আদিনা খামখাটছি ২২ বছর বয়সী এক সফল নারী উদ্যোক্তা ও জুয়েলারি ব্যবসায়ী। যুক্তরাষ্ট্রের বাসিন্দা আদিনা তখন কলেজের শিক্ষার্থী। একদিন কেনাকাটা করতে গিয়ে একটি জুয়েলারি খুব পছন্দ হলো। কিন্তু জুয়েলারির দাম তার বাজেটের বাইরে ছিলো। আবার একটু কম দামি জুয়েলারিগুলোর মান তেমন ভালো ছিলো না। তাই তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন নিজের হাতেই জুয়েলারি বানাবেন। এই ছোট একটি সিদ্ধান্ত যে তার জীবন পাল্টে দিবে, তা তিনি ঘুরাক্ষণেও ভাবতে পারেননি।

যেভাবে গল্পের শুরু

আদিনা তখন ব্রুকলিন কলেজের একজন নবীন শিক্ষার্থী। সপ্তাহে ক্লাস মাত্র দুদিন। সপ্তাহের বাকি দিনগুলোতে তার অবসরে সময় কাটে। তাই চিন্তা করলেন, এই অবসর সময়ে জুয়েলারি তৈরি করবেন। প্রথমে তিনি এই ধারণা তার মায়ের সাথে শেয়ার করলেন। ভগ্যক্রমে ধারণাটি তার মায়ের খুব পছন্দ হলো এবং সেইসাথে তিনি আশ্বাস দিলেন এই কাজে  তাকে সব ধরনের সহযোগিতা করবেন। আদিনার হাতে মাত্র ১০০০ ডলার ছিলো, এ ১০০০ ডলার দিয়ে জুয়েলারি তৈরির যাবতীয় সামগ্রী যেমন- সুতা, চেইন, পাথর, মুক্তা ইত্যাদি কিনলেন।

Image Source: shopfado.com

তাদের রান্নাঘরের টেবিলটি নিজের রুমে নিয়ে গেলেন এবং সেই টেবিলের উপর সকল সামগ্রী রেখে, জুয়েলারি বানানোর কাজ শুরু করলেন। আদিনা কয়েকদিন একটানা জুয়েলারি বানিয়ে গেলেন, তারপর সে জুয়েলারিগুলো তার সহপাঠীদের কাছে বিক্রি করতে লাগলেন। এছাড়াও তিনি তার প্রতিবেশীদের বাসায় বাসায় গিয়ে জুয়েলারি বিক্রি করা শুরু করলেন। প্রথম তিনমাস এভাবে জুয়েলারি বিক্রি করলেন এবং বেশ ভালোই আয় হলো। আদিনা বুঝতে পারলেন, তিনি যদি তার কাজের কৌশল পরিবর্তন করতে পারেন, তাহলে আরো বেশি গ্রাহকের কাছে পৌঁছাতে পারবেন এবং বিক্রির পরিমাণও বেড়ে যাবে।

যে কৌশল গ্রহণ করলেন

প্রথমে তিনি সাঁতারের কাপড় বিক্রি করা হয় এমন একটি দোকানে যান এবং সে দোকানের মালিককে অনুরোধ করেন, এখানে সাঁতারের কাপড় বিক্রির পাশাপাশি তিনি তার তৈরিকৃত জুয়েলারিগুলো প্রদর্শন করতে চান। দোকানের মালিক আদিনার প্রস্তাবে রাজি হয়ে যায়। প্রথম কয়েকদিন ভালো বিক্রি হলো। কিন্তু দোকানটি ছিলো মৌসুমি ব্যবসায়ের দোকান, যেখানে বেশিরভাগ গ্রাহক গ্রীষ্মকালে আসতেন। বছরের বাকিটা সময় গ্রাহকের আনাগোনা ছিলো খুবই কম। তাই আদিনার জুয়েলারিগুলো শুধুমাত্র গ্রীষ্মকালেই ভালো বিক্রি হতো, বাকি সময় ব্যবসায়ে মন্দাভাব লেগে থাকতো।

Image Source: adinasjewels.com

এরপর তার বাবা মা তাকে পরামর্শ দিলেন, আশেপাশের কোনো সেলুনে তার জুয়েলারিগুলো প্রদর্শন করতে, কারণ সেলুনগুলোতে সব সময় গ্রাহকদের আসা যাওয়া থাকে। আদিনা তাদের কথা মতো, স্থানীয় একটি সেলুনে জুয়েলারি প্রদর্শনের ব্যবস্থা করলেন। এবার তিনি সফলতার দেখা পান, বিক্রি কয়েকগুণ বেড়ে যায় এবং সারা বছর ধরে চলতে থাকলো এই বেচাকেনা।

সফলতার গল্প

ব্যবসায় শুরুর চার বছর পর, বর্তমানে আদিনার জুয়েলারি প্রতিষ্ঠান “আদিনা’স জুয়েলস” কয়েক লক্ষ টাকার একটি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। এ প্রতিষ্ঠানটি ইন্সটাগ্রামে হাজার হাজার গ্রাহকের মনোযোগ আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছে।

আরিয়ানা গ্রান্ডে, বেলা, এমিলি রাতাজকোস্কি এবং গিগি হাদিদের মতো অনেক নামি দামি সেলিব্রেটিরা এ প্রতিষ্ঠানের গ্রাহক। বিভিন্ন অনুষ্ঠান ও ফটোশুটে এসব সেলিব্রেটিদের “আদিনা’স জুয়েলস” এর জুয়েলারি পরে উপস্থিত হতে দেখা যায়। কিন্তু ব্যবসায়ের শুরুর প্রথম দিকে পেশাদার ফটোগ্রাফার ও মডেল নিয়োগ করে ফটোশুট করানোর মতো সামর্থ্য আদিনার ছিলো না। তাই তিনি তার পরিবারের সদস্যদের মডেল হিসেবে সাজিয়ে, নিজেই ছবি তুলে ইন্সটাগ্রামে পোস্ট করতেন।

আদিনার তৈরি করা নেকলেস, আংটি, কানের দুল, ব্রেসলেট ব্যাপকভাবে জনপ্রিয় হবার পড়েও, এগুলোর মূল্য এখনও সাশ্রয়ী। এখনো তার প্রতিষ্ঠানের বেশিরভাগ জুয়েলারি তিনি ডিজাইন করে থাকেন। আদিনার ব্যবসায়ের মূলমন্ত্র ছিলো সুলভ মূল্যে পণ্য ক্রেতাদের কাছে পৌঁছে দেয়া। এ প্রতিষ্ঠানের গোল্ড প্লেটেড এবং রূপা  জুয়েলারিগুলোর মূল্য $৫০-$২৫০ মধ্যে।

আদিনা বলেন, “আমি চাই, আমার মতো লোকেরা, যারা ধনী পরিবার থেকে আসেনি, তারাও সুন্দর গয়না কিনতে পারবে”।

Image Source: adinasjewels.com

আদিনার ব্যবসায়ে পরিধি বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে তার ভাই মায়ার তাকে সাহায্যের জন্য ব্যবসায়ে যোগ দেন। তখন তার বয়স ছিলো মাত্র ১৭ বছর। ব্যবসায়ে যোগ দিয়ে তিনি প্রথমেই ‘আদিনা’স জুয়েলস’ এর ওয়েবসাইটটি তৈরি করেন। কিন্তু প্রথমে তিনি জানতেন না কীভাবে একটি ওয়েবসাইট ডিজাইন করতে হয়, কারণ কোডিং সম্পর্কে তার কোনো ধারণা ছিলো না। ইউটিউবের বিভিন্ন ভিডিও দেখে তিনি কোডিং শেখা শুরু করেন এবং সফলভাবে এ প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইটটি চালু করতে সক্ষম হোন।

বর্তমানে ২০ বছর বয়সী মায়ার বারুচ কলেজে এন্ট্রাপ্রিনিউরশিপ নিয়ে পড়াশোনা করছেন। মেয়ার বলেন, “আমাদের জুয়েলারির মূল ক্রেতা হচ্ছেন ১৮-৩১ বছর বয়সী তরুণীরা,”।  বর্তমানে ইন্সটাগ্রামে ‘আদিনা’স জুয়েলস’ এর ফলোয়ার ১,৪০,০০০ উপরে, এবং দিন দিন এ সংখ্যাটি বেড়েই চলেছে। মায়ার এ প্রতিষ্ঠানের অপারেশন ও মার্কেটিং বিভাগ পরিচালনা করেন আর আদিনা প্রোডাক্ট ডিজাইন ও কাস্টমার রিলেশন বিভাগের দায়িত্বে রয়েছেন।

বাবা মায়ের ভূমিকা

আদিনা বলেন, “আমার মা আমাকে তৃতীয় শ্রেণিতে থাকাকালীন সময় থেকে নিজের ভবিষ্যৎ নিজে গড়ার জন্য উৎসাহিত করতেন”। তিনি আরো বলেন, “মা আমাকে সব সময় বলতেন, কখনো অন্য কারো অধীনে কাজ করবে না, নিজের ভাগ্যের পরিবর্তন করে নিজেই নিজের বস হবে”।

কয়েক বছর বাবা মায়ের বাসা থেকে ব্যবসা পরিচালনা করার পর, এখন তারা তাদের নিজস্ব অফিসে স্থানান্তরিত হয়েছেন। বর্তমানে ব্রুকলিনে প্রতিষ্ঠানটির শো রুম রয়েছে, যেখানে ৬০০টিরও বেশি ডিজাইনের বিভিন্ন ধরনের জুয়েলারি বিক্রি করা হয়। এ প্রতিষ্ঠানটিতে এখন ডজনখানেক কর্মচারী মার্কেটিং, প্যাকেজিং, শিপিংয়ের দায়িত্বে কর্মরত রয়েছেন।

আদিনা এবং মায়ার, দুই ভাইবোন তাদের নিজেদের সাফল্যে গর্বিত। তবে এই সফলতার পিছনে তারা তাদের বাবা মায়ের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি বলে মনে করেন।

আদিনা বলেন, “ব্যবসায় শুরুর প্রথম দিন থেকে তারা আমাকে সাহায্য করেছেন। এমনকি অনেক সময় ব্যবসায়িক পরামর্শ করার জন্য আমি বাবাকে অর্ধেক রাতে ঘুম থেকে তুলে দিতাম। আমাকে সাহায্য করার জন্য তারা সব সময় আমার পাশে ছিলেন”।

Featured Image: forbes.com