image Source: Alchetron

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *