একটি কুকুর কি অন্য কুকুরকে কৌতুক শোনাতে পারে? কিংবা একটি বিড়াল কি অন্য বিড়ালের কাছে, তার অভিজ্ঞতার গল্প বলতে পারে? এমন ধরনের প্রশ্নের উত্তর হবে, অবশ্যই না। একমাত্র মানুষই অন্য মানুষের সাথে কৌতুক করতে পারে ও বিভিন্ন অভিজ্ঞতার গল্প বলতে পারে। মানুষ এ ধরনের কর্ম সম্পাদন করতে পারে, কারণ মানুষ ভাষা আয়ত্ত্ব করতে পেরেছে। মানুষ ছাড়া অন্য প্রাণীরা ভাষা আয়ত্ত্ব করতে পারে না, এজন্য তারা একে অপরের মধ্যে যোগাযোগ করতে সক্ষম হয় না; এমনটি কিন্তু নয়। মানুষ ব্যতীত অন্য প্রাণীরা অঙ্গভঙ্গি ও শব্দের মাধ্যমে পরস্পর যোগাযোগ স্থাপন করে থাকে। মানুষ ভাষা অর্জন করতে পারে, বিধায় তারা খুব সহজে পরস্পর যোগাযোগ স্থাপন করতে পারে এবং বিভিন্ন কাজকর্ম অনেক সহজেই সম্পাদন করতে পারে।
মানুষ ভাষা অর্জনের এ যোগ্যতা ও দক্ষতা কীভাবে অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে? এমন প্রশ্নে বিশ্বের তাত্ত্বিক ও বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন ধরনের বক্তব্য উপস্থাপন করেছে। মানুষের প্রথম ও দ্বিতীয় ভাষা অর্জন প্রক্রিয়ার মধ্যেও রয়েছে বিস্তর পার্থক্য। প্রধানত আমরা এ আর্টিকেলটির মাধ্যমে জানার চেষ্টা করবো, কীভাবে মানুষ তার প্রথম ভাষা বা মাতৃভাষা আয়ত্ত্ব করে থাকে। একটি মানব শিশুর মাতৃভাষা অর্জন করার প্রক্রিয়া সংক্রান্ত অনুসন্ধান ও তত্ত্ব প্রণয়নের ইতিহাস বেশ সুদীর্ঘ। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য উভয় সমাজের তাত্ত্বিক ও দার্শনিকদের মধ্যে, ভাষা অর্জন সংক্রান্ত বিষয়ে অনুসন্ধানের গভীরতা ও ব্যাপকতা বিশেষভাবে লক্ষণীয়।
খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দীতে গ্রিক দার্শনিক প্লেটো ভাষা অর্জন সংক্রান্ত প্রশ্নের আলোচনায় তুলে ধরেন যে, “একজন মানুষ যে ভাষা বলে থাকে কিংবা বিভিন্ন বস্তুর নামকরণ করে থাকে, তা প্রাকৃতিক বা স্বভাবগত বিষয়; নাকি এ ভাষা ও বস্তুর নামকরণ মানুষ কর্তৃক প্রদত্ত? ভাষা অর্জন প্রাকৃতিকভাবে হলে, তা হবে নিয়মবদ্ধ ও যৌক্তিক। আর বস্তুর নামকরণ ও ভাষা যদি হয় মানুষ কর্তৃক প্রদত্ত ও নির্ধারিত, তবে তা হবে অনিয়মিত ও স্বেচ্ছাচারী।” ভাষা অর্জন সংক্রান্ত বিষয়ে এমন পরস্পর বিপরীত ধারণাকে পুঁজি করে, দুইটি মতবাদ ও দল গড়ে ওঠে। যারা মনে করেন, ভাষা প্রাকৃতিকভাবেই অর্জিত হয় এবং ভাষা হলো যৌক্তিক ও সমরূপ। তাদের বলা হয় সাদৃশ্যবাদী।
আর যারা বিশ্বাস করেন ভাষা প্রাকৃতিক ভাবে পাওয়া যায় না, বরং মানুষের মাধ্যমেই ভাষার জন্ম এবং ভাষা হলো অনিয়মিত ও স্বেচ্ছাচারী, তাদেরকে বলা হয় বৈসাদৃশ্যবাদী। ভাষা অর্জন প্রক্রিয়া সংক্রান্ত বিষয়ে গ্রিক ও ইউরোপীয় দার্শনিক ও তাত্ত্বিকদের বক্তব্য পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, সাদৃশ্যবাদী ধারণার দ্বারাই তারা বেশি প্রভাবিত হয়েছিলেন। ৩৮০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে প্লেটো আরেকটি দার্শনিক সমস্যা তুলে ধরেন, সেটা হলো মানব শিশু কীভাবে অপ্রতুল তথ্য থেকে অল্প সময়ে বেশি জ্ঞান অর্জন করে থাকে? এমন প্রশ্নের সমাধানও তিনি দিয়েছিলেন এভাবে যে, মানুষ জ্ঞান নিয়েই জন্মগ্রহণ করে থাকে, তাই অপ্রতুল তথ্য থেকে অল্প সময়েই অনেক বেশি জ্ঞান অর্জন করতে সক্ষম হয়। অপরদিকে অ্যারিস্টটল মানব মনকে শূন্য শ্লেট বা টেবুলা রাসা হিসেবে আখ্যায়িত করেন। তিনি বলেন ইন্দ্রিয়লব্ধ অভিজ্ঞতাই জ্ঞান ও ভাষা অর্জনের একমাত্র পন্থা। তারপর ব্রিটিশ দার্শনিক জন লক মানব মনকে সাদা কাগজ হিসেবে অভিহিত করেন। তিনি বলেন, মানুষের জীবন এগিয়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গে তার ইন্দ্রিয়লব্ধ অভিজ্ঞতা থেকে অর্জিত জ্ঞান এ সাদা কাগজে লিপিবদ্ধ হয়ে থাকে; যা অ্যারিস্টিটলের টেবুলা রাসা ধারণাটিকে আরো সুপ্রতিষ্ঠিত করে।
এভাবে দার্শনিক, তাত্ত্বিক ও ভাষাবিজ্ঞানীদের দ্বারা বিভিন্ন মতবাদ ও তত্ত্বের জন্ম হয়েছে। ভাষা অর্জন বিষয়ে সব ধারণা ও মতাদর্শ আলোচনা ও পাঠ করা বেশ কষ্টসাধ্য ব্যাপার। তাই আমি আপনাদের বোঝার সুবিধার কথা চিন্তা করে, অন্যতম সেরা তিনটি দার্শনিক মতবাদ ও ধারণা এবং ভাষার বৈশিষ্ট্যসমূহ সম্পর্কে আলোচনা করবো। আপনি যদি এ ৩টি তত্ত্ব ও ধারণা অনুধাবন করতে পারেন, তাহলে মানুষ কীভাবে ভাষা অর্জন করে, তা সহজেই আপনার কাছে বোধগম্য হবে।
ভাষা অর্জন সংক্রান্ত তত্ত্ব
১. আচরণবাদ
মানুষ ক্রমাগত অভিজ্ঞতা লাভের মাধ্যমে জ্ঞান ও ভাষা অর্জন করে থাকে, এমন দার্শনিক ধারণাকে কেন্দ্র করে ১৯০০ সাল থেকে শুরু করে ১৯৫০ সালের মধ্যে আচরণবাদী মতবাদ প্রতিষ্ঠা লাভ করে। আচরণবাদকে আধুনিক তত্ত্বে রূপদানে প্যাভলভ, ওয়ার্টসন, থর্নডাইক ও বিএফ স্কিনার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। আচরণবাদীদের মধ্যে বিএফ স্কিনারই সবচেয়ে বেশি প্রসিদ্ধ তাত্ত্বিক ও মনস্তত্ত্ববিদ। আচরণবাদের মতবাদ অনুযায়ী ভাষাকে একটি আচরণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বিএফ স্কিনার মানুষের আচরণের নিরীক্ষাধর্মী গবেষণার ধারা প্রবর্তন করেন।
তিনি মানব শিশুর মস্তিষ্ককে শূন্য পাত্র হিসেবে অভিহিত করেন। স্কিনারের মতবাদ অনুযায়ী, মানবশিশু শব্দ ও বস্তুর নাম একই সাথে শোনা ও অন্যদের অনুকরণের মাধ্যমে এবং ইতিবাচক ও নেতিবাচক পুরস্কারের (Reinforce) উপর ভিত্তি করে ভাষা অর্জন করে থাকে। ধরুন, বল শব্দটি শোনেনি এমন একজন মানব শিশুকে একটি বল দেখিয়ে যদি জিজ্ঞাসা করা হয়, এটির নাম কী? তখন সে তা চিনতে পারবে না এবং নামও বলতে পারবে না। আর যখন প্রথমবার তাকে বল দেখিয়ে বলে দেয়া হবে, এটির নাম বল, তারপর পরবর্তী সময়ে বল দেখলেই সে বলতে পারবে, এটির নাম বল।
আবার বড়দের ভাষা বলা শুনে তথা অনুকরণের মাধ্যমেও শিশুরা ভাষা আয়ত্ত্ব করে থাকে। অনেক সময়ই শিশুরা ভুলভাবে কোনো শব্দ ও বাক্য উচ্চারণ করে; এমতাবস্থায় অভিজ্ঞরা তাদেরকে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া জানিয়ে থাকে, তখন তারা ঐ শব্দ ও বাক্য আর ভুলভাবে উচ্চারণ করে না, বরং সঠিকভাবে বলার চেষ্টা করে থাকে। আবার শিশু সঠিকভাবে কোনো শব্দ ও বাক্য উচ্চারণ করলে, অন্যদের থেকে ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া পায়; তখন সে ঐ শব্দ ও বাক্য বারংবার বলার মাধ্যমে শিখে ফেলে। এসব প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই একটি মানুষ ভাষা অর্জন করে থাকে।
স্কিনারের মতবাদ অনুযায়ী মানুষের যেকোনো আচরণকে তিনটি অংশে বিভক্ত করা যায়। প্রথমত, বিভাজক উদ্দীপক (Discriminative Stimulus) তথা- যে বিশেষ পরিস্থিতির মধ্যে ব্যক্তি বা প্রাণীটি অবস্থান করছে। দ্বিতীয়ত, আচরণ প্রতিক্রিয়া (Operant Response); এটি হলো এমন আচরণ যা তার পরিণতি বা অবস্থার ভিত্তি পরিবর্তন হয়ে থাকে। আর তৃতীয়ত হলো, পুরস্কারক (Reinforcer) কিংবা শাস্তিদায়ক (Punisher); একটি প্রাণী বা ব্যক্তি যদি কোনো আচরণ করে, ঐ আচরণের প্রতিক্রিয়ায় শাস্তি পায়, তবে তার দ্বারা এমন আচরণ কম ঘটবে আর পুরস্কার পেলে এ আচরণ বেশি ঘটবে।
এ আর্টিকেলটির বাকি অংশ পাবেন ২য় তথা শেষ পর্বে। শেষ পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন।
Featured Image: Cognifit.com