যদি সফল ক্যারিয়ার গড়তে চান তবে দক্ষতা অর্জন ও নিজেকে নির্ভরযোগ্য হিসেবে প্রমাণ করার কোনো বিকল্প নেই। সাধারণত আমরা ভাবি কোনো কাজ শেষ করতে কতোটা সময় লাগতে পারে তার অনুমান নির্ভুলভাবে করা সম্ভব। কিন্তু বাস্তবতা সেরকম নয়।
বাস্তব জগত আর আদর্শ জগতের দূরত্ব
কোনো কাজ শেষ করতে কতোটা সময় লাগতে পারে তার অনুমান ১০০% ঠিক হওয়ার সম্ভাবনা প্রায় শুন্য। কতোটা সময় লাগবে যখন অনুমান করা হয় এবং বাস্তব ক্ষেত্রে তুলনা করে দেখা হয় তখন সেটা হয় বেশি না হয় কম হয়। এটাই স্বাভাবিক। অনুমান আর বাস্তবিক অর্থে কতোটা সময় লাগবে তার পার্থক্য যতো কম হয় ততোই মঙ্গলকর।
কোনো ভুল অনুমান যে এক নিমেষেই আপনার কিংবা আপনার প্রতিষ্ঠানের ধ্বংস ডেকে আনবে, এমনটা কিন্তু নয়। তবে দীর্ঘ মেয়াদে অনেক বড় ক্ষতির কারণ হতে পারে। আশার কথা হলো, যে কোনো সমস্যার মতো এরও সমাধান আছে। ছোট ছোট কিছু বিষয় নিয়ে সচেতন ভাবে চিন্তা করলেই এই ধরণের সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব।
সর্বপ্রথম ১৯৭৯ সালে ড্যানিয়েল কাহ্নেমান এবং আমস তভেরস্ক্য এই বিষয়টি নজরে আনেন। কাহ্নেমান এবং আমস এই মতবাদের নাম দেন ,”দি প্ল্যানিং ফালাসি”।
কাহ্নেমান এবং আমস ব্যাখ্যা করেন,
- যখন আমরা নিজেদের কাজ নিয়ে পরিকল্পনা করি, ইতিবাচক দিকগুলোই বেশি বিবেচনা করি।
- যখন আমরা অন্য কারো কাজের জন্য পরিকল্পনা করি তখন নেতিবাচক দিকগুলোর কথা বেশি চিন্তা করি।
- অধিকাংশ ক্ষেত্রে, একই ধরণের কাজ আগেও হয়ে থাকলে ঐ কাজের অভিজ্ঞতাকে উপেক্ষা করা হয়।
প্ল্যানিং ফালাসি বলে, ভ্রান্ত ধারণা থেকে অনুমান করে কোনো সিদ্ধান্তে গেলে দীর্ঘমেয়াদে সেটা আমাদের জীবনে বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে।
প্ল্যানিং ফালাসির প্রভাব ও এর থেকে মুক্তির উপায়
১. দেরিতে অফিসে পৌঁছানো
প্রতিদিনই ভাবেন সময় মতো অফিসে যাবেন। কিন্তু বিভিন্ন কারনে বাধ্য হচ্ছেন দেরিতে অফিসে পৌঁছাতে। এটা কতোটা প্রভাব ফেলবে আপনার উপর তা নির্ভর করছে কর্মক্ষেত্রে আপনি কোন পদে কাজ করছেন তার ওপর। যদি কর্মচারী পর্যায়ের কেউ হন তবে আপনাকে চাকরিও হারাতে হতে পারে। আর যদি কর্মকর্তা পর্যায়ের কেউ হন তবে সময় সম্পর্কে উদাসীনতা আপনার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও আপনার ক্লায়েন্টদের মধ্যে আপনার প্রতি নেতিবাচক মনোভাব সৃষ্টি করবে। যেটা দীর্ঘ মেয়াদে আপনার ক্ষতির কারণ হবে।
সকালে উঠে প্রস্তুত হয়ে সঠিক সময়ে অফিসে পৌঁছানোর ক্ষেত্রে প্লানিং ফালাসি দূর করার জন্য যে পদক্ষেপ গুলো নেয়া যেতে পারে,
- সকালের রুটিন কাজ গুলো শেষ করতে কতোটা সময় লাগবে তার নির্ভুল ধারণা থাকতে হবে।
- বাসা থেকে অফিসে যেতে কতোটা সময় লাগতে পারে তার নির্ভুল ফলাফলের জন্য গুগল ম্যাপে দেখে নেয়া যেতে পারে।
- আপনার কয়েকদিনের যাতায়াতের অভিজ্ঞতা থেকে মোটামুটি একটা ধারনায় পৌঁছানো যে কতোটা সময় লাগতে পারে। এবং সেই অনুযায়ী প্রস্তুত হয়ে বাসা থেকে বের হওয়া।
- অফিস থেকে বের হবার আগে পথে কোন ধরণের দুর্ঘটনা ঘটেছে কিনা জেনে নিয়ে বের হওয়া।
২. চাকরীর ইন্টারভিউ
চাকরীর ইন্টারভিউ দেওয়ার ও নেওয়ার সময় অতিরিক্ত ইতিবাচক মনোভাব ক্ষতির কারণ হতে পারে। ইন্টারভিউ গ্রহীতার ইতিবাচক মনোভাব ইন্টারভিউ দাতাকে চাকরীটি পাবার ব্যাপারে আশাবাদী করে তুলবে। কিন্তু পরবর্তীতে নেতিবাচক ফলাফল ঐ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে ইন্টারভিউ দাতার মনে। আবার ইন্টারভিউ থেকে সঠিক লোক বাছাই করতে গিয়ে ভুল সিদ্ধান্ত মারাত্মক ক্ষতির কারণ হতে পারে ইন্টারভিউ গ্রহীতার কর্মজীবনের জন্য।
ইন্টারভিউ বোর্ডে প্ল্যানিং ফালাসি থেকে বাঁচার জন্য যে পদক্ষেপ গুলো নেয়া যেতে পারে,
ইন্টারভিউ যিনি নিচ্ছেন ,
- বর্তমানে ঐ অবস্থানে যিনি কর্মরত আছেন তার থেকে ধারণা নিয়ে নেয়া।
- উত্তর একেবারে ১০০% নির্ভুল হলে ধরে নিতে হবে কোনো ফাঁক আছে নিশ্চয়ই।
- আত্মবিশ্বাসের সাথে প্রশ্ন ও উত্তর করতে হবে।
- ইন্টারভিউ বোর্ডে সংশ্লিষ্ট ও যথাযথ প্রশ্ন বাছাই করতে হবে।
ইন্টারভিউ যিনি দিচ্ছেন,
- আত্মবিশ্বাসের সাথে উত্তর দিতে হবে।
- কিছুটা সময় নিয়ে ভেবে নিশ্চিত হয়ে উত্তর করা উচিৎ।
- কতোটা সময় লাগতে পারে এই ধরণের প্রশ্নে একটা ডিজিট ব্যবহার না করে রেঞ্জ হিসেবে উত্তর করার চেষ্টা করুন।
- বন্ধু কিংবা সহকর্মীদের কাছ থেকে জেনে নিয়ে সম্ভাব্য প্রশ্নগুলোর মোটামুটি কী ধরণের উত্তর করা যেতে পারে তার ধারণা নিন।
৩. প্রোফেসনাল বিড (নিলাম)
কাজ কতোটা বেঁধে দেয়া সময়ের মধ্যে করতে পারেন তার উপর নির্ভর করে আপনার প্রতি আপনার প্রতিষ্ঠান কিংবা ক্লায়েন্টের নির্ভরতা। এই ক্ষেত্রে ভুল অনুমান অথবা সঠিক সময়ে কাজটি শেষ করতে না পারা আপনার ক্যারিয়ারকে ধীরে ধীরে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাবে।
আপনি হয়তো শুধু ভুল অনুমান করেছিলেন কিন্তু আপনার ক্লায়েন্ট ভাবতে পারে আপনি ছল চাতুরীর আশ্রয় নিয়েছেন। অনেক সময় আপনার প্রোজেক্ট মাঝপথে বাতিল হয়ে যেতে পারে এবং পরবর্তীতে আপনি আর কাজ নাও পেতে পারেন।
প্ল্যানিং ফালাসি দূর করার জন্য সম্ভাব্য পদক্ষেপ:
- আগের প্রোজেক্ট থেকে ধারণা নিন কতোটা দ্রুততার সাথে আপনি কাজ করতে পারেন এবং এই ক্ষেত্রে আপনার কোন প্রতিবন্ধকতা আছে কিনা ।
- সময় অনুমানের ক্ষেত্রে একটা সংখ্যার চেয়ে পরিসর ব্যবহার করুন (যেমন: ১০ থেকে ১১ সপ্তাহ)।
- যতটা সময় লাগবে তার থেকে একটু বেশি সময় নিন। যেমন- কোন কাজ করতে যদি দুই ঘণ্টা লাগে তবে আপনি তিন ঘণ্টা সময় নিন।
৪. মানদণ্ড নির্ধারণ
যদি ম্যানেজমেন্ট পর্যায়ে কাজ করে থাকেন তবে স্ট্যান্ডার্ড সম্পর্কে আপনার ধারণা থাকতে হবে। কে কতোটুকু দক্ষ, কতোটা সময় নিয়ে একটা কাজ করা উচিৎ, সর্বোচ্চ কতোটা সময় নিয়ে একজন একটা কাজ করতে পারে ইত্যাদি সম্পর্কে নির্ভুল ধারণা আপনার দক্ষতা প্রকাশ করে। সেই সাথে, যে অবস্থানে আছেন তার জন্য আপনি কতোটা উপযুক্ত সেটা প্রমাণ করে।
এই ক্ষেত্রে প্ল্যানিং ফালাসি দূর করার জন্য সম্ভাব্য পদক্ষেপ গুলো,
- কর্মচারীদের দক্ষ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য উদ্বুদ্ধ করুন।
- কতোটা সময় একেকজন কর্মী অবসর পাচ্ছে খেয়াল রাখুন।
- কেউ যদি তার সহকর্মীদের তুলনায় এগিয়ে থাকে সবসময়, তবে তার প্রতি নজর রাখুন।
- ভালো পারফর্মার ও ইনোভেটিভ পারফর্মারদের জন্য পুরষ্কারের ব্যবস্থা করুন।
- ভালো পারফর্মারদের অনুপ্রাণিত করতে তাদের মাধ্যমে অন্যদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা যেতে পারে।
শুধুমাত্র কর্মজীবনে নয় প্ল্যানিং ফালাসির প্রভাব সব ক্ষেত্রেই বিদ্যমান। সফলতার জন্য প্রত্যেককে জানতে হবে কীভাবে ইতিবাচক কিংবা নেতিবাচক মনোভাব কাজের ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলতে পারে এবং কারণ হতে পারে প্লানিং ফালাসির।
Feature Image: ezonomics.com