বর্তমান সময়ে বিশ্বজুড়ে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে ব্লকচেইন প্রযুক্তি। ব্লকচেইনকে আধুনিক কালের এক অভিনব উদ্ভাবন বলা হচ্ছে। ব্লকচেইন তথ্য সংরক্ষণ করার একটি নিরাপদ এবং উন্মুক্ত পদ্ধতি। এ পদ্ধতিতে তথ্য বিভিন্ন ব্লকে একটির পর একটি চেইন আকারে সংরক্ষণ করা হয়। এটি একটি অপরিবর্তনযোগ্য ডিজিটাল লেনদেন, যা শুধুমাত্র অর্থনৈতিক লেনদেনের জন্যই প্রযোজ্য নয়, বরং এ প্রযুক্তি ব্যবহার করে যেকোনো ধরনের কার্যাবলীর তথ্য সংরক্ষণ করা যেতে পারে। ব্লকচেইন এমন একটি বন্টনযোগ্য ডাটাবেজ, যাতে অংশগ্রহণকারী পক্ষগুলোর মধ্যে সব লেনদেনের নথি সংরক্ষণ করে রাখা যায়। প্রতিটি লেনদেন আবার সিস্টেমের সংখ্যাগরিষ্ঠতা দ্বারা যাচাই করা হয়। একবার লেজারে কোনো তথ্য প্রবেশ করলে স্থায়ীভাবে তা থেকে যায় এবং কখনো মুছে ফেলা যায় না।
ব্লকচেইন প্রতিটি একক লেনদেনের যাচাইযোগ্য রেকর্ড নিয়ে গঠিত হয়। এ অন্তর্নিহিত প্রযুক্তি নির্ভুলভাবে কাজ করে এবং বিভিন্ন কাজে ও শিল্পক্ষেত্রে এটির প্রয়োগ করা যেতে পারে। আমি এ আর্টিকেলটিতে আলোচনা করবো, যে ৫ টি শিল্পক্ষেত্রে ব্লকচেইন প্রযুক্তি ব্যবহার করে আমাদের জীবনযাত্রার গতিপথই বদলে দেয়া সম্ভব।
১. ব্যাংকিং খাত
মানুষ তাদের অর্থ নিরাপদে সংরক্ষণ ও লেনদেন করতে ব্যাংকিং সেবা গ্রহণ করে থাকে। কিন্তু এ ব্যাংকিং সেবা গ্রহণ করতে গিয়ে গ্রাহকদের উচ্চহারে চার্জ প্রদান করতে হচ্ছে। এছাড়া অর্থ লেনদেন করতে গিয়েও বিভিন্ন ঝামেলার মুখোমুখি হতে হচ্ছে। প্রয়োজনীয় মূহুর্তে অর্থ উত্তোলন করতে পারছে না। আবার ব্যাংক কর্তৃপক্ষও তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করতে গিয়ে বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। এসব সমস্যার সমাধান করা সম্ভব হবে যদি ব্যাংকিং খাতে ব্লকচেইন প্রযুক্তি ব্যবহার করা সম্ভব হয়। ব্লকচেইন প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ সীমিত খরচে গ্রাহকদের ভালোমানের সেবা দিতে সক্ষম হবে।
ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালানা ও হিসাব রাখা অনেক সহজ হয়ে যাবে। আবার এদিকে গ্রাহকরাও যখন তখন ইচ্ছামতো ব্যাংকিং সেবা সমূহ উপভোগ করতে পারবে।
২. স্বাস্থ্যসেবা ক্ষেত্র
কোনো রোগীকে উপযুক্ত চিকিৎসা সেবা দিতে হলে চিকিৎসককে ঐ রোগীর মেডিক্যাল রেকর্ড সমূহ ভালোভাবে পর্যালোচনা করে দেখার প্রযোজন হয়। যখন কোনো রোগীকে এক চিকিৎসক থেকে অন্য চিকিৎসকের কাছে স্থানান্তরিত করা হয়, তখন অনেক সময়ই রোগীর পুরাতন মেডিক্যাল রেকর্ড সমূহ দেখানো সম্ভব হয় না, এতে ডাক্তারগণও চিকিৎসা সেবা দিতে গিয়ে ঝামেলায় পড়েন। আবার রোগীরাও অনেক সময় ভুল চিকিৎসার শিকার হন। এমন পরিস্থিতি থেকে উদ্ধার পাওয়া সম্ভব হবে, যদি চিকিৎসাক্ষেত্রে ব্লকচেইন প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়।
ব্লকচেইনের সাহায্যে খুবই সহজে রোগীর সব ধরনের মেডিক্যাল রেকর্ড ও ব্যবস্থাপত্র সমূহ সংরক্ষণ করে রাখা যাবে। এতে নিঃসন্দেহে চিকিৎসাক্ষেত্রে এক নতুন দিগন্তের উন্মোচন হবে।
৩. রিয়েল এস্টেট শিল্প
এখন পৃথিবীজুড়ে মানুষের কাছে রিয়েল এস্টেট শিল্প বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। রিয়েল এস্টেট শিল্পে বিভিন্ন ধরনের কাগজপত্র, নথি, দলিলপত্র ও তথ্য সংরক্ষণ করে রাখার প্রয়োজন হয়। কোনো কোনো সময় গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ও দলিলপত্র হারিয়ে গিয়ে কখনো মালিক কর্তৃপক্ষ আবার কখনো কাস্টমাররা বড় আকারের ক্ষতির সম্মুখীন হয়ে থাকে।
আবার কেউ কেউ প্রতারণারও শিকার হচ্ছে। এ ধরনের ক্ষতি সমূহ সহজেই এড়ানো সম্ভব হবে, যদি রিয়েল এস্টেট শিল্পে ব্লকচেইন প্রযুক্তি যুক্ত করা হয়। ব্লকচেইন প্রযুক্তির সাহায্যে যে কোনো ধরনের তথ্য ও কাগজপত্র সহজে ও নিরাপদে সংরক্ষণ করে রাখা যাবে।
৪. মানব সম্পদ শিল্প
মানব সম্পদ শিল্পে কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের নিয়োগ দেওয়ার ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ এসব কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের জীবনবৃত্তান্তসহ বিভিন্ন বিষয়ে তথ্য অনুসন্ধান করে থাকে। তথ্য সংরক্ষণ না থাকায় অনেক সময় কোনো কর্মকর্তা বা কর্মচারী প্রয়োজনীয় তথ্য দিতে ও কাগজপত্র দেখাতে ব্যর্থ হয়। ফলে যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও শুধু তথ্য দিতে ও কাগজপত্র না দেখাতে পেরে কাঙ্ক্ষিত চাকরি পাওয়া থেকে বঞ্চিত হয়।
আবার প্রতিষ্ঠানে কর্মরত কর্মচারী ও কর্মকর্তাদের প্রয়োজনীয় তথ্যাদি ও প্রতিষ্ঠানের হিসাব-নিকাশসহ বিভিন্ন বিষয়ের কাগজ ও নথিপত্র সবসময় নিরাপদে সংরক্ষণ করে রাখাও সম্ভব হয় না। এতে প্রতিষ্ঠানও কোনো কোনো সময় প্রতারণা ও ক্ষতির শিকার হয়। এসব সমস্যার সমাধান করা সম্ভব হবে শুধুমাত্র ব্লকচেইন প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে। কারণ এতে যেকোনো তথ্য ও নথিপত্র খুবই সহজে নিরাপদে ও সারাজীবনের জন্য সংরক্ষণ করে রাখা সম্ভব হবে। ফলে ব্লকচেইনকে ব্যবহার করে মানব সম্পদ শিল্পের অগ্রগতির যাত্রাকে ত্বরান্বিত করা যেতে পারে।
৫. শিক্ষা ক্ষেত্র
শিক্ষা মানব জীবনের অপরিহার্য অংশ। কিন্তু ইচ্ছা থাকলেও সুযোগ সুবিধার অভাবে অনেকের পক্ষেই উচ্চশিক্ষা অর্জন করা সম্ভব হয় না। কিন্তু ব্লক চেইন প্রযুক্তি আপনার উচ্চশিক্ষা অর্জনের স্বপ্নকে বাস্তব রুপ দিতে পারে। কারণ আপনি ঘরে বসেই অনলাইনে ব্লকচেইন প্রযুক্তি ব্যবহার করে সহজে বিদেশ থেকে উচ্চশিক্ষা অর্জন করতে পারেন। আবার বিদেশে থেকে আপনার চাহিদা অনুযায়ী বিষয়ে প্রশিক্ষণও নিতে পারেন। প্রশিক্ষণ ও শিক্ষা অর্জন করতে গিয়ে আপনার ও প্রতিষ্ঠানের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের তথ্য ও কাগজপত্র আদান প্রদান এবং অর্থ লেনদেন করার প্রয়োজন হবে। ব্লকচেইন প্রযুক্তির সাহায্যে এ কাজগুলো নিরাপদে ও সহজেই করতেই পারবেন। ব্লকচেইন ব্যবহার না করে এমন সুযোগ সুবিধা ও সেবা উপভোগ করা প্রায় অসম্ভব।
এছাড়াও শিক্ষা ক্ষেত্রে স্টুডেন্টদের ফলাফলসহ বিভিন্ন কাগজপত্র ও তথ্যাদি এবং শিক্ষকদেরও বিভিন্ন তথ্যপত্র সংরক্ষণ করে রাখতে হয়। এসব কাগজপত্র ও তথ্যদি হারিয়ে গিয়ে অনেকই মহা বিপদের সম্মুখীন হয়। কিন্তু যদি শিক্ষাক্ষেত্রে ব্লকচেইন প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়, তবে সারা জীবনের জন্য নিরাপদে এসব প্রয়োজনীয় তথ্য সংরক্ষণ করে রাখা যাবে। এভাবে ব্লকচেইন আমাদের শিক্ষাখাতে অকল্পনীয় উন্নয়ন ঘটানো সম্ভব হবে।
এসব শিল্পখাতে ব্লকচেইন প্রযুক্তি ব্যবহার করে একদিকে যেমন শিল্পের উন্নয়ন ঘটানো যাবে, তেমনি আবার ব্লকচেইনের অগ্রগতিকে ত্বরান্বিত করা সম্ভব হবে।
Featured Image: Ivedix.com