বর্তমান সময়ের মানুষের জীবনের অন্যতম অংশ যানবাহন। বাংলাদেশে মানুষ প্রতিদিন গড়ে দেড় ঘন্টা ব্যয় করে যানবাহনে। তবে ঢাকা শহরে মানুষের যানবাহনে গড়ে আরো একঘন্টা বেশি চলে যায়। কারন হচ্ছে যানজট। অদক্ষ ড্রাইভিং আর ট্রাফিক সমস্যার কারনে আমাদের রাস্তায় যানজট সারাক্ষণ লেগেই থাকে বলা যায়। এখন যদি এই গাড়ি চালনা মানুষের হাত থেকে নিয়ে স্বয়ংক্রিয় সিস্টেমের হাতে ছেড়ে দেওয়া হয় তাহলে কেমন হবে ? খারাপ হবেনা এটুকু নিশ্চিতভাবে বলা যায়।
চলুন জেনে নেওয়া যাক স্বয়ংক্রিয় যানবাহন চালনা প্রযুক্তি আমাদের ভবিষ্যতে কি ধরনের পরিবর্তন নিয়ে আসতে চলছে। অবশ্য এই প্রযুক্তির পুরোদস্তুর ব্যবহার শুরু হওয়ার জন্য আপনাকে অপেক্ষা করতে হবে আরো ৬ – ৭ বছর।
স্বয়ংক্রিয় যানবাহনের ধরন
আমাদের নিকট ভবিষ্যতে স্বয়ংক্রিয় যানবাহন কি ধরনের পরিবর্তন নিয়ে আসবে সে বিষয়ে সরাসরি চলে যাওয়ার পূর্বে চলুন আগে এর ব্যাপারে কিছু বিষয় জেনে নেওয়া যাক। কাজ ও সিস্টেমের উপর নির্ভর করে বর্তমানে ইঞ্জিনিয়াররা স্বয়ংক্রিয় যানবাহনকে পাঁচ ভাগে বিভক্ত করে থাকে।
প্রথম লেভেলটা ক্রুসিং কন্ট্রোল। ক্রুসিং কন্ট্রোল দিয়ে সাধারণত স্থিতিশীল গতি ধরে রাখা বোঝায়। এই ধরনের স্বয়ংক্রিয়তা বর্তমানের সব গাড়িতেই দেখা যায়। এই ধরনের যানবাহনে পা দিয়ে গ্যাস প্যাডালে চাপ দেওয়ার পরিবর্তে ইলেকট্রনিক ভাবে গতি নির্বাচন করা হয়।
পরবর্তী স্তরটি হচ্ছে অভিযোজিত ক্রুসিং কন্ট্রোল। এই সিস্টেমে গাড়ির আরো কিছু ফিচার যুক্ত হয়। যেমন গাড়ি তার ব্যবহারকারী থেকে দূরত্ব উপলব্ধি করার পাশাপাশি নিজ থেকেই গতি বাড়ানো অথবা প্রয়োজনে কমাতে পারে। এছাড়া বিপদ দেখলে ইমার্জেন্সি ব্রেক করারও ক্ষমতা রাখে। বর্তমানে অধিকাংশ গাড়িতে এই টেকনোলজি ব্যবহার করা হয়।
তৃতীয় স্তরটিতে গাড়ির নিজস্বতা থাকবে। ব্যবহারকারীকে লেন পরিবর্তন সতর্কতা, প্রয়োজনে লেন ধরে রাখার পাশাপাশি অভিযোজিত ক্রুসিং কন্ট্রোল তো থাকবেই। নিজ থেকে রাস্তার লেন ধরে রাখা আর গতি নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতার কারনে এই ধরনের গাড়ির চালক কিছুক্ষণের জন্য স্টেয়ারিং থেকে নিজেকে মুক্ত রেখে অন্যান্য কাজ করতে পারে। বর্তমান অত্যাধুনিক লেটেস্ট গাড়িতে এই প্রযুক্তি দেখা যায়।
লোকেশন নির্বাচন করার মাধ্যমে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যাওয়ার সিস্টেম চতুর্থ স্তরের স্বয়ংক্রিয় যানবাহনে থেকে থাকে। এই ধরনের স্বয়ংক্রিয় যানবাহনে চালক থাকেনা। তবে ফেইল সেফ সিস্টেম হিসাবে স্টেয়ারিংয়ের উপস্থিতি রয়েছে।
শেষ স্তরের স্বয়ংক্রিয় যান পুরোপুরি স্টেয়ারিং বিহীন গাড়ি। ভয়েস এবং জিপিএস নির্দেশনার মাধ্যমে এ ধরনের গাড়ি অপারেট হয়ে থাকে।
স্টেয়ারিংবিহীন স্বয়ংক্রিয় যানবাহন কি পরিবর্তন আনবে?
স্বয়ংক্রিয় এই যানবাহনের প্রযুক্তি আমাদের সমাজে বেশ কিছু পরিবর্তন নিয়ে আসবে সেটা চোখ বন্ধ করেই বলা যায়। যেমন :
প্রথম যে পরিবর্তন আসবে সেটা হচ্ছে একাধিক রাস্তা তৈরির প্রয়োজনীয়তা দূর হয়ে যাবে। আর অনেক জায়গা সংরক্ষিত হবে। আমরা যখন গাড়ি চালাই তখন নিরাপত্তার স্বার্থে এক গাড়ি থেকে অন্যটির নির্দিষ্ট পরিমান দূরত্ব বজায় রাখি। যেটা সব গাড়ির মিলিয়ে বেশ অনেকখানি জায়গা বটে। যখন স্বয়ংক্রিয় যানবাহনে আমরা চলাচল করবো তখন সেই দূরত্ব বজায় রাখার প্রয়োজন ঘটবে না। কারন মানুষের এইসব সূক্ষ্ম বিষয় নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষেত্রে বিপদের সম্ভবনা থাকলেও কম্পিউটারের ক্ষেত্রে তেমনটা হয়না। বলা চলে একটি গাড়ি অন্যটির বাম্পারে গা লাগিয়ে চলাচল করতে পারবে।
জ্বালানি সঞ্চয় হবে এই প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে। কারণ তখন অযথা ব্রেক বা থামানোর কোন প্রয়োজন হবেনা।
সময় বাঁচানোর কথা না বললেও নয়। সম্পূর্ণ স্বয়ংক্রিয় যানবাহন যখন চালু হবে তখন এর নিম্ন গতি হবে ২০০ কিলোমিটার। ফলে প্রচুর সময় বাঁচানো সম্ভব হবে। উল্লেখ্য ভার্জিনিয়ায় বর্তমানে পরীক্ষাধীন থাকা স্বয়ংক্রিয় যান ঘন্টায় ২৪০ কিলোমিটার বেগে কোনো সমস্যা ছাড়াই চলাচল করছে।
আমাদের শপিং করার পদ্ধতিতে বিশাল পরিবর্তন ঘটবে। যদিও বর্তমানে অনেকেই অনলাইন ভিত্তিক শপিয়ে নির্ভরশীল হয়ে পড়ছেন, তবে স্বয়ংক্রিয় যানবাহন চলে আসার পর আমরা অনলাইন শপিংয়ে পুরোপুরি নির্ভরশীল হয়ে পড়বো। অর্ডার করা অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই যখন স্বয়ংক্রিয় যান এসে পণ্য দিয়ে যাবে তখন কে ই বা মার্কেটে যাওয়ার ইচ্ছে পোষন করবে!
স্বাস্থ্য সেবা তখন ঘরে ঘরে পৌছে যাবে। বর্তমানে আমাদের হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে যেতে হয় কারন সেখানকার এত বেশি যন্ত্রপাতি বারবার স্থান পরিবর্তন করা সম্ভব নয়। স্বয়ংক্রিয় যানবাহনের ফলে হাসপাতালে যাওয়ার পরিবর্তে তেমন মেডিকাল সার্ভিসে সংবলিত যান আমাদের বাসায় চলে আসবে।
মাইক্রো হোটেলের ব্যবহার বেড়ে যাবে। ধরুন আপনি থাকেন রাজশাহী, আগামীকাল সকাল আপনাকে থাকতে হবে ঢাকা এক জরুরি মিটিংয়ে। তো আপনি কিভাবে আসবেন ? হতে পারে আপনি রাতের কোন ফ্লাইট ধরবেন এরপর ঢাকায় এসে টেক্সিতে করে কোন হোটেলে রাতের বাকিটা কাটিয়ে সকালে আবার টেক্সিতে করে মিটিংয়ে গিয়ে উপস্থিত হবেন।
এখন যদি আপনি এতসব ঝামেলা না করে মাইক্রো হোটেলের সুবিধা পান তাহলে কেমনটা হয় ? ধরুন রাতে আপনি সেই হোটেল ভাড়া করলেন, সারারাত শান্তির ঘুমের পর যখন আপনার সকালে ঘুম ভাঙলো তখন আপনি মিটিংয়ের নির্ধারিত স্থানে। আর যখন হোটেলের মতো সকল সুবিধা সেখানে পাওয়া যাবে তখন কেই বা বিমান, টেক্সি আর আবাসিক হোটেলের ঝামেলায় যেতে চাইবে ?
সবথেকে যে বিষয়টি সমাজে দেখা যাবে সেটা হচ্ছে মানুষের উৎপাদনশীলতার বৃদ্ধি ঘটবে। কারন সময় হচ্ছে অর্থের থেকেও মূল্যবান। যখন আমরা আমাদের সময় সময় বাঁচাতে পারবো তখন সেই সময়টা অন্যান্য উৎপাদনশীল কাজে লাগাবো। ফলে নিজের আর্থিক লাভের বৃদ্ধি তো ঘটবেই সাথে সাথে সমাজের উন্নয়নে মানুষের ভূমিকা আরো জোরদার হবে।