বিশ্বজুড়ে সর্বাধিক বিক্রিত ৫টি উপন্যাস

বিশ্বজুড়ে কত শত সহস্র গল্প-উপন্যাস রচিত হচ্ছে রোজ। কিন্তু তার কয়টি হয়ে থাকছে কালজয়ী? গঠনগত ও আকারে গল্পের সাথে উপন্যাসের বেশ ফারাক আছে। প্রেক্ষাপট, কাহিনী, লেখনীর জোরে অনেক উপন্যাস বেঁচে থাকে বছরের পর বছর। শত বছর আগে লেখা হলেও এখনও সমান আবেদন নিয়ে প্রতিটি শব্দ পড়েন পাঠকেরা। একটি ভাষায় লেখক লিখেন বটে, কিন্তু বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদ হয়ে লাখো কোটি বই পৌঁছে যায় পাঠকের কাছে। জেনে নিন এ যাবৎকালের সর্বাধিক বিক্রিত ৫টি উপন্যাস সম্পর্কে।

{ "slotId": "2452885053", "unitType": "in-article" }

১. ডন কুইক্সোট, মিগুয়েল ডি সারভান্তেস

সংখ্যার দিক দিয়ে সর্বাধিক বিক্রিত ও এই তালিকার সবচেয়ে পুরনো বইটির নাম ডন কুইক্সোট। মূলত শিশুকিশোরদের পাঠ্য হলেও নানা অ্যাডভেঞ্চারে ভরা এই বইটি সব বয়সের পাঠকদের মনোরঞ্জন করতে সক্ষম। তা না হলে প্রথমবার প্রকাশের প্রায় ৪০০ বছর পরে বইটি আজোও সর্বাধিক বিক্রিত বই হিসেবে থাকতো কী করে? স্প্যানিশ লেখক মিগুয়েল ডি সারভান্তেস বইটি লেখেন ১৬০৫ সালে। রেনেসাঁর সেই যুগে মুদ্রণশিল্পের বিকাশ অর্থাৎ লেখা ছাপানো শুরু হয়েছে একটু একটু করে। ১৬০৫ সালে স্প্যানিশ ভাষায় প্রথমবার প্রকাশিত হওয়ার সাথে সাথে বইটি জনপ্রিয়তা লাভ করে। সে বছরই বইটির ৬টি মুদ্রণ বের করতে হয়।

৪০০ বছর পুরনো এই বইটির আবেদনই বিশ্বজুড়ে সর্বাধিক। ছবিসূত্র-spiritofsatire

ডন কুইক্সোট একজন সাহসী লোকের অভিযানের গল্প। স্পেনের লা মাঞ্চায় প্রায় সারাজীবন কাটিয়ে দেওয়া মানুষ এলসো কুইজানো। হঠাৎ করেই তার মাথায় ভুত চাপে দুনিয়া থেকে পাপ দূর করার। অস্ত্র ও যুদ্ধবিদ্যায় নিজে নিজেই প্রশিক্ষণ নিয়ে নিজের একান্ত একজন সহচরকে নিয়ে বেরিয়ে পড়েন পৃথিবীর বুকে। কিন্তু পাপী ও অপরাধীদের সাথে পেরে ওঠাও তো চাট্টিখানি কথা নয়।

বিভিন্ন রকম অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে আগাতে থাকে তার অভিযান। ভাগ্যের কি পরিহাস দেখুন, জীবদ্দশায় অর্থকষ্টে মারা যান সারভান্তেস। প্রকাশকদের সাথে জটিল চুক্তির গ্যাঁড়াকলে পড়ে নিজের বইয়ের লভ্যাংশ তার ভাগে জোটেনি। কিন্তু সেই ১৭শ শতক থেকে আজ পর্যন্ত প্রায় ৩০টি ভাষায় ৫০ কোটিরও বেশিবার বইটি বিক্রি ও তার চেয়ে বেশিবার পঠিত হয়েছে। সাবলীল বর্ণনায় লেখা এই বইটিকে বলা হয় আধুনিক উপন্যাসের প্রথম সফল প্রচেষ্টা হিসেবে ধরা হয়।

{ "slotId": "", "unitType": "in-article", "pubId": "pub-6767816662210766" }

২. এ টেল অব টু সিটি’স, চার্লস ডিকেন্স

চার্লস ডিকেন্স- আমরা অনেকেই হয়তো এই বিখ্যাত লেখককে চিনে থাকবো। অলিভার টুইস্ট, ডেভিড কপারফিল্ড, গ্রেট এক্সপেক্টেশনের মতো কালজয়ী সব বইয়ের স্রষ্টা ডিকেন্স ছিলেন বহুমুখী প্রতিভাধর। লেখালেখির পাশাপাশি ছবিও আঁকতেন ভালো। আসলে ডিকেন্সকে অমর করে রাখার ক্ষেত্রে তার ছবি আঁকার প্রতিভাই ক্রীড়ানকের ভূমিকা রেখেছিলো। শৈশব থেকেই অভাব, ঋণ আর আর্থিক অনটনে বেড়ে উঠেছিলেন ডিকেন্স। সংসার চালাতে কাজ করতে হতো কৈশোর থেকেই, তাই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষালাভ খুব বেশিদূর আগায়নি। কর্মজীবনে পেশাদার আঁকিয়ে হিসেবে কার্টুন আঁকতে শুরু করেন একটি পত্রিকায়। বেশকিছু জনপ্রিয় বই লেখার পরে ৩৮ বছর বয়সে ফ্রান্স বিপ্লবের উপরে লিখলেন এ টেল অব টু সিটি’স।

Cover
হাতে আঁকা ছবি দিয়ে করা বইটির প্রচ্ছদ। ছবিসূত্র-victorianweb

ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের বিভিন্ন শ্রেণীপেশার মানুষের গল্প, বিশেষ করে অভিজাত ও শ্রমিক শ্রেণীর চিরায়ত দ্বন্দ্ব তুলে ধরলেন তার উপন্যাসে। প্রথমে পত্রিকায় সাপ্তাহিকভাবে বেরোতে শুরু করলে ব্যাপক পাঠকপ্রিয়তা পায় এটি। এরপর ১৮৬০ সালের দিকে বই আকারে মুদ্রিত হলে বইটি গোটা ইউরোপজুড়েই সাড়া ফেলে দেয়। যদিও সঠিকভাবে সংখ্যা নির্ণয় করা সম্ভব না, তবুও আনুমানিক ২০ কোটিরও বেশি কপি বিগত ১৫০ বছর বিক্রি হইয়েছে বিশ্বজুড়ে।

৩. দ্য আলকেমিস্ট, পাওলো কোয়েলহো

বিখ্যাত লাতিন লেখক পাওলো কোয়েলহোর ব্যাপকভাবে পঠিত বই এটি। ১৯৮৮ সালে প্রকাশের পর থেকে বিশ্বজুড়ে প্রায় অর্ধশতাধিক ভাষায় অনুবাদ হয়ে কোটি কোটি পাঠকের কাছে পৌঁছেছে উপন্যাসটি। সান্তিয়াগো নামের এক স্প্যানিশ যুবকের গল্প এটি, স্বপ্নে দেখা একটি দৃশ্য তাকে তাড়িত করে ঘর ছেড়ে বেরোনোর জন্য। স্পেনের সবুজ তৃণভূমি ছেড়ে তাকে পাড়ি দিতে হয় মিশরের মরুভূমি, পিরামিডের অবাক করা দৃশ্য, সহ্য করতে হয় প্রবল ধূলিঝড়।

সবচেয়ে বিখ্যাত ল্যাটিন আমেরিকান বই। ছবিসূত্র- bbncommunity

উপন্যাসটির একটি লাইন বিশ্বজুড়ে ব্যপক জনপ্রিয়, ”যদি তুমি মন থেকে কিছু পেতে চাও, পুরো বিশ্ব তোমাকে সেটি পেতে সাহায্য করবে।” এই লাইনটি পরবর্তীতে অনেক সাহিত্য ও চলচ্চিত্রে এমনকি বিজ্ঞানের ক্ষেত্রেও ব্যবহৃত হয়। মনের ইচ্ছাকে তুলনা করা হয় রসায়নবিদ্যার সাথে, যে বিদ্যা তামাকে সোনায় পরিণত করতে সক্ষম। অনেক বিখ্যাত ব্যক্তিত্বের পছন্দের বই এই ‘দ্য আলকেমিস্ট’।

৪. হ্যারি পটার এ্যন্ড দ্য ফিলোসফার’স স্টোন, জে কে রাউলিং

হ্যারি পটারের নাম শোনেনি এমন পাঠক খুব কমই আছে। বইটি হ্যারি পটার নামের এক কিশো্রের জীবনের অদ্ভুত কাহিনী ও যাদুবিদ্যার মিশেলে এক দারুণ উপন্যাস। মজার ব্যাপার, বিশ্বজুড়ে ব্যপক জনপ্রিয়তা পাওয়া এই বইটি লিখে শেষ করার পর প্রকাশক পাচ্ছিলেন না রাউলিং। অনেকে একে গাঁজাখুরি, উদ্ভট বলে উড়িয়ে দেন। এদিকে নিজের লেখার ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসী রাউলিং হাল ছাড়েননি। একের পর এক প্রকাশকের দ্বারে প্রত্যাখ্যাত হলেও ছোটখাটো একটি প্রকাশনা সংস্থা ‘ব্লুমসবেরী’ তার লেখায় আগ্রহ দেখায়। বই বের হওয়ার আগে তাকে ২,৪০০ ডলার অগ্রীম দেন প্রকাশক। এদিকে বই বের হওয়ার অল্প দিনের মধ্যেই প্রথম সংস্করণ শেষ হয়ে যায়।

হ্যারি পটার সিরিজের প্রথম বই। ছবিসূত্র- kelseyrolfe

শুধু শিশু-কিশোরই না, বইটির অপূর্ব কাহিনীবিন্যাসে মজে যান বিভিন্ন বয়সের পাঠক। উপন্যাসটি বই আকারে প্রকাশিত হওয়ার পর থেকে এযাবৎ প্রায় ১১ কোটিরও বেশিবার বিক্রিত হয়েছে বইটির মূল প্রিন্ট। তাছাড়া বিভিন্ন ভাষায় অনুদিত হয়ে কোটি ডলারের বেশি আয় করেছে বইটি। এটির জনপ্রিয়তার ধারায়  পরবর্তীতে বের হয় হ্যারি পটার সিরিজের আরো বই। বইগুলো থেকে তৈরি চলচ্চিত্রগুলোও বিশ্বজুড়ে ব্যপক জনপ্রিয়।

৫. দ্য লিটল প্রিন্স, এন্তোওনি দ্য সেইন্ট জুপেরী

এন্তোওনি জুপেরী নিজেই যেন এক প্রিন্স। তার নিজের গল্পও কম রোমাঞ্চকর নয়। জন্ম ও বেড়ে ওঠা ফ্রান্সের এক ধনাঢ্য পরিবারে। ফ্রান্সের পতনের পরে চলে যান যুক্তরাষ্ট্রে। সেখানে শুরু করেন লেখালেখি। ১৯৪২ সালে ফরাসী ভাষায় লিখলেন ‘দ্য লিটল প্রিন্স’। সেটিরই ইংরেজী অনুবাদ প্রকাশ পায় ১৯৪৩ সালে। মূলত বইটি বিশ্বব্যাপী আলোড়ন তোলে ১৯৪৬ সালে মূল ফরাসীতে প্রকাশের পর। কিন্তু নিজের লেখার বিশ্বব্যাপী কদর দেখে যেতে পারেননি সাহিত্যের এই প্রিন্স সেইন্ট জুপেরী। জানতেন বিমান চালনার খুটিনাটি, ছিলেন দক্ষ বৈমানিক। ২য় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন জার্মানির একটি অঞ্চল পরিদর্শনের মিশনে ১৯৪৪ সালে  তাকে শেষ দেখা গেছে। পরবর্তীতে তার বা তার বিমানের কোনো হদিস পাওয়া যায়নি। এই ঘটনার পরই মূলত সাহিত্যমহলে আলোচনায় আসেন জুপেরী।

দ্য লিটল প্রিন্স। ছবিসূত্র-flavorwire

লিটল প্রিন্স বইটি মূলত শিশুতোষ গল্পের আদলে লেখা এক গভীর জীবনবোধের উপন্যাস। ভীনগ্রহের এক প্রিন্সের সাথে দূর্ঘটনাকবলিত এক পাইলটের কথোপকথন ও বিভিন্ন ঘটনা দিয়ে সাজানো উপন্যাসটিতে সহজভাবে ব্যক্ত হয়েছে মানব চরিত্রের নানা দিক। ভাগ্যের পরিহাসে তার লেখা চরিত্রের মতোন নিজেকেও পড়তে হয়েছিলো বিমান দুর্ঘটনায়। প্রায় ৫০ বছর পরে ফ্রান্সের মারসেইলিস উপকূলে মাছ ধরার জাল থেকে পাওয়া যায় জুপেরীর বিশ্বযুদ্ধের মিলিটারি আইডি ব্রেসলেট। গবেষকরা আন্দাজ করেন, হয়তো বিমান দুর্ঘটনাতেই আছড়ে পড়েছিলেন এই সৃষ্টিশীল মানুষটি। আজ পর্যন্ত প্রায় ২৫০টি ভাষায় অনুদিত ও আনুমানিক ২০ কোটি কপি বিক্রি হয়েছে বইটির।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *