বগুড়ার ছেলে শাহীনূর আলম জনি। তিনি বিশ্বের শীর্ষ এবং সবচেয়ে আকাঙ্ক্ষিত বিশ্ববিদ্যালয় এমআইটির স্লন স্কুল অফ ম্যানেজমেন্ট থেকে Advanced Certificate for Executives (ACE) এবং হার্ভার্ড বিসনেস স্কুল থেকে General Management Program (GMP ) কমপ্লিট করেছেন সাথে এমআইটি ও হার্ভার্ড অ্যালামনাই হিসেবে নিজেকে চিহ্নিত করতে পেরেছেন, যেটা বাংলাদেশি হিসেবে সম্মানের বিষয়।

বর্তমানে তিনি ‘এরিকসন’ (Ericsson), ইউরোপের ‘সলিউশন ও প্রোগ্রাম ডিরেক্টর হিসেবে কর্মরত এবং ‘ইয়ুথ কার্নিভাল’ নামক একটি সামাজিক সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা, যার ফেসবুক ফলোয়ার সংখ্যা ২৭ লক্ষ।

প্রকৌশলী শাহীনূর আলম জনি বলেন, বাংলাদেশের প্রচুর কৃতি সন্তান আজ পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে শীর্ষপদে কাজ করছেন, তবুও আমাদের দেশে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা অস্বাভাবিকরকম বেশি। মূলত এই শিক্ষিত তরুণদের সাথে বাংলাদেশের এই কৃতি সন্তানদের মেলবন্ধনের উদ্দেশ্যেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ইয়ুথ কার্নিভাল। ইয়ুথ কার্নিভালের মূল লক্ষ্য বিপুল এই জনগোষ্ঠীকে জনশক্তিতে রূপান্তরিত করা।

তাছাড়া, ১৯ বছর ধরে ৫৬টি দেশে ১২০ টি মাল্টিমিলিয়ন অ্যাকাউন্ট বা প্রজেক্টকে নেতৃত্ব দেওয়ার অভিজ্ঞতা রয়েছে শাহীনূর আলমের। ১৮০টার বেশি প্রোফেশনাল সার্টিফিকেশন, ট্রেনিং ও কোর্স করেছেন তিনি।

চাকরির পাশাপাশি বিশ্বের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে লেখাপড়া করেছেন শাহীনূর আলম জনি। কখনো বিজনেস, কখনো অত্যাধুনিক প্রযুক্তি, যেমন আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স, মেশিন লার্নিং, ন্যাচারাল ল্যাঙ্গুয়েজ প্রসেসিং, বিগ ডাটা, IOT, ক্লাউড কম্পিউটিং, রোবোটিক্স, 5G ইত্যাদি নিয়েও পড়াশোনা ও কাজ করতে পছন্দ করেন। একটি মজার বিষয় হলো, তিনি দেশের বাইরে থাকলেও বাংলাদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের অসংখ্য শিক্ষার্থীদের কাছে তিনি বেশ জনপ্রিয়। সবাই তাকে ‘জনি ভাই’ বলেই চেনেন।

তিনি প্রজেক্ট ম্যানেজমেন্ট, অপারেশনাল এক্সিলেন্স, সংবেদনশীল বিপণন, মার্কেট অ্যানালাইসিস, ইকোনমিক্স, ফিনান্স, স্ট্র্যাটেজি, ডিস্ট্রোপটিভ ইনোভেশন ও ক্যাশফ্লো এই সবের ফ্রেমওয়ার্ক নিয়ে কাজ করেন। তিনি একইসাথে বৈচিত্র্যময় এবং উচ্চ পারফরম্যান্স টিমকে লিড করে ইনোভেটিভ ও উদ্ভাবনী কাজ এবং নতুন নতুন দক্ষতা অর্জন করতে পারদর্শী।

শাহীনূর আলম জনি বগুড়া জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। বগুড়ার স্বনামধন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বগুড়া জিলা স্কুল থেকে মাধ্যমিক এবং বগুড়া ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করেন। এরপর ১৯৯৭ সালে তৎকালীন বিআইটি, খুলনা অর্থাৎ খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুয়েট) তড়িৎ কৌশল বিভাগে (Electrical and Electronics Engineering) ভর্তি হন। 

কুয়েটে চান্স পাওয়ার পর সবাই বলতেন–এই বিষয় পড়ে লাভ নেই, চাকরি পাবে না। আবার সিভিল না নিয়ে EEE নেবার পর পরিচিত ইঞ্জিনিয়াররা বলেছিলেন–নিজের হাতে জীবন ধ্বংস করেছো, কোথাও ভালো চাকরি পাবে না। ৭ম সেমিস্টারে আন্ডারগ্র্যাড থিসিসে মোবাইল টেলিকমের লিস্টেড ২-৩টার মধ্যে একটি নেওয়ার প্রবল ইচ্ছা থাকার পরও নিতে পারেননি। অতঃপর পাওয়ার সিস্টেমের উপর থিসিস করেছেন। 

২০০২ সালে স্নাতক সম্পন্ন করেন। এরপর থেকেই মোবাইল কোম্পানিগুলোতে চাকরির চেষ্টা শুরু করেন। শুরু দিকে তেমন ভালো সাড়া পাননি। অধিকাংশ কোম্পানি ইন্টারভিউয়ের জন্য ডাকতো না। আবার যেগুলোতে ডাক পেতেন, সেগুলোতে লিখিত পরীক্ষা ভালো হলেও ইন্টারভিউ সঠিকভাবে আগাতো না। গ্র্যাজুয়েশন শেষে বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার’ হিসেবে যোগদানের মাধ্যমে ক্যারিয়ার শুরু করেন। কিন্তু চাকরির খোঁজ চলতে থাকে।  Cisco আর CCNA এর খোঁজ পেয়ে ট্রেনিং করে ফেলেন ও সার্টিফিকেট নেন। 

এরপর চাইনিজ টেলিকম ভেন্ডর ZTE করপোরেশন্স কোম্পানিতে সার্ভিস ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে যোগদান করেন। এরপর হুয়াওয়ে বাংলাদেশে কিছু দিন চাকরি করেন এবং চীনে হুয়াওয়ের হেড কোয়ার্টারে ট্রেনিং ও OJT করেন। এরপর তিনি এরিকসন বাংলাদেশে যোগদান করেন এবং টেলিকম নেটওয়ার্ক ট্রান্সফরমেশন প্রজেক্টে কাজ করেন ও মালয়েশিয়ায়ও ট্রেনিং নেন। 

এরিকসন বাংলাদেশে কাজ করার সময় কীভাবে সিভি লিখতে হয় ইন্টারন্যাশনাল জবের জন্য, কীভাবে ইন্টারভিউয়ের মুখোমুখি হতে হয় এই বিষয়গুলোতে জ্ঞান অর্জন করেন বিদেশি সহকর্মীদের কাছ থেকে। সঠিক চ্যানেলে সঠিক সিভি পাঠানোর পরপরই ইন্টারভিউতে ডাক পেয়ে যান। তারপর তার প্রযুক্তিগত জ্ঞান ও সফল ইন্টারভিউয়ের কারণে দুবাই এরিকসন ও মিশর এরিকসনে চাকরি পান। অনেক খোঁজ-খবর নিয়ে এরিকসন দুবাইয়ে যোগদান করেন কনসালটেন্ট হিসেবে, টেলিকম নেটওয়ার্ক ট্রান্সফরমেশন উইথ IP নেটওয়ার্কিং ও 3G নিয়ে কাজ করেন এবং আইভোরি কোস্ট ও নাইজেরিয়ায় 3G নিয়ে কাজ করেন।

চাকরির পাশাপাশি Cisco আর CCNP ও PMI এর PMP নিয়ে পড়াশুনা চালিয়ে যান। ২০১০ সালে ভারতের Airtel এর 3G প্রজেক্টের জন্য তিনি মনোনীত হলেও সেসময় দুর্ভাগ্যক্রমে ভিসা পাননি। স্বাভাবিকভাবেই খুব খারাপ একটা সময় তিনি পার করছিলেন, কিন্তু ভেঙে পড়েননি, থেমে থাকেননি। অলসভাবে বসে থেকে সময় নষ্ট না করে নিজেকে সামনে এগিয়ে নেওয়ার জন্য আরও বিকশিত করার জন্য CCDP, CCIP এবং PMP সার্টিফাইড হন। 


তথ্যপ্রযুক্তি ভিত্তিক অনেক পড়াশোনা করতে থাকেন। পাশাপাশি বিভিন্ন মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিগুলোতে আবেদন করতে থাকেন। এক পর্যায়ে ভাগ্যের দুয়ার খুলে যায়। ২০১১ সালে তিনি এরিকসন চায়নায় যোগদান করার সুযোগ পান এবং সবচেয়ে বড় বিষয় তিনিই প্রথম বাংলাদেশি, যিনি এরিকসন চায়নায় কাজ করার সুযোগ পান। 

চীনে তিনি ২০১১ এবং ২০১৩ তে দুইবার ‘Best Employee’ হিসেবে আখ্যায়িত হন। কথায় আছে- ‘পরিশ্রম কখনো বৃথা যায় না’। আজ হোক কাল হোক সফলতা আসবেই, ঠিক যেমনটি পেয়েছিলেন শাহীনূর আলম জনি। 

জনি বললেন, ২০১২ সালে গ্রিসের একটি প্রজেক্ট করার শেষভাগে আমাদের দলনেতা আমাকে ডাক দেন, স্থানীয় এক ক্রেতাকে অনসাইট সাপোর্ট দেওয়ার জন্য। কিন্তু চাইনিজ অপারেশন হেড আমাকে না পাঠিয়ে একজন জুনিয়র চাইনিজ ইঞ্জিনিয়ারকে পাঠান। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, জুনিয়রদের কাজ শিখতে হবে বেশি বেশি। আর তুমি তার কাজ দেখাশোনা করো, যেন সে কোনো সমস্যায় না পড়ে। এর পরপরই পোল্যান্ডের পলকমটেলে অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা চলছিল। কোনো চাইনিজ যেতে রাজি হচ্ছিলো না। তাছাড়া স্থানীয় ক্রেতারা চাইনিজদের সিভি দেখে বাদ দিয়ে দিচ্ছিল। এ দিকে কাউকে না কাউকে পাঠাতে তো হবেই। অগত্যা আমাকেই পাঠানো হলো। এদিকে স্থানীয় সেই ক্রেতার আবার আমার সিভি ভালো লেগে যায়। আমি ৬ মাস পোল্যান্ডে গিয়ে সেই প্রজেক্টের নেতৃত্ব দেই। আমি ছাড়া বাকি ২৫ জনই ইউরোপিয়ান ছিলেন। আমি খুবই দক্ষতার সাথে প্রজেক্টের নেতৃত্ব দেই এবং কাস্টমার ফিডব্যাক ৫/৫ পেয়েছিলাম। যদিও শুরুর দিকে কেউ আমার নেতৃত্বে কাজ করতে চায়নি। আমি একটা কাজ করলাম। একে ইংরেজিতে Lead By Example বলে। তাদেরকে নতুন কোনো কাজ আমি শিখিয়ে দিতাম। এরপর বলতাম বাকি কাজ তোমরা করো। এভাবে ধীরে ধীরে আমার মাঝে নেতৃত্বের গুণাবলী বিকশিত হতে থাকে এবং আমি সেই কাজটি আমার দল নিয়ে খুব সাফল্যের সাথে সম্পন্ন করতে পেরেছিলাম। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। শুধুই সামনের দিকে এগিয়ে চলা। 

এরপর চাকরির বিভিন্ন ধাপে গ্রিস, ইন্দোনেশিয়া, স্পেন, রাশিয়া, ফ্রান্স, জার্মানি ও বাহরাইনে প্রজেক্টে কাজ করেছেন জনি।

২০১৩ সালে নিজেকে আরও সামনের দিকে এগিয়ে নিতে তল্পিতল্পা গুটিয়ে তিনি ইউরোপে পাড়ি জমান এবং এরিকসন, আয়ারল্যান্ডে যোগদানের মাধ্যমে জীবনের নতুন অধ্যায় শুরু করেন। এরপর বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন প্রজেক্টে কাজ করেছেন। আমেরিকা, সুইডেন, জার্মানি, ডেনমার্ক, ফ্রান্স, মধ্যপ্রাচ্য, সৌদি আরব, লেবানন, জর্ডান, কানাডা, তুরস্ক, ইংল্যান্ড, সাউথ আফ্রিকা, ভারত, গুয়েতেমালা, মেক্সিকো, সুইজারল্যান্ড, ইতালি, মাল্টা, সার্বিয়া, নেদারল্যান্ডস, অস্ট্রেলিয়াসহ অনেক দেশেও কাজ করার অভিজ্ঞতা রয়েছে জনির ঝুলিতে।