উদ্যোক্তাদের হাত ধরেই শিল্প-প্রতিষ্ঠান গুলো সমৃদ্ধ হয়। তবে সব উদ্যোক্তা সমানভাবে অবদান রাখতে পারেন না। আবার এমন কেউ কেউ থাকেন যারা তাদের কর্ম দিয়ে অলংকৃত করেন কোনো শিল্প জগতের রাজার আসন। বিয়ার শিল্পে যিনি রাজত্ব করে গেছেন, তিনি হলেন এ্যালডফাস বুশ। চলুন জেনে নেই এই বিখ্যাত ব্যক্তির কর্মময় জীবনের আদ্যোপান্ত
শৈশব
এ্যাডলফাস বুশ জার্মানির মেনজ শহরের নিকটবর্তী কাস্টেলে ১০ই জুলাই, ১৮৩৯ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা হলেন উলরিচ বুশ আর মাতা হলেন বারবারা পিফিফার। তার পিতামাতার কাছে থেকে তার প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয়। পরে তিনি বেলজিয়ামের বিখ্যাত কলেজ কলজিয়েট ইনস্টিটিউটে পড়ালেখা করেন যা ব্রাসেলসে অবস্থিত। কর্মজীবনের শুরুতে তিনি তার পিতার লাম্বার ইয়ার্ডে কয়েক মাস কাজ করেন। লাম্বার ইয়ার্ডে মূলত কাঠ চেরাই করা হয় এবং কাঠের আসবারপত্র তৈরি করা করা হয়। এরপর তিনি পশ্চিম জার্মানির রাইন নদীর কোলন বন্দরে একটি শিপিং হাউজে কাজ করেন, এখানে থাকাকালীন সময়ে ব্যবসা বাণিজ্য সম্পর্কে তার ধারণা জন্মে।
তিনি ব্যবসায়ীদের কাছে থেকে জানতে পারেন যে আমেরিকা ব্যবসা বাণিজ্যের জন্য বেশ উপযোগী স্থান। ফলে তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন আমেরিকা চলে আসবেন এবং ১৮৫৭ সালে বুশ আমেরিকা সেন্ট লুই সে চলে আসলেন। আসার পরে বুশ কমিশন রো খ্যাত একটি প্রতিষ্ঠানে কাজ করা শুরু করেন। তিনি মূলত জানালা, দরজা, ফ্লোর ইত্যাদি পরিষ্কারের কাজ করতেন, তবে তার কর্ম দক্ষতা ও আচারনিষ্ঠা তাকে সবার নজরে এনে দেয়। তার পিতার মৃত্যুর পর উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া সম্পদ দিয়ে ১৮৫৯ সালে ওয়াটেনবার্গের সাথে যৌথভাবে ব্যবসা শুরু করেন।
বৈবাহিক সম্পর্ক ও উদ্যোক্তা জীবন
এ্যালডফাস বুশের উদ্যোক্তা হওয়ার পিছনে বৈবাহিক সম্পর্কের একটি নিবিড় যোগসূত্র রয়েছে। বুশ যখন সেন্ট লুইসে ব্যবসা করছিলেন, তখন সেখানে এবার্হার্ড এ্যানহিউজার নামে একজন বিখ্যাত ব্যক্তি ছিলেন, যিনি একটি সাবান নির্মাণ কোম্পানির মালিক ছিলেন। এ্যানহিজার বিভিন্ন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের ঋণ প্রদান করতেন। এক পর্যায়ে এ্যানহিউজারের সাথে বুশের পরিচয় ঘটে এবং তাদের মধ্যে খুব ঘনিষ্ট সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ১৮৬১ সালের ৭ ই, মার্চ এ্যানহিউজার তার মেয়ে লিলি কে বুশের সাথে বিয়ে দেন। তখন ব্যবসায়ীক সম্পর্কের পাশাপাশি পারিবারিক সম্পর্কও তৈরি হয়ে যায়। বিয়ের পর বুশ আমেরিকার গৃহযুদ্ধে আর্মি ইউনিয়নের হয়ে যুদ্ধে যোগদান করেন। গৃহযুদ্ধ ও যুদ্ধে যোগদানের ফলে বুশ তার ব্যবসায় বড় ধরণের ক্ষতির সম্মুখীন হয়ে পড়ে।
অপরদিকে এ্যানহিউজার একটি ব্রিউয়ারি কোম্পানি গঠন করেন। এ্যানহিজার এই কোম্পানিকে সঠিক ভাবে পরিচালনা ও তার কাজে সাহায্যের জন্য একজন সৎ, যোগ্য ও কর্মঠ ব্যক্তি খোঁজ করছিলেন। পারিবারিক সূত্র ধরেই বুশ কে তিনি এই কাজের জন্য নিয়োগ দেন। ১৮৬৫ সালে বুশ এই ব্রিউয়ারি কোম্পানির ম্যানেজমেন্টের দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
অসাধারণ নেতৃত্ব গুণাবলি
এ্যানহিউজার কোম্পানির ম্যানেজমেন্টের দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই এই কোম্পানির চেহারা বদলাতে থাকে। তার বৈচিত্র্যময় নেতৃত্ব, বিক্রয় কৌশল, কর্মচারী নিয়োগ পদ্ধতি ও অসাধারণ ব্যবসায়িক জ্ঞান খুব অল্প সময়ে অবিশ্বাস্য সাফল্য এনে দেয়। তিনি ব্রিউয়ারি অফিস ও কারখানাকে নতুন রূপে সজ্জিত করেন যার ফলস্বরূপ তিনি আর্থিক ঋণদাতা সংস্থা বিশেষ করে ব্যাংক গুলোর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হন। ব্যাংক থেকে আর্থিক সহায়তা নিয়ে বুশ কোম্পানির ব্যাপক বিস্তার ঘটান।
বুশের কৌশলপূর্ণ নেতৃত্ব এ্যানহিউজার কোম্পানিকে বিশ্ব দরবারে উজ্জ্বলভাবে মেলে ধরতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। অবশেষে ১৮৭৯ সালে বুশ এই ব্রিউয়ারি কোম্পানির মালিকানা গ্রহণ করেন এবং এ প্রতিষ্ঠানের নামকরণ করা হয় এ্যানহিউজার-বুশ ব্রিউয়ারি কোম্পানি। এরপর থেকে এই কোম্পানির আরও প্রসার ঘটতে থাকে। ১৮৯০ এর দশকে এই প্রতিষ্ঠানটি আমেরিকার বিয়ার শিল্পে রাজত্ব করে।
বিয়ার শিল্পের কিং
বুশ সব সময় চেষ্টা করতেন কিভাবে বিয়ার শিল্পের আরও বেশী উন্নয়ন ঘটানো যায়! সেই লক্ষ্যে তিনি নানা ধরণের প্রযুক্তির ব্যবহার করতে শুরু করেন এবং বিয়ারের জন্য ক্ষতিকর বিষয়গুলো চিহ্নিত করেন এবং সে সমস্যা গুলো সমাধানে আপ্রাণ চেষ্টা করেন।
১৮৭৩ সালে বুশ বেয়ার বোতলের মাধ্যমে বাজারজাত করা শুরু করেন এতে বেয়ার নষ্ট হওয়া অনেক গুণ কমে যায় এবং পৃথিবীর যে কোনো প্রান্তে সরবরাহ করা সহজ হয়ে যায়। ১৮৭৬ সালে বুশ বাডউইজার নামে একটি বিয়ারের ব্রান্ড তৈরি করেন, যার সুখ্যাতি বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পরে এবং এটা বিয়ারের বেস্ট সেলিং ব্রান্ডের খেতাব পেয়ে যায়। বাডউইজারকে বলা হতো বিয়ার অব দ্য কিং। আর এই বিয়ারের আবিষ্কারক ও বিয়ার শিল্পে এ্যাডলফাস বুশের অনবদ্য আবদানের জন্য তাকে বিয়ার জগতের কিং মনে করা হয়।
জনকল্যাণমূলক ও বিবিধ কর্ম
এ্যাডলফাস বুশ শুধুমাত্র একজন উদ্যোক্তাই ছিলেন না, বরং তার কর্মময় জীবন তাকে একজন মানবহিতৈষীর মর্যাদায়ও ভূষিত করেছে। তিনি ১৮৯০ সালে তার কারখানার শ্রমিকদের বিনোদন, অবসরপ্রাপ্তদের সাহায্য ও বিপদগ্রস্তদের সহায়তা করার জন্য হ্যাপিনেস ফান্ড গঠন করেন। তিনি ইউনিভার্সিটি অব মিসৌরিতে একটি মেডিকেল ক্লিনিক স্থাপন করেন।
সায়েন্স, মেডিসিন ও জার্মান ভাষা শিক্ষায় জোর দিতে ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটিতে প্রচুর অর্থ সহায়তা প্রদান করেন। এছাড়াও হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে জার্মান সংস্কৃতির উপর জাদুঘর প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। তিনি দাতব্য প্রতিষ্ঠানে এত অর্থ সাহায্য দিয়েছেন যে, একটা ধর্মীয় গ্রুপ তাকে ফার্স্ট সিটিজেন অব সেন্ট লুইস উপাধিতে ভূষিত করে।
জীবনাবসান ও ইতিকথা
বুশ ১৯০৬ সালে নিউমোনিয়া রোগে আক্রান্ত হন। এরপর থেকে শারীরিক ভাবে দূর্বল হতে থাকেন এবং অবশষে ১০ই অক্টোবর, ১৯১৩ সালে হার্ট এ্যাটাকে দুনিয়া থেকে চির বিদায় গ্রহণ করেন। মৃত্যুর সময় তার সম্পদের পরিমাণ ছিলো প্রায় ৬০ মিলিয়ন ডলার। তার শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে হাজার হাজার মানুষ উপস্থিত হয়, ৩৬ টি শহরে তার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া পালিত হয়। তার সম্মানে সেন্ট লুইসে ৫ মিনিট নিরবতা পালন করা হয়। বুশ পৃথিবীর মায়া ছেড়ে চলে গেলেও তার নাম পৃথিবী থেকে মুছে যায় নাই বরং বিয়ার শিল্প ক্ষেত্রে এ্যাডলফাস বুশ নাম টি উজ্জ্বল হয়ে জ্বলজ্বল করছে।