ইন্টারনেট আসক্তি বর্তমান সময়ের একটি গুরুতর সমস্যা। বহু মানুষ পেশাগত কারণে এবং ব্যক্তিগতভাবে এই আসক্তির শিকার হচ্ছে। সব মনোবিজ্ঞানী এবং চিকিৎসকরা এ ব্যাপারে একমত নাও হতে পারেন। তবে অধিকাংশ মনোবিজ্ঞানীর মতে এ আসক্তিকে গুরুতর আখ্যা দেওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। বস্তুত ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের প্রায় সবাই কমবেশি জানেন ইন্টারনেট তাদের জীবনের গতি-প্রকৃতি এবং চারপাশের পরিবেশ কিভাবে প্রভাবিত করে। আলোচনার গভীরে প্রবেশের আগেই বলে রাখি, আমি কোনো মনোবিজ্ঞানী নই। তবুও চারপাশে দৃশ্যমান সমস্যা থেকে ইন্টারনেট আসক্তি আমার চোখে স্পষ্ট।
আমি এই নিবন্ধটি লিখতে চলেছি তাদের জন্য যারা গভীরভাবে ইন্টারনেটে আসক্ত এবং এই আসক্তি আপনার ব্যক্তিগত জীবনকে নিদারুনভাবে প্রভাবিত করে আপনার ক্ষতি করছে। যারা ঘন্টার পর ঘন্টা ইন্টারনেট ব্যবহার করেন, কিন্তু ব্যবহার শেষে উল্লেখযোগ্য কোনো কাজই খুঁজে পান না তাদের জন্য আজকের এই নিবন্ধ। এই নিবন্ধে আলোচিত বিষয়গুলোর সাথে আপনার নিজের বাস্তবতা মিলিয়ে দেখুন আর সনাক্ত করুন আপনি ইন্টারনেট আসক্ত কিনা।
তবে কোনো বিষয়ের আসক্তি নির্ণয় করা সত্যিই কঠিন হয়ে পড়ে যখন আসক্তির মাত্রা নির্ণয়ের চেয়ে উক্ত বিষয়ে উন্মাদনা বেশি থাকে। তাই এই নিবন্ধটি পড়ার সময় আপনার মনে হতে পারে কোনো কোনো কথা আমরা অতিরঞ্জিত করে বলছি, যা আপনার স্বাভাবিক ইন্টারনেট ব্যবহারকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। কিন্তু না, যথাযথভাবে আপনার সমস্যা নির্ণয় করতে উপসর্গগুলির সাথে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে নিজেকে মিলিয়ে দেখুন।
১. মানুষের চেয়ে কম্পিউটারের সাথে বেশি সময় কাটানো
আপনি কি মানুষের চেয়ে কম্পিউটারের সাথে বেশি সময় কাটান? আপনি হয়তো কাউকে ইমেইল করছেন, বন্ধুদের সাথে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চ্যাট করছেন, আর ভাবছেন আপনি তো মানুষের সাথেই আছেন! আপনি ইন্টারনেটের মাধ্যমে যত আপন জনের সাথেই যোগাযোগ করুন না কেন তাতে কিচ্ছু আসে যায় না। বরং আপনার ইন্টারনেট আসক্তির এটি প্রথম উপসর্গ। আসল কথা হল আপনি মানুষ বাদ দিয়ে কম্পিউটার, ট্যাব, মোবাইল ফোন ইত্যাদি ধাতব যন্ত্রপাতির সাথে বেশি সময় ব্যয় করছেন।
যদি ইন্টারনেট ছেড়ে বাস্তবের রক্ত মাংসের মানুষের সাথে মেশার কোনো কারণ খুঁজে না পান তবে দ্রুত আপনার ব্রাউজারটি বন্ধ করা উচিত এবং একজন চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া উচিত। আপনি হয়ত বলবেন আপনি কম্পিউটার বা ট্যাবে বই পড়ছেন! তবুও বলবো কম্পিউটার ছেড়ে আপনি একটি কাগজে মুদ্রিত বই হাতে তুলে নিন, তাতে আপনার ইন্টারনেট আসক্তি কমবে।
২. ব্যক্তিগত সীমারেখা অতিক্রম করা
ব্যক্তিগত উন্নতির একটি প্রধান নিয়ামক হলো নিজের সীমানা নির্ধারণ করা এবং তার ভিত্তিতেই জীবন পরিচালনা করা। কিন্তু এই ব্যক্তিগত সীমানা নির্ধারণ এবং তা মান্য করা কঠিন হয়ে পড়ে যখন জীবনে কোনো আসক্তি নেমে আসে।
আপনি যদি ভেবে থাকেন বন্ধুদের সাথে বিকালের আড্ডার আগে মাত্র ১ ঘন্টা ইন্টারনেট গেম খেলবেন, কিন্তু এই গেম আপনি শেষ করছেন যখন তাদের আড্ডা শেষ হয়ে তারা যার যার বাড়িতে ফিরে যায়। তাহলে জেনে রাখুন আপনি আসক্ত হয়ে পড়েছেন! নিজের সাথে এই প্রতারণা ইন্টারনেট আসক্তির এটি স্পষ্ট উদাহরণ।
৩. কম্পিউটার ব্যবহার নিয়ে অন্যদের কাছে মিথ্যা বলা
আপনার দৈনন্দিন কম্পিউটার ব্যবহার নিয়ে অন্যদের কাছে মিথ্যা কথা বলছেন! ইন্টারনেট এবং কম্পিউটার আসক্তির দ্বিতীয় প্রধান লক্ষণ হলো নিজের সাথে এই প্রবঞ্চনা বা ছলচাতুরি। আপনার পরিবারের লোক, বিশেষত যারা আপনার কম্পিউটার এবং ইন্টারনেট ব্যবহারের খোঁজখবর নেয়ার চেষ্টা করেন তাদের সাথে আপনি মিথ্যা বলছেন!
আপনি বয়োজ্যেষ্ঠদের বলছেন খুব সামান্য সময় কম্পিউটার ব্যবহার করেন, যে সামান্য সময় বাস্তবে অনেক দীর্ঘ! যদি এমন হয়ে থাকে তবে জেনে রাখুন আপনি নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মারছেন! অভিভাবকদের মিথ্যা বলার মধ্য দিয়ে আসলে নিজের সাথেই আপনি প্রতারণা করছেন, যা আপনার আসক্তি আরও বাড়িয়ে তুলছে।
৪. ইন্টারনেট ছাড়া অসহায় বোধ করা
আপনি কি ইন্টারনেট ছাড়া অসহায় বোধ করেন? ইন্টারনেটের সহচার্য ছাড়া দৈনন্দিন জীবন অসম্পূর্ণ মনে হয়? যদি এমন হয় যে আপনি ইন্টারনেট এবং কম্পিউটার ছাড়া কয়েক ঘন্টাও একা থাকতে পারছেন না তবে জেনে রাখুন আপনি স্পষ্টভাবে ইন্টারনেট আসক্ত।
আপনি কি আপনার জীবনকে অনলাইন নির্ভর বানিয়ে ফেলেছেন? চিন্তা করুন আপনি এক সপ্তাহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আসবেন না, কোনো পোষ্ট লিখবেন না, এটা কি আপনার পক্ষে সম্ভব?
কম্পিউটার, ট্যাব, মোবাইল ইন্টারনেট এইসব থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে নিজেকে যাচাই করে দেখুন আপনি ভালো আছেন কিনা। আপনার শূন্যতা বোধ হয় কিনা।
৫. কম্পিউটারের পেছনে খরচ অন্য সব খরচকে ছাপিয়ে যাওয়া
আপনার কম্পিউটারের হার্ড ড্রাইভ কি পূর্ণ হয়ে গেছে? তারপরও আপনার স্পেস প্রয়োজন! এত ডাটা আপনার কী কাজে লাগে?
তাছাড়া আপনি কি ইন্টারনেট এবং কম্পিউটারের পিছে খরচ করতে করতে অন্যান্য স্বাভাবিক খরচ সামাল দিতে হিমশিম খান? কম্পিউটারের প্রতি অতি উৎসাহ থেকে যদি প্রয়োজনের চেয়ে খরচের মাত্রা ক্রমশ বাড়তে থাকে এবং আপনি অধিক মাত্রায় কম্পিউটার নির্ভর হয়ে পড়েন তবে বুঝতে হবে আপনি কম্পিউটার এবং ইন্টারনেট আসক্ত।
এই নিবন্ধটি শুধুমাত্র কম্পিউটার আসক্তি নির্ণয়ের জন্য লেখা হয়েছে। উপরে উল্লেখিত বিষয়গুলো নিজের সাথে মিলিয়ে দেখুন আর সনাক্ত করুন আপনি ইন্টারনেট আসক্ত কিনা। আমার বিশ্বাস এই নিবন্ধটি আপনাদের ইন্টারনেট আসক্তি নির্ণয়ে সহযোগিতা করবে। পরবর্তী একটি নিবন্ধে কম্পিউটার এবং ইন্টারনেট আসক্তি দূর করার উপায় সম্বন্ধে আলোচনা করার আশা রাখছি।