সভ্যতার শুরু থেকেই একজন নারী হয়ে টিকে থাকা ছিল অসম্ভব ভীতিকর, অস্থির এবং উত্তেজনাপূর্ণ। এই আধুনিক যুগে অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রামের ভীতিকর পরিস্থিতি সম্পূর্ণভাবে কেটে যায়নি, নারীদের সমান অধিকার, সমান নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এখনো একটি কঠিন যুদ্ধের মতোই। এই যুদ্ধের মধ্য দিয়েই ধীরে ধীরে বিশ্ব অর্থনৈতিক সমীকরণে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। তবুও দ্রুত পরিবর্তনশীল অর্থনীতির যুগে উদীয়মান বাজারে বিনিয়োগের ব্যাপক বিনিময়ের সহজ সমাধান যেই নারীদের হাতে, তাদের নিয়েই কাজ করতে অপারগ অনেক দেশ। ফলস্বরূপ বহু হাতছাড়া সুযোগের খেসারত দিতে হয় তীব্রভাবে।
যেকোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণে নারী অংশগ্রহণ অত্যন্ত উপকারী; image source: ourworld.unu.edu
এখনো নারীদের বিরুদ্ধে রয়ে গেছে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মডেল। অক্সফামের সর্বশেষ তথ্য থেকে জানা যায় যে বিশ্বের ২০৪৩ জন ধনকুবের এর মধ্যে প্রতি দশজনে নয়জনই পুরুষ। বর্তমানে নারী-পুরুষের বেতন বা চাকরির সুযোগের মধ্যে যেই বৈষম্য রয়েছে তা বন্ধ করতে প্রায় ২১৭ বছর সময় লাগবে। এই অর্থনৈতিক বৈষম্যই ক্ষমতার বৈষম্যের আনয়নকারী। নারীর জীবনের প্রতিটি পর্যায়ে পুরুষকে প্রথমেই এগিয়ে রাখলে থাকলে নারীদের জন্য সমান বিশ্বের স্বপ্ন আমরা কীভাবে দেখতে পারি?
অর্থনৈতিক বৈষম্যই ক্ষমতার বৈষম্যের আনয়নকারী ; image source: inquiriesjournal.com
এই অর্থনৈতিক বৈষম্য তাই আজ নারীবাদী সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এবং সমস্যাগুলো প্রকট হয়ে ওঠে যখন আমরাই এই অনিয়মগুলো নীরবে মেনে নিতে থাকি। যার ফলে আমাদের মতো ৩য় বিশ্বের দেশগুলোতে, যেই মেয়েটির ভাই স্কুলে গিয়ে লেখাপড়া শিখে, তারও বয়স অনেকটা তার ভাইয়ের মতো হবার পরেও তাকে ঘরকন্নার কাজ শিখতে হয়। প্রায় ১০ ট্রিলিয়ন ডলার সমপরিমাণ কাজ নারীরা বিনামূল্যে করে থাকে, যেগুলো আমাদের কাছে ঘরের কাজ হিসেবে পরিচিত। অর্থনৈতিক নীতিনির্ধারকদের নজর এড়িয়ে যায় এই ব্যাপারটিই যে, এই বিনামূল্যের বিনিয়োগগুলো যদি না থাকতো তাহলে আমাদের অর্থনীতির পতন ঘটতো।
প্রায় ১০ ট্রিলিয়ন ডলার সমপরিমাণ কাজ নারীরা বিনামূল্যে করে থাকে ; image source: weforum.org
বিশ্বব্যাংক গণনা করে দেখে যে বিশ্বের ১০৪ টি দেশে আইন প্রণয়ন করে উৎপাদন ও নির্মাণের গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রগুলোতে নারীদের কাজ করতে বাধা দেয়, যার কারণ মূলত অভিভাবকদের সেকেলে চিন্তা ভাবনা। অথচ গ্লোবালাইজেশনের ইতিবাচক পরিবর্তনটি এসেছে লিঙ্গ সমতাতে। লিঙ্গ সমতা বিনিয়োগ শুধু সঠিক এবং ন্যায্য ঘটনা তা নয়, বরং এটি সকলের জন্য কল্যাণকরও বটে। ম্যাককিন্স বিশ্লেষণ- ২০১৫ ৯৫টি দেশের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে দেখায় যে, যদি এসকল দেশের নারীরা পুরুষদের মতো একইভাবে অর্থনীতিতে অংশ নেয়- তাহলে ২০২৫ সালের মধ্যে তাদের চলমান জিডিপিগুলোতে আরো ২৮ ট্রিলিয়ন ডলার যোগ করবে। এজন্য অবশ্যই এই অগ্রগতির পেছনে বাঁধাগুলো নারীকেই তুলে ধরতে হবে। ম্যাককিন্সের রিপোর্টে বলা হয়েছে যে, নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা, প্রজনন স্বাস্থ্যসেবার অভাব এবং শিক্ষায় অসহযোগিতা এবং প্রযুক্তির অসম প্রবেশাধিকার- এসব কিছুই নারী হিসাবে পুরুষের হারে চাকরি খুঁজতে বা অন্যান্য কাজের সুযোগে বাঁধা প্রদান করে।
অর্থনীতির উদীয়মান বাজারে বিনিয়োগের ব্যাপক বিনিময়ের সহজ সমাধান নারীদের হাতে ; image source: lisaliebermanwang.com
অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করতে হলে যা প্রয়োজন, তা হলো- শ্রমিকের জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন এবং সেই লক্ষ্যে মজুরি নির্ধারণ, পাশাপাশি সকলের জন্য উপযুক্ত ও নিরাপদ কাজ নিশ্চিত করা, যেন শ্রমিকেরা একটি শালীন জীবনযাপন করতে পারে। শ্রমিক বলতে কেবল পুরুষ শ্রমিকই নয়, বিশ্বের সকল নারী শ্রমিকেরই এরকম অর্থনৈতিক নিরাপত্তা প্রয়োজন। সকলের সাধারণ ছুটি, মাতৃত্বকালীন ছুটি, ভাতা, বিনামূল্যে চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে হবে অবিলম্বে। জরুরিভিত্তিতে পিছিয়ে পড়া অঞ্চলের মানুষের প্রতি বিশেষ মনোযোগ দিতে হবে। তাদের যৌন শিক্ষা, আইন, নিরাপত্তা, নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্যে প্রস্তুতি, বিশ্বায়নের যুগে নারীদের অপার সম্ভাবনা সবকিছুতেই তাদেরকে অগ্রসর করতে চেষ্টা করতে হবে।
বিশ্বায়নের যুগে নারীদের হাতে রয়েছে অপার সম্ভাবনা; image source: hoteliermiddleeast.com
বিভিন্ন নারী অধিকার সংগঠন সাহসীকতার সাথে নারীদের নানা সমস্যা মোকবেলার কাজ করে আসছে। আমাদের উচিত তাদের সমর্থন করা এবং তাদের কাছ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা। কানাডায় নারীবাদী দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করে নারী সংগঠনগুলোর পরিচালনায় সেই নীতিমালা প্রণয়ন করছে। নারীর ক্ষমতায়ন ও সমান অধিকারের প্রশ্নে ব্যাপক বাজেট নির্ধারণ করে কানাডা বিশ্বের সামনে একটি সফল উদাহরণ দাঁড় করিয়েছে।
কানাডায় নারীর ক্ষমতায়নে বাজেট নির্ধারণ; image source: macleans.ca
নারী অধিকার রক্ষার জন্য কট্টর নারীবাদী হওয়া জরুরি না। দরকার নারীদের প্রতি যথাযথ সম্মান ও মর্যাদা এবং সমান অধিকার নিশ্চিত করার মানসিকতা। তাহলেই সব ক্ষেত্রে নারী মুক্তি সম্ভব।
feature image source: startupdonut.co.uk