মাথার উপর যখন বিমান উড়ে যায়, তখন প্রতিটা মানুষ একবার হলেও পাইলট না হতে পারার জন্য আফসোস করে। আপনি যদি তাদের মধ্যে একজন না হয়ে নিজের স্বপ্নের পেছনে ছুটতে চান, তবে আজকের এই লেখাটি আপনার জন্য।
পাইলটের প্রকারভেদ
পাইলট দুই ধরনের হয়ে থাকে।
১. সামরিক পাইলট
২. বেসামরিক পাইলট
সামরিক পাইলট হলেন তারা, যারা বাংলাদেশ নৌবাহিনী, বিমান বাহিনী ও সেনাবাহিনীতে পাইলট হিসেবে কর্মরত থাকেন। আর বেসামরিক পাইলটরা ফ্লাইং স্কুল/একাডেমি থেকে পাশ করে বিভিন্ন এয়ারলাইন্স কোম্পানীতে পাইলট হিসেবে কর্তব্যরত থাকেন।
source: Vedio Block
সামরিক পাইলট
সামরিক পাইলটকে জি ডি পাইলট অথবা জি ডিপি (জেনারেল ডিউটি পাইলট) বলা হয়। এইচএসসি পাশের পর পরই আবেদন করতে হয়। সাধারণত বাংলাদেশ বিমানবাহিনীতে জি ডিপি পোস্টের জন্য নিয়োগ দেওয়া হয়।
নৌবাহিনী ও সেনাবাহিনীতে আবেদন করা যায় না। রিকোয়ারমেন্ট অনুসারে নিয়োগকৃত অফিসারদের থেকে বাছাই করে নেওয়া হয়।
বেসামরিক পাইলট
সামরিক পাইলট ছাড়াও বেসামরিক পাইলট আছেন যারা, তারা ফিক্সড উইং বিমান চালানোতে দক্ষ। বাংলাদেশের এয়ারলাইনসের পাইলটরা সাধারণত বোয়িং ৭৭৭-৩০০ ইআর (Boeing 777-300 ER), বোয়িং ৭৮৭-৮ (Boeing 787-8), বোম্বারডিয়ার ডাস ৮ কিউ ৪০০ (Bombardier Dash 8 Q400), এটিআর ৭২-৫০০ (ATR 72-500), বোম্বারডিয়ের ডাস ৮ (Bombardier Dash 8) ইত্যাদি মডেলের প্লেনে করে যাত্রী পরিবহণ করেন।
হেলিকপ্টারের জন্য কোনো ফ্লাইং স্কুল নেই।
বাংলাদেশে বেসামরিক বিমান চালানোর যাবতীয় কাজ নিয়ন্ত্রণ করে একটি সংস্থা, সিভিল অ্যাভিয়েশন অথোরিটি অব বাংলাদেশ (Civil Aviation Authority of Bangladesh)। এই সংস্থা সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে দেখুন এখানে।
source: Air Craft News
আবেদন যোগ্যতা
মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক বা সমমানের পরীক্ষায় বিজ্ঞান বিভাগ থেকে পাস হতে হবে। উচ্চ মাধ্যমিকে পদার্থবিজ্ঞান ও গণিত বিষয় দুটি থাকতে হবে। পদার্থ ও গণিতে কমপক্ষে ‘বি’ গ্রেড থাকতে হবে। এ ছাড়া ইংরেজি বলা ও লেখায় দক্ষ হতে হবে। যারা স্নাতক শ্রেণিতে পড়ছেন বা পাস করেছেন, তারাও পাইলট কোর্সে ভর্তির আবেদন করতে পারবেন।
ভর্তি পরীক্ষা
পাইলট কোর্সে ভর্তি হতে সবার আগে ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হবে। এ পরীক্ষা হয় দুটি ধাপে- মৌখিক ও স্বাস্থ্য পরীক্ষা। মৌখিক পরীক্ষায় সাধারণত বিজ্ঞান ও সাধারণ জ্ঞানের ওপর প্রশ্ন করা হয়। এটি সংশ্লিষ্ট একাডেমি নিয়ে থাকে। আর স্বাস্থ্য পরীক্ষা হয় সিভিল এভিয়েশন অনুমোদিত ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোতে।
source: Biman Bangladesh Airlines
যেখানে প্রশিক্ষণ নেবেন
১. বাংলাদেশ ফ্লাইং একাডেমি অ্যান্ড জেনারেল এভিয়েশন লিমিটেড
বছরে দুটি সেশনে ভর্তি হওয়া যায়। কোর্সের মেয়াদ তিন বছর। কোর্স ফি ২০ লাখ টাকা। ঠিকানা : বাংলাদেশ ফ্লাইং একাডেমি অ্যান্ড জেনারেল এভিয়েশন, হযরত শাহজালাল ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট (ভিভিআইপি টার্মিনালের ডানপাশে), উত্তরা, ঢাকা। ফোন: ৮৯১৩৭০৯
২. গ্যালাক্সি ফ্লাইং একাডেমি
বছরে তিনটি সেশনে ভর্তি হওয়া যায়। কোর্সের মেয়াদ ১৮ মাস। কোর্স ফি ২৮ লাখ টাকা। ঠিকানা : বাড়ি-২০, লেক ড্রাইভ রোড, সেক্টর-৭, উত্তরা, ঢাকা। ফোন: ৮৯২১২১৮, ০১৬১১০১২৩১২,০১৮১১৪৪৫২২৫,০১৮১১৪৪৫২১৬।
ওয়েবসাইট: http://www.galaxyflyingacademy.com/ইমেইল: [email protected]
৩. আরিরাং এভিয়েশন
বছরে তিনটি সেশনে ভর্তি হওয়া যায়। কোর্সের মেয়াদ ১৮ মাস। কোর্স ফি ৩০ লাখ টাকা। ঠিকানা : বাড়ি ৪২, লেক ড্রাইভ রোড, সেক্টর ৭, উত্তরা, ঢাকা।
৪. এভিয়েশন একাডেমি লিমিটেড
বসতি এভিনিউ, ফ্ল্যাট-এ২, হাউস-১০, রোড-৫৩, গুলশান-২, ঢাকা-১২১২। ফোন : ৮৮৩৫৮৯৭, মোবাইল: ০১৮১৯৪৮৫৩০৮।
source: Anna Aero
গ্রাউন্ড কোর্স
ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণরা পাইলট কোর্স করার যোগ্য বলে বিবেচিত হন। পাইলট হতে পেরোতে হয় তিনটি ধাপ। গ্রাউন্ড কোর্সের পর পেতে হয় এসপি বা স্টুডেন্ট পাইলট লাইসেন্স। এরপর পিপিএল (প্রাইভেট পাইলট লাইসেন্স), আর সবশেষে পেতে হয় সিপিএল বা কমার্শিয়াল পাইলট লাইসেন্স। তিন মাসের থিওরি কোর্সে বিমানের কারিগরি এবং এয়ার ল বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এ ছাড়া এয়ারক্রাফট জেনারেল নলেজ, ফ্লাইট পারফরম্যান্স অ্যান্ড প্ল্যানিং, হিউম্যান পারফরম্যান্স অ্যান্ড লিমিটেশন, নেভিগেশন, অপারেশনাল প্রসিডিউর এবং প্রিন্সিপল অব ফ্লাইটের মতো বিষয়গুলো সম্পর্কে ধারণা দেওয়া হয়।
উড্ডয়ন
গ্রাউন্ড কোর্সের পর সংশ্লিষ্ট একাডেমি লিখিত পরীক্ষা নেয়। পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের সরাসরি বিমান চালনার জন্য সিভিল এভিয়েশনে এসপিএল বা স্টুডেন্ট পাইলট লাইসেন্সের আবেদন করতে হয়। আবেদনের পর সিভিল এভিয়েশন অথরিটি (সিএএবি) পরীক্ষা নেয়। সিএএবির পরীক্ষা এবং সিএমবির (সার্টিফায়েড বাই দ্য মেডিক্যাল বোর্ড) স্বাস্থ্য পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেই কেবল এসপিএল দেওয়া হয়। এ লাইসেন্স দিয়ে ৪০ থেকে ৫০ ঘণ্টা বিমান চালনার সার্টিফিকেট অর্জন করে পিপিএল বা প্রাইভেট পাইলট লাইসেন্সের আবেদন করতে হয়। এ সময় তিন মাসের থিওরি ক্লাসের সঙ্গে একটি ক্রস কান্ট্রি ফ্লাইট (এক জেলা থেকে অন্য জেলায় যাওয়া-আসা) চালানোর অভিজ্ঞতাও অর্জন করতে হয়। এরপর আবারও লিখিত এবং স্বাস্থ্য পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেই মেলে প্রাইভেট পাইলট লাইসেন্স। এ লাইসেন্স দিয়ে কোনো বাণিজ্যিক বিমান চালানো যায় না। তাই পাইলট হিসেবে চাকরির জন্য প্রয়োজন সিপিএল বা কমার্শিয়াল পাইলট লাইসেন্স। এ লাইসেন্স পেতে ১৫০ থেকে ২০০ ঘণ্টা বিমান চালানোর অভিজ্ঞতা থাকতে হয়। এ ছাড়া উত্তীর্ণ হতে হয় লিখিত ও স্বাস্থ্য পরীক্ষায়। পাশাপাশি থাকতে হয় একটি ক্রস কান্ট্রি ফ্লাইট চালানোর অভিজ্ঞতা ও তিন মাসের থিওরি কোর্সের সার্টিফিকেট। সিপিএল পাওয়া মানেই নিশ্চিত চাকরি।
কর্মক্ষেত্র
বর্তমানে দেশে ও বিদেশে দক্ষ পাইলটের বেশ চাহিদা রয়েছে। আন্তর্জাতিক বিমান পরিবহন সংস্থার (দি ইন্টারন্যাশনাল এয়ার ট্রান্সপোর্ট অ্যাসোসিয়েশন) এক রিপোর্টে জানা যায়, বিমান সংস্থাগুলোর নতুন নতুন রুট চালু এবং পুরনো পাইলটদের অবসরে যাওয়ার ফলে প্রতিবছর ১৭ হাজার নতুন পাইলট প্রয়োজন হচ্ছে। এ থেকেই বোঝা যাচ্ছে, আন্তর্জাতিক পরিসরে দক্ষ পাইলটের প্রয়োজন কতটুকু। এটি এমন এক পেশা, যেখানে রচাকরিই প্রার্থী খোঁজে।
source: Qatar Airways
কোর্সের সময়সীমা ও খরচ
বৈমানিক কোর্স করতে দেড় থেকে সর্বোচ্চ তিন বছর লাগে। পিপিএল কোর্স করতে লাগে ছয় মাস। আর সিপিএল কোর্সে সময় লাগে এক বছর। বছরে জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি ও জুলাই-আগস্ট দুটি সেশনে বৈমানিক কোর্সে ভর্তি হওয়া যায়।
প্রতিষ্ঠানভেদে বৈমানিক কোর্সের খরচের কিছুটা তারতম্য হয়। সাধারণত পিপিএল ও সিপিএল কোর্স দুটি শেষ করতে ২০ থেকে ৩০ লাখ টাকা প্রয়োজন। কোর্স ফির বেশির ভাগই খরচ হয় ব্যবহারিক অর্থাৎ ফ্লাইং করতে। সাধারণত প্রতি ঘণ্টা ফ্লাইংয়ের জন্য খরচ পড়ে ১৪ থেকে ১৫ হাজার টাকা।
পারিশ্রমিক
যাত্রী পরিবহনের পাশাপাশি দিন দিন বিমানের সংখ্যা বাড়ছে। বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসসহ বেসরকারি অনেক বিমান সংস্থায় বৈমানিকদের চাহিদা রয়েছে। এসব এয়ারলাইনসে বৈমানিকদের আকর্ষণীয় বেতনে নিয়োগ দেওয়া হয়। বৈমানিকদের পারিশ্রমিক নির্ধারণ করা হয় ঘণ্টা হিসাবে। একজন সিপিএল লাইসেন্সধারী বৈমানিকের মাসিক আয় প্রায় দুই লাখ টাকা। বিদেশি এয়ারলাইনসে এর পরিমাণ আরো বেড়ে যায়।
এই হলো পাইলট হবার বিস্তারিত তথ্য। তবে আর দেরি কেন? আজই শুরু হোক আপনার স্বপ্নের পথে পথচলা।
Feature Image source: Anna Aero.