বেঞ্জামিন ফ্র্যাঙ্কলিন: অনবদ্য অবদানের অমর এক ব্যক্তিত্ব

বেঞ্জামিন ফ্র্যাংকলিন ছিলেন অসাধারণ মন ও তীক্ষ্ণ বুদ্ধির অধিকারী। আর তিনি তার দেশ ও সমাজের কল্যাণে তার এই বৈশিষ্ট্যগুলো বৃহৎ আকারে ব্যবহার করেন। তিনি তার বেশ কিছু উদ্ভাবন যেমন- ফ্র্যাঙ্কলিন স্টোভ, ক্যাথেটার, লাইব্রেরি চেয়ার, ধাপ সিঁড়ি, দ্বিকেন্দ্রী চশমার জন্য পরিচিত। তবে তিনি কখনোই তার এই উদ্ভাবনগুলোর পেটেন্ট করাননি। কারণ তিনি বিশ্বাস করতেন যে, উদ্ভাবনের উদ্দেশ্য কেবল অর্থের উৎস হওয়া নয় বরং জনসাধারণের জীবনযাত্রার মান বাড়ানো।

যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে ফ্র্যাংকলিনের বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। কারণ তিনি স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র এবং সংবিধান দুটোই স্বাক্ষর করেন। তাই যুক্তরাষ্ট্রকে নতুন মোড়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে তাকে বিশিষ্ট ব্যক্তিদের একজন হিসেবে গণ্য করা হয়। আজকে কথা হবে ইতিহাসে অনবদ্য সাক্ষী হয়ে থাকা এই বেঞ্জামিন ফ্র্যাংকলিনকে নিয়েই।

শৈশব

ম্যসাচুসেটসে্‌ জন্মগ্রহণকারী বেঞ্জামিন ফ্র্যাংকলিন খ্রিষ্ট ধর্মে দীক্ষিত হন ওল্ড সাউথ মিটিং হাউজে। তার বাবা জোসিয়া ফ্র্যাংকলিন চাইতেন যে, তিনি একজন যাজক বা পাদ্রি হন। কিন্তু অর্থ সঙ্কটের কারণে তিনি মাত্র দুই বছরই বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করতে পেরেছেন। তিনি পড়তে অনেক ভালোবাসতেন। আর তাই অনেকটা নিজে থেকেই বিস্তৃত পড়াশোনা করে স্বশিক্ষিত হয়েছেন। তার ভাই জেমস্ ছিলেন একজন প্রিন্টার। ১২ বছর বয়সের মধ্যেই তার ভাইয়ের পথ নির্দেশনায় তিনি লেনদেন এবং কারবারের কাজ শিখেন। ১৭ বছর বয়সে তিনি নিজের জীবন গড়ার জন্য বাসা থেকে পালিয়ে ফিলাডেলফিয়ায় চলে যান।

ছবিসূত্র: Visit Philly

পেশা

ফিলাডেলফিয়ায় ফ্র্যাঙ্কলিন বিভিন্ন প্রিন্টের দোকানে কাজ করেলেও খুব বেশি একটা সাফল্য পাননি। তাই এরপর তিনি লন্ডনে চলে যান এবং সেখানে ছাপাখানার অক্ষরস্থাপক হিসেবে আজ করেন। ১৭২৬ সালে তিনি তিনি থমাস ডেনহামের কর্মচারী হয়ে ফিলাডেলফিয়ায় ফিরে যান এবং তার ব্যবসায় দেখাশোনা করেন। ১৭২৭ সালে ২১ বছর বয়সে তিনি জুন্তো নামের একটি গ্রুপ প্রতিষ্ঠা করেন যেখানে সমমনা মানুষেরা পৃথিবীতে পরিবর্তন আনার জন্য একত্রিত হন এবং তাদের সৃজনশীলতা প্রকাশ করেন।

এই জুন্তো গ্রুপের সদস্যরা পড়তে খুব ভালোবাসতেন। তবে সেসময় বই এতটা সহজলভ্য ছিলো না। তাই তারা বিভিন্ন রকমের বই সংগ্রহ করা শুরু করেন। আর এর মাধ্যমেই তারা যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম সদস্য নির্ভর লাইব্রেরি তৈরি করেন। ১৭৩১ সালে তিনি ফিলাডেলফিয়ার লাইব্রেরি কোম্পানির কাছে একটি দলিল স্থাপন করেন এবং এর মধ্য দিয়েই যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা হয়।

তিনি পেনসিলভানিয়া গ্যাজেট নামে একটি পত্রিকা কিনেন এবং ১৭৩৩ সালে সেখানে ‘পুওর রিচার্ডজ অ্যালম্যানাক’ প্রকাশ করেন। এই পত্রিকায় বিভিন্ন ধরনের রেসিপি, ভবিষ্যৎবাণী এবং আবহাওয়ার খবর প্রকাশ করা হতো। ১৭৩৬ সালে তিনি দেশের সর্বপ্রথম অগ্নিনির্বাপক সংস্থা ইউনিয়ন ফায়ার কোম্পানি তৈরি করেন। এই সংস্থাটি সমাজে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখে। তিনি জনসংখ্যাতাত্ত্বিকদের প্রাথমিক গবেষণায় অত্যন্ত নিবিড়ভাবে অবদান রেখেছেন এবং ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা বৃদ্ধির ঘটনা উল্লেখ করেছেন।

তিনি ১৭৪৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের দার্শনিক সমাজ সংগঠন করেন, ১৭৫১ সালে পেনসিলভানিয়া হাসপাতাল স্থাপন করেন এবং ১৭৫২ সালে ফিলাডেলফিয়ায় অগ্নিসংযোগের কারণে ক্ষতিতে বীমার জন্য অবদান রাখেন। এই সংগঠনগুলো আজও রয়েছে। ফ্র্যাঙ্কলিন ১৭৫৩ সালে দ্য রয়েল সোসাইটি অব লন্ডন থেকে কপলি মেডেল পান এবং পরবর্তী সেখানকারই একজন সমগোত্রীয় বা সহকর্মী হিসেবে নির্বাচিত হন।

ছবিসূত্র: Pinterest

তার কাইট গবেষণা প্রমাণ করে যে, বজ্রই বিদ্যুৎ এবং তা বজ্রবহ উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে। একজন রাজনীতিবিদ হিসেবে তিনি তার দেশের অধিকারের জন্য যুদ্ধ করেন। তিনি উপনিবেশ সংঘবদ্ধ করা এবং স্বাধীনতার জন্য একনিষ্ঠভাবে কাজ করেন। ১৭৭৬ সালে ফ্র্যাঙ্কলিন ‘ডিকলেয়ারেশন অব ইন্ডিপেন্ডেন্স’ এর খসড়ায় সহযোগিতা করেন। সেই একই বছর তাকে ফ্র্যান্সের কমিশনার হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। এই দায়িত্বটি তিনি দক্ষতা ও সাফল্যের সাথে পালন করেন।

ছবিসূত্র: YurTopic

মুখ্য কাজ

তার সবচাইতে সফল সাহিত্যিক প্রয়াসগুলোর মধ্যে একটি ছিলো ‘পুওর রিচার্ডস্‌ অ্যালমানাক’ (১৭৩২-১৭৫৮), যা একটি পুস্তিকা হিসেবে প্রকাশিত হয়। এতে ফ্রাঙ্কলিন ‘পুওর রিচার্ড’ ছদ্মনামে লিখেন। ১৭৭১ থেকে ১৭৯০ সাল পর্যন্ত তিনি তার আত্মজীবনী লিখেন যা প্রকাশিত হয় তার মৃত্যুর পর। আজকের দিনেও এই বইটিকে অতুলনীয় ঘরানার হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

তিনি পথ প্রদর্শনকারী হিসেবে বিভিন্ন ধরনের নিখুঁত কাজের দৃষ্টান্ত রেখেছেন। এর মধ্যে ১৭৫৮ সালে প্রকাশিত ‘দ্য ওয়ে টু ওয়েলথ’ উল্লেখযোগ্য। এই বইটি থেকে ব্যক্তিগত আর্থিক সংস্থান পরিচালনা এবং উদ্যোক্তা সম্পর্কিত দক্ষতার বিকাশ ঘটানো সম্ভব।

ছবিসূত্র: Pinterest

ব্যক্তিগত জীবন

ফ্র্যাঙ্কলিন ১৭৩০ সালে তার ছোটবেলার বান্ধবী দেবোরা রিদকে বিয়ে করেছেন। মানবিকতার প্রতি তার ভালোবাসা তাকে সম্প্রদায় বিষয়ক কাজ ও রাজনীতিতে জড়িয়েছেন। এছাড়াও মানুষের জীবনের উন্নয়ন সাধনে সগ্রাম করাটাই ছিলো তার নীতিবাক্য। ৮৪ বছর বয়সে তিনি বার্ধক্য ও শারীরিক অবস্থার কারণে মৃত্যুবরণ করেন। ফিলাডেলফিয়ায় তিনি তার শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন এবং তাকে প্রোথিত করা হয় খ্রিস্টিয় চার্চ বারিয়াল গ্রাউন্ডে। ফ্র্যাঙ্কলিন যুক্তরাষ্ট্রবাসীদের কাছে আদর্শ মানব হিসেবে জর্জ ওয়াশিংটনের তুলনায় কোনো অংশেই কম ছিলেন না। তাই তার চর্চা পুরো জাতিতে সমাদৃত। ফ্রাঙ্কলিন সম্মানে, স্বাধীন প্রকাশনায় শ্রেষ্ঠত্বের স্বীকারোক্তি হিসেবে বেঞ্জামিন ফ্র্যাঙ্কলিন পুরষ্কার দেয়া হয়।

বিভিন্ন ডলার বিল ও ডাকটিকিটে তার ছবি দেখতে পাওয়া যায়। যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন জায়গার নাম যেমন- নর্থ ফ্র্যাঙ্কলিন টাউনশিপ, নেবারাস্কা এবং নর্থ ফ্র্যাঙ্কলিন এবং মেইন তার নামানুসারে রাখা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের ডেলাওয়্যার নদীর উপরে একটি সেতু রয়েছে এবং এটি বেঞ্জামিন ফ্র্যাঙ্কলিন ব্রিজ নামে পরিচিত। এটি ফিলাডেলফিয়া এবং ক্যামডেনের মাঝে সংযোগ স্থাপন করে।

ছবিসূত্র: isaiahdix.com

টুকিটাকি

তিনি দাবা খেলতে খুব ভালোবাসতেন এবং সঙ্গীতের প্রতিও তার বেশ নেশা ছিলো। ফ্র্যাঙ্কলিন বিভিন্ন ধরনের বাদ্যযন্ত্রও বাজাতে পারতেন। শুধু তাই নয়, তিনি প্রতিভা সম্পন্ন গ্রন্থকার ছিলেন এবং বেশ কয়েকটি প্রবন্ধ এবং ব্যাঙ্গাত্মক রচনা লিখেছেন। তিনি বজ্রপাত, বিফকল, হারমোনিকিকা এবনফ ‘ফ্র্যাঙ্কলিন স্টোভ’ সহ অনেক কৌশলী যন্ত্রপাতি উদ্ভাবন করেন। মাঝ বয়স থেকে শুরু করে জীবন সায়াহ্ন পর্যন্ত তিনি মেদবহুলতায় ভুগেছেন। এর থেকে তিনি পরবর্তীতে গেঁটেবাত সহ বিভিন্ন রকম শারীরিক সমস্যার শিকার হন।

তার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া প্রায় ২০,০০০ মানুষ অংশগ্রহণ করেন। বৈদ্যুতিক আধানে (সিজিএস একক) তার নামানুসারে এফআর নামটি ব্যবহার করা হয়। সিদ্ধান্তগ্রহণের চিত্রায়িত পদ্ধতিতে সুবিধা অসুবিধার তালিকা তৈরির পদ্ধতিটি তিনিই প্রথম চালু করেন। ১৭৭২ সালে জোসেফ প্রিস্‌লির লেখা একটি চিঠির মাধ্যমে এর প্রমাণ মিলে।

Feature Image Source: Medium

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *