ক্লেউসা মারিয়া: এক সফল নারীর গল্প

৫১ বছর বয়সী ক্লেউসা মারিয়া ব্রাজিলের অন্যতম সফল ব্যবসায়ী ও ‘সোডি ডকস’ নামক কেক শপের কর্ণধার। ব্রাজিলে ক্লেউসা মারিয়ার ‘সোডি ডকস’ নামক কেক শপটির মোট ৩০০টি ব্রাঞ্চ রয়েছে। তবে তার সফলতার গল্পটা কিন্তু কেকের মতো সুস্বাদু ও মিষ্টি ছিলো না। নানা প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে তিনি আজকের এই অবস্থানে এসেছেন। হাজারো সংকটে ঘেরা ছিলো তার  শৈশব। এ এক অন্যরকম বেড়ে ওঠা। দূরন্তপনার রেশ কাটতে না কাটতেই হয় কর্মজীবনের সূচনা।

শৈশবকাল

মাত্র নয় বছর বয়স থেকে তার কর্মজীবন শুরু হয়। অভাবের কারণে তিনি তার শিক্ষাজীবন শেষ করতে পারেননি। যে বয়সে বই নিয়ে স্কুলে যাবার কথা ছিলো, সে বয়সে বইয়ের পরিবর্তে হাতে তুলে নিয়েছিলেন নিড়ানি ও কাঁচি। দক্ষিণ-পূর্ব ব্রাজিলের সাও পাওলো রাজ্যের গ্রামাঞ্চলে ভাড়া নেওয়া একটি ছোট্ট খামারে তিনি তার বাবার সাথে কাজ করতেন।

Image source: exame.abril.com.bn

কিন্তু ১৯৭৮ সালে একটি গাড়ি দুর্ঘটনায় তার বাবা মারা যান। তখন ক্লেউসার বয়স ছিলো মাত্র ১২ বছর। ক্লেউসা বলেন, “বাবা মারা যাওয়ার পড়ে মা আমাদের দশ ভাই বোনকে নিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়লেন। কোনো উপায় না দেখে সামান্য কিছু টাকা নিয়ে আমরা নানা বাড়িতে উঠলাম। কিন্তু মা ভেবে পাচ্ছিলেন না, কীভাবে আমাদের এতো বড় সংসার চালাবেন। আমি চিন্তা করলাম, আমার বাকি নয় ভাইবোনকে লালন পালনে মাকে সাহায্য করা আমারও দায়িত্ব”।

অক্লান্ত পরিশ্রমের দিনগুলো

ক্লেউসা ও তার মা একটি আখের ক্ষেতে কাজ শুরু করলেন। ক্ষেতে তাদের কাজ ছিলো আখ কাটা। দৈনিক ১০ ঘন্টা করে তারা মাঠে কাজ করতেন। সূর্যোদয়ের সাথে সাথে আখের ক্ষেতে তারা কাজ করা শুরু করতেন। ক্লেউসার বয়স যখন ১৭, তখন তিনি বুঝতে পারলেন এভাবে ক্ষেত খামারে কাজ করে কখনো ভাগ্য পরিবর্তন করা সম্ভব নয়। তাই সিদ্ধান্ত নিলেন আর খামারে কাজ করবেন না।

Image Source: sodiedoces.com

এবার ভাগ্য বদলের উদ্দেশ্যে ব্রাজিলের বৃহত্তম শহর সাও পাওলো চলে গেলেন এবং সেখানে একটি ধনী পরিবারে গৃহপরিচারিকা হিসেবে যোগ দিলেন। যেখানে মাত্র তিন জন মানুষের জন্য নয়জন গৃহপরিচারিকা ছিলো। সারা মাসে মাত্র দুদিন ছুটি পেতেন। কাজ করে যা আয় হতো তার পুরোটা গ্রামের বাড়িতে পাঠিয়ে দিতেন। ক্লেউসার মা তখনো আখের খামারে কর্মরত ছিলেন। কিন্তু গৃহপরিচারিকা হিসেবে কাজ করে তিনি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করলেন না। তাই এ কাজটিও ছেড়ে দিলেন।

এবার তিনি একটি শিক্ষামূলক কোর্সে ভর্তি হলেন এবং কোর্সটি সম্পন্ন করলেন। এরপর একটি কোম্পানিতে রিসিপশনিস্ট হিসেবে যোগ দিলেন। কিন্তু তার ইচ্ছে ছিলো নিজের গ্রামে কোথাও চাকরি করা, যাতে করে তিনি তার মায়ের সান্নিধ্যে থাকতে পারেন। তাই ক্লেউসা শহর ছেড়ে আবার গ্রামে চলে গেলেন এবং সেখানের একটি উন্নতমানের কারখানায় কাজ শুরু করলেন।

সফলতার শুরু

১৯৯৫ সালে হঠাৎ করে ক্লেউসা একটি ভিন্নধর্মী অনুরোধ পেলেন। “আমার বসের স্ত্রী কেক বিক্রি করতেন, কিন্তু সেদিন তার পা ভেঙ্গে গিয়েছিলো। তাই তিনি আমাকে অনুরোধ করলেন তার কেকটি বানিয়ে দিতে, কিন্তু কীভাবে কেক তৈরি করতে হয় এ নিয়ে আমার কোনো ধারনাই ছিলো না। তিনি আমাকে বলে দিলেন কীভাবে কেক তৈরি করতে হবে। তার নির্দেশনা অনুযায়ী আমি খুব সুন্দর ও মজাদার কেক বানাতে সক্ষম হই,’’ বললেন ক্লেউসা। বসের স্ত্রী তার কাজে খুশি হয়ে তাকে একটি মিক্সার উপহার হিসেবে দিলেন।

এ মিক্সারটি ব্যবহার করে তিনি আস্তে আস্তে কেক বানিয়ে বিক্রি করা শুরু করলেন। দিনে তিনি
কারখানাতে কাজ করতেন আর রাতে কেক বানাতেন। ধীরে ধীরে তার কেকের গ্রাহকের সংখ্যা বাড়তে থাকলো। এর দুই বছর পর তিনি চাকরি থেকে পদত্যাগ করলেন ও তার এক ভাইয়ের সহযোগিতায় ‘সেন্সাকোস ডকস’ নামে ছোট একটি কেকের দোকান খুললেন। পরবর্তী বছরগুলোতে তিনি কঠোর পরিশ্রম করলেন ও এক দশকের মধ্যে চারটি কেক শপ খুলতে সক্ষম হলেন।

Image source: jornalspnorte.com.br

ক্লেউসা বলেন, “একদিন আমার এক গ্রাহক বললেন, ফ্রাঞ্চাইজিংএর মাধ্যমে আমার ব্যবসাকে আরো প্রসারিত করা উচিত। কিন্তু তখন আমার এ সম্পর্কে কোনো ধারণাই ছিলো না। তাই এ ব্যাপারে ধারণা অর্জন করতে আমি ব্যবসায় শিক্ষা বিষয়ক একটি কোর্স করি। তারপর ফ্র্যাঞ্চাইজার হওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। সেই গ্রাহকই আমাদের প্রথম ফ্র্যাঞ্চাইজি হোন এবং দুই বছরের কম সময়ে আমরা ৫০টির বেশি দোকান খুলতে সক্ষম হই’’।

তারপর কিছু ব্যবসায়িক সমস্যার কারণে ক্লেউসার কোম্পানির নাম পরিবর্তন করে ‘সেন্সাকোস ডকস’ থেকে ‘সোডি ডকস’ রাখা হয়। বর্তমানে ‘সোডি ডকস’ এর বার্ষিক আয় ২০০ মিলিয়ন (reais) রেয়াইস (৬৩ মিলিয়ন ডলার)। ব্রাজিলের ১৩টি রাজ্যে ‘সোডি ডকস’ এর মোট ৩০০টি ব্রাঞ্চ রয়েছে। এখানের প্রতিটি কেকের দাম ৪৩ রেয়াইস থেকে ৭৪ রেয়াইসরের মধ্যে। ‘সোডি ডকস’ এর একটি আউটলেট খুলতে, ফ্রাঞ্চাইজির প্রায় ৪,০০,০০০ রেয়াইস বিনিয়োগ করতে হবে। ‘সোডি ডকস’ এর প্রতিটি ব্রাঞ্চে ১৫ জন করে কর্মচারী নিয়োগ দেয়া হয়।

ক্লেউসা বলেন, “আমার জীবনের দুটো স্বপ্ন ছিলো। প্রথমটি ছিলো আমার মাকে আখের ক্ষেত থেকে দূরে নিয়ে যাওয়া, এবং দ্বিতীয়টি ছিলো আমি ছোটবেলায় যে কাজটি করেছি, তা যেন আমার সন্তানদের কখনোই করতে না হয়”।

তিনি আরো বলেন, “আমি ভীষণ ভয় পেয়েছিলাম যখন আমার খুব দ্রুত উন্নতি হয়েছিল। কারণ তখন আমার যথেষ্ট অভিজ্ঞতা ছিল না এবং আমি যে অর্থ বিনিয়োগ করেছি তা যেকোনো সময় হারাতে পারতাম। কিন্তু একটা সময় আমি বুঝতে পেরেছি যে সবকিছু ঠিকঠাক চলছে, এবং আমি এত দূরে পর্যন্ত আসতে পেরেছি এ কারণে দুশ্চিন্তা বাদ দিয়ে, এবার কৃতজ্ঞ হওয়া উচিত’’।

Featured Image: forbes.uol.com.br

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *