বিভিন্ন সময়ই কারণ না জেনেই বা বিপরীতে কোনো প্রশ্ন না করেই অনেক কিছুতেই বিশ্বাস করে নেই আমরা। হতে পারে তা আমাদের শুভাকাঙ্ক্ষীদের প্রতি অন্ধ বিশ্বাস বা ভালবাসার কারণে। এভাবেই ছোটোছোটো কুসংস্কারগুলো বাসা বাঁধতে শুরু করে আমাদের জীবনে কিংবা বলতে পারি বিভিন্ন ভিত্তিহীন বিশ্বাসগুলোকে সত্য ভেবে জীবনযাপন করতে থাকি সকলে। ছোটবেলা থেকে জেনে আসা সেই ভিত্তিহীন বিশ্বাসগুলো বিজ্ঞানের কাছে এসে হার মেনে যায়। আজকে আলোচনা হবে এমন ১৫টি ব্যাপার নিয়ে যা বিশ্বাস করে আসছি সকলেই কিন্তু বিজ্ঞানের চোখে যার কোনো স্থান নেই।

১. গর্ভাবস্থার স্থায়ীত্বকাল নয় মাস

অনেকেই জানি, নয় মাস হচ্ছে গর্ভধারণের স্থায়ীত্বকাল। ৪০ সপ্তাহের মাঝে শিশুর জন্ম হবে এমনটা অনেকেই বিশ্বাস করে থাকি। কিন্তু গবেষণায় জানা গেছে শুধু মাত্র পাঁচ শতাংশ শিশুর জন্ম হয় নির্ধারিত দিনে। শুধু তাই নয়, ঋতুস্রাব বন্ধ হয় যে মাস থেকে, সে মাসের শুরু থেকেই একজন মহিলাকে গর্ভবতী বলে গণ্য করা যাবে। কিন্তু সাধারণত ঋতুস্রাব বন্ধের আগের দিনগুলোকে গর্ভকালীন সময়ের সাথে যোগ করা হয় না। তাই শুধুমাত্র নয় মাস গর্ভাবস্থার স্থায়ীত্বকাল এই বিশ্বাস সত্য নয়।

ছবিসূত্রঃ blmommy.com

২. বাড়তি ওজন অস্বাস্থ্যকর

মেদবৃদ্ধি মানেই যে ক্ষতিকর এই ধারণা থেকে বেরিয়ে আসা প্রয়োজন। একজন স্থুলকায় মানুষ শারীরিক ভাবে অসুস্থ নন। ওজন বৃদ্ধিকে আমরা প্রায়ই রোগ হিসেবে চিহ্নিত করি। কিন্তু ওজন বৃদ্ধি একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া মাত্র। Dr. Steven N. Blair তার এক গবেষণায় বলেছেন, যে সকল মানুষ প্রতিনিয়ত ব্যায়ামাগারে গিয়ে ব্যায়াম করেন তাদের মৃত্যুর হার স্থুলকায় ব্যক্তিদের মৃত্যুর হারের চেয়ে বেশি।

বাড়তি ওজন মানেই রোগবৃদ্ধি নয়; ছবিসূত্রঃ timesofisrael.com 

৩. অতিরিক্ত লবণ

অতিরিক্ত লবণ খাওয়া যে ক্ষতিকর সেটা সকলেই কমবেশী জানি। উচ্চ রক্তচাপের ক্ষেত্রে লবণ খাওয়া নিষিদ্ধ বলেই সকলে জানি। শুধু রক্তচাপের ক্ষেত্রে নয়, লবণ ওজন বৃদ্ধি করে বলেও লোকমুখে প্রচলিত। কিন্তু কখনো এই পুরোনো বিশ্বাসগুলোকে প্রশ্ন করা হয়নি। আমরা অতিরিক্ত লবণ গ্রহণের নেতিবাচক দিকগুলো জানলেও, লবণের অভাবের কারণে শরীরে ঠিক কী কী ক্ষতি হতে পারে সে সম্পর্কে অতটা জ্ঞান রাখি না। লবণের অভাবে বহুমূত্র রোগ, কামে অনাগ্রহ, চর্বি বৃদ্ধি ইত্যাদির আনাগোনা দেখা দেয়। তাই এক চিমটি লবণ ছিটিয়ে খেলে আশা করি শরীরের লাভ ছাড়া ক্ষতি হবে না।

এক চিমটি লবণ স্বাদ বৃদ্ধি করবে রোগ নয়; ছবিসূত্রঃpinterest.co.uk

৪. জৈব খাদ্য মানেই পুষ্টিকর

পুষ্টিকর খাদ্য বলতে আমরা বুঝি যা প্রকৃতি থেকে প্রাপ্ত। সেক্ষেত্রে জৈব খাদ্য থাকে স্বাস্থ্য সচেতনদের প্রথম পছন্দ। কিন্তু এটা হয়তো অনেকেই জানি না। এসকল জৈব খাদ্যেও থাকে বিভিন্ন রকম কেমিক্যাল বা রাসায়নিক দ্রব্য। ইউএস অর্গানিক স্ট্যান্ডার্ডস ২০টি রাসায়নিক দ্রব্য জৈব খাদ্যে ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছে। বলা যেতে পারে, কোনো খাদ্যই আসলে রাসায়নিক দ্রব্যের ধরা ছোঁয়ার বাইরে নয়। তবে কিভাবে পুষ্টিকর খাদ্য পাওয়া যেতে পারে? উপায় একটাই, নিজেই চাষাবাদের মাধ্যমে খাদ্য উৎপাদন করা।

জৈব খাদ্য কখনো শতভাগ জৈব নয় ; ছবিসূত্রঃ erabaru.net

৫. চিনির তুলনায় মধু উপাদেয় এবং কম ক্ষতিকর

আমরা বিভিন্ন সময়ে দেখে থাকি ওজন কমানোর ক্ষেত্রে গ্রীন টির সাথে চিনির পরিবর্তে মধু ব্যবহার করে অনেকেই। অনেকেই বিভিন্ন খাদ্যে চিনির ব্যবহার কমিয়ে মধুকে গ্রহণ করেছেন কারণ সকলেই জানি মধু প্রাকৃতিক এবং এটি কম ক্ষতিকর। কিন্তু যদি বলি চিনি ও মধুর উপকারিতা এবং অপকারিতা সম্পূর্ণ এক? হ্যাঁ, মিষ্টতার দিক দিয়ে মধু চিনির তুলনায় এগিয়ে। মধুতে অনেক বেশী ক্যালরি থাকে। মধুর কারণেও বহুমূত্র, হৃদরোগ এমনকি ওজন বৃদ্ধিও হতে পারে।

মধু কিংবা চিনি অপকারিতা একই ; ছবিসূত্রঃ honeyanddates.com

৬. গাজর খাওয়া রাতে দেখার জন্য উপকারী

আমরা জানি যে, গাজর অত্যন্ত উপাদেয় খাদ্য। গাজরে প্রচুর পরিমানে ভিটামিন এ রয়েছে যা আমাদের চোখের জ্যোতির জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কালে একটি গুজব ছড়ানো হয় যে। গাজর খেলে রাতের বেলা খুব স্পষ্ট দেখা যায়। এই গুজব ছড়ায় ব্রিটিশ সেনারা। তারা একটি বিশেষ রাডার আবিষ্কার করে যা তাদের শত্রু পক্ষ খুঁজে বের করতে সহায়তা করে। কিন্তু এই আবিষ্কারটি গোপন রাখতে তারা প্রচার করে অতিরিক্ত গাজর খাওয়ার ফলে তাদের বিমান চালকদের জ্যোতি বাড়ে। ফলে তারা রাতের বেলায়ও লুকিয়ে থাকা শত্রু দেখতে সক্ষম হন। ভিটামিন এ এর উপস্থিতি চোখের জন্য ভাল কিন্তু রাতের বেলা বেশি দেখতে পাওয়া এক ধরণের মিথ্যা প্রচারণা।

চোখের জ্যোতি বৃদ্ধিতে গাজরের ভুমিকা রয়েছে অবশ্যই; ছবিসূত্রঃ verywellfit.com

৭. মস্তিষ্কের ১০ শতাংশ ব্যবহার

আমরা সকলেই কখনো না কখনো বিশ্বাস করেছি বা করি আমাদের মস্তিষ্কের শুধুমাত্র ১০ শতাংশ ব্যবহার করে থাকি। কিন্তু এই ধারণাটিও সম্পূর্ণ ভুল। শুধুমাত্র ১০ শতাংশ মস্তিষ্ক আমাদের আমাদের পুরো দেহকে কর্মক্ষম রাখতে পারবে না। একজন সুস্থ স্বাভাবিক মানুষের মস্তিষ্কের সম্পূর্ণটাই ব্যবহার হয় তার দৈনন্দিন জীবনে।

৮. মাইক্রোওয়েভ ওভেনের ফলে কর্কট রোগ (ক্যান্সার) হয়

ধারণা করা হয় যে, মাইক্রোওয়েভে রান্না করা হলে তা এমন একটি রশ্মি বা এমন এক ধরণের গ্যাসীয় পদার্থ নিঃসরণ করে যা আমাদের কর্কট রোগের কারণ হতে পারে। কিন্তু এই ধারণাটি ভুল। মাইক্রোওয়েভ ওভেন এমন কোনো রশ্মি বা গ্যাস নিঃসরণ করে না যাতে মানুষের শরীরের ক্ষতি হবে। আমরা যদি মাইক্রোওয়েভের কার্যক্রম দেখি তবে জানবো যে, এটি কেবল মাইক্রোওয়েভের ভেতরকার খাদ্যকে গরম করার জন্য কিছু জলীয় বাষ্পে তাপ সঞ্চার করে যার ফলে খাদ্য গরম হয়।

ছবিসূত্রঃ x254.co

৯. দই হজমে সহায়তা করে

দই হজম এবং ওজন কমানোর ক্ষেত্রে অত্যন্ত পরিচিত একটি খাদ্য। আমরা বিভিন্ন অনুষ্ঠানেও দেখতে পাই খাওয়া শেষে মিষ্টান্ন হিসেবে দই দেওয়া হয়। কারণ দই এর সাথে হজমের সম্পর্ক স্থাপন করেন অনেকেই। কিন্তু এই ধারণা আসলে ভুল। দুধ থেকে দই বানানো হয় দুধে ব্যাক্টেরিয়ার সংক্রমণ ঘটিয়ে। তাই বলা যায়। দই খাদ্যে একটি ভালো মানের ব্যাকটেরিয়ায়র আক্রমণ তৈরীতে সহায়তা করে। আমাদের শরীরে যথেষ্ট ব্যাকটেরিয়া রয়েছে, তাই দই খেয়ে ব্যাকটেরিয়া বাড়িয়ে লাভ কী? আবার দই যা কিনা মিষ্টি জাতীয় খাবার যা দেহে চিনির পরিমাণ বৃদ্ধি করবে। তাই দই আসলে হজমে বা ওজন কমাতে সহায়তা করে না।

টক দই মেদ কমানোর জন্য উপাদেয় ; ছবিসূত্রঃ science.howstuffworks.com

১০. রাতের খাবার ওজন বৃদ্ধি করে

কথায় আছে, “রাজার মতো খাও সকালে, দুপুরে খাও রাজকুমারের মতো, আর রাতে খাও প্রজার মত।” কিন্তু ওজনের ক্ষেত্রে এই কথাটি খাটে না একেবারেই। সারাদিনে যখনি খাওয়া হোক না কেন, ওজন বৃদ্ধি হবে কিনা তা নির্ভর করবে সারাদিন কতটা কায়িক শ্রম হয়েছে তার ওপরে, কতগুলো ক্যালরি বার্ন হয়েছে তার ওপরে। রাতে বা দুপুরে খেলেই যে ওজন বৃদ্ধি হবে তা কিন্তু নয়।

ছবিসূত্রঃ commons.wikimedia.org

১১. দুধ সকলের জন্য উপাদেয় খাদ্য

আমরা সকলেই জানি দুধ আমাদের দেহে ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন ডি এর অভাব পূরণ করে। কিন্তু সম্প্রতি হওয়া গবেষণায় জানা গেছে, দুধের সাথে আমাদের দেহের ক্যালসিয়ামের বা অস্থির দৃঢ়তা বৃদ্ধির কোনো সম্পর্ক নেই। অনেকের গরম দুধ সেবনে এসিডিটির সমস্যাও হতে পারে। তাই দুধ আসলে সকলের জন্য উপাদেয় নয়।

ছবিসূত্রঃ thedailybeast.com

১২. মানুষের রয়েছে পঞ্চেন্দ্রিয়

আমরা ছোটবেলা থেকেই জেনে আসছি মানুষের পাঁচটি ইন্দ্রিয়। ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের উপস্থিতি যাদের থাকে তাদের অনুমান করার ক্ষমতা থাকে প্রচুর। কিন্তু এসকল ধারণাই ভুল। মানুষের অন্তত ২০ ধরণের ইন্দ্রিয় রয়েছে। যেমন যেকোনো ব্যথা অনুভব করার ইন্দ্রিয়, যেকোনো তাপমাত্রা ইত্যাদি। মানুষের তুলনায় পশুপাখির ইন্দ্রিয়ের সংখ্যা অনেক বেশী। অনেক পশুপাখি পৃথিবীর চুম্বক তরঙ অনুভব করতে পারে।

ছবিসূত্রঃ worldartsme.com

১৩. অন্ধ মানুষেরা দেখতে পায় না কিছুই

সবসময় অন্ধরা কেবল অন্ধকারই দেখতে পায় এই ধারণা ভুল। অন্ধরা অনেক সময় আলোর আবছা অংশ দেখতে পায়, বিভিন্ন আকৃতির ঝাপসা অবয়ব দেখতে পায়। শুধুমাত্র অন্ধকার তাদের জীবন, এই ধারণা ভুল।

ছবিসূত্রঃ ec.europa.eu

১৪. আমাদের জিহ্বা ৪ অংশে বিভক্ত

আমরা অনেকেই শুনেছি আমাদের জিহ্বা ৪ অংশে বিভক্ত এবং প্রতেক অংশে থাকে ভিন্ন টেস্ট বাডস যা আমাদের ভিন্ন ভিন্ন স্বাদ গ্রহণে সহায়তা করে। মিষ্টি , টক, লবণাক্ত এবং তিক্ত স্বাদ আমাদের জিহ্বার ৪ অংশ আমাদের অনুভব করায়। কিন্তু এই ধারণাও সম্পূর্ণ ভুল। আমাদের জিহ্বায় একসাথে হাজারো টেস্ট বাডস কাজ করে। বিশ্বাস না হলে এক চিমটি লবণ জিহ্বার এক অংশে রেখে পরীক্ষা করে দেখতে পারেন। শুধু এক অংশের এই লবণাক্ত ভাবই জিহ্বা নিয়ে এই কুসংস্কারের অবসান ঘটাবে।

ছবিসূত্রঃ en.wikipedia.org

১৫. ৬ ঘন্টা ঘুমই যথেষ্ট

আদিম কালে ৬ ঘন্টা ঘুমই যথেষ্ট হতো বলে, আমাদের পূর্ব পুরুষেরা দিনের অনেক সময় কাজে ব্যয় করতেন ঘুমে নয়। অনেকে এখনো মনে করে থাকেন একজন প্রাপ্ত বয়ষ্কের জন্য ৬ ঘন্টা ঘুমই প্রয়োজন। কিন্তু যান্ত্রিক এই জীবনে আমাদের জন্য ৬ ঘন্টা ঘুম আসলে যথেষ্ট নয়। অন্তত ৮-১০ ঘন্টা ঘুম এই যুগে প্রয়োজন কেননা আমাদের পরিপূর্ণ ঘুম হয় না তা হতে পারে বিভিন্ন চিন্তার কারণে। তাছাড়া শহরের আলো কিংবা শব্দের কারণে সুন্দর ঘুম হয় না। তাই ৮-১০ ঘন্টা ঘুম না হলে শরীর দূর্বল হয়ে পড়বে খুব শীঘ্রই।

ছবিসূত্রঃ ventfitness.com