সফল ব্যক্তিদের অধিকাংশই সফলতার জন্য লড়ে গেছেন বহুদূর। এর সবক’টা গল্পই আমাদের জানা উচিত। কেননা আমাদের মধ্যেও যে অনেক প্রতিভাবান ব্যক্তি রয়েছে যিনি কিনা একবারের হোঁচট খেয়েই দমে যান। এই গল্পগুলো দ্বারা অন্তত তাদের উজ্জীবিত করা সম্ভব হবে। আজ জানবো এমনই একজন লেখিকার সফলতার নেপথ্যের গল্প। তিনি আর কেউ নন, অতি পরিচিত হ্যারিপটার সিরিজের লেখিকা, জে কে রাওলিং। তবে চলুন জেনে নেয়া যাক।

সময়টা ৬০ দশকের শেষ। ইংল্যান্ডের একটি ছোট্ট গ্রামে বাবা, মা আর তাদের ছোট্ট দুটি মেয়ে নিয়ে এক মধ্যবিত্ত পরিবার বাস করতো। সেই পরিবারের বড় বোনের কাছে ছোট বোনের চাওয়ার শেষ নেই। শর্ত একটাই, প্রতিদিন শোনাতে হবে গল্প, গল্প না শোনালে ছোটো বোন ঘুমাতেই চায় না। কিন্তু প্রতিদিন তো আর নতুন গল্প খুঁজে পাওয়া সম্ভব না! কি আর করার উপায় না বুঝে বড় বোন মনের সব রস মাখিয়ে গল্প বানাতে শুরু করে। এই সেই বড় বোন, আজ যার ব্যাপক পরিচিতি, দারুণ নামডাক পৃথিবীর অন্যতম জনপ্রিয় লেখিকা হ্যারি পটারের লেখিকা জে কে রাউলিং।

পরিবারের সাথে রাউলিং,ছবিসূত্র: globaleducationmagazine.com

ছোটবেলায় আর দশটা বাচ্চার মতো খেলাধুলার প্রতি তেমন ঝোঁক ছিল না রাউলিংয়ের। লজ্জায় মেয়েটি জমে যেতো, চুপ করে বসে পড়তেই যেন তার মূল আনন্দ। রাউলিং তার শিক্ষাজীবনে ফরাসি ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতক সম্পন্ন করার পর চলে আসলেন লন্ডনে। লন্ডনে গিয়ে শুরু করলেন সেক্রেটারি হিসেবে কাজ করার জন্য প্রশিক্ষণ। কিন্তু খুব বেশিদিন সেই প্রশিক্ষণ নেয়া হয়নি রাউলিং এর। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই রাউলিং বুঝতে পারলেন, সেক্রেটারি হতে চাই গোছালো জীবন কিন্তু তিনি তো তেমন নন! তবে কেন তিনি এই প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন- এমন একতা বোধ কাজ করে তার মাঝে।

না হওয়ার ও কোনো কারণ নেই, বিশেষ কোনো মিটিংয়ে যখন লোকে নোট নেয়, তখন রাউলিং এর মনের নোটখাতায় জমা হয় শ’খানেক গল্প। সব ভেবেচিন্তে রাউলিং ঠিক করে, সেক্রেটারি নয়, তিনি ইংরেজির শিক্ষক হবেন। অত:পর ইংল্যান্ড ছেড়ে পর্তুগালে। এই পর্তুগালেই পরিচয় হয় এক পর্তুগিজ সাংবাদিকের সাথে। এত কিছু বুঝে ওঠার আগেই অল্প কিছুদিনের মধ্যেই তাদের পরিচয় রুপ নেয় পরিণয়ে। সন্তানও হয় তাঁদের। কিন্তু খুব বেশিদিন টিকেনি তাদের সংসার।

ছবিসূত্র:kayedacus.com

মেয়ের জন্মের চার মাসের মাথাতেই রাউলিং ও তাঁর স্বামীর ছাড়াছাড়ি হয়। মেয়েকে শেষ সম্বল হিসেবে সঙ্গে নিয়েই রাউলিং দেশে ফিরে আসেন। বিচ্ছেদের করুণা অধ্যায়ের মধ্য দিয়েই রাউলিংয়ের জীবনে শুরু হয় সবচেয়ে কষ্টের অধ্যায়। কোলে চার মাসের মেয়ে, বিচ্ছেদ, কাজ করে খাবার মতো কোনো কাজ নেই। সরকারি টাকায় কি সব হয়? তবু সরকারি ভাতার ওপর নির্ভর করে কষ্টেসৃষ্টে চললো মা-মেয়ের বেঁচে থাকা। এত কষ্ট নিয়ে কে ক’দিন পারে সংগ্রাম করতে? রাউলিং ও পেরে উঠেননি, কিছুদিনের মধ্যেই তিনি মানসিকভাবে প্রচন্ড অসুস্থ হয়ে পড়েন। পরবর্তীতে তিনি নানা অনুষ্ঠানে সেই ভয়াবহ হতাশার দিনগুলোর কথা মনে করে রীতিমতো কেঁদেই ফেলতেন।

রাউলিং বলেন,

আমি অনেকবার আত্মহত্যার করার কথাও ভেবেছিলাম। একমাত্র মেয়েটার মুখের দিকে তাকিয়ে আর পেরে উঠা হয়নি। আমি অনুভব করতে পারছিলাম, আমার নিজের যদি এই অবস্থা হয় তবে আমার মেয়েটার কি হবে? অতঃপর আমি চিকিৎসকের শরণাপন্ন হই, প্রায় নয় মাস ধরে একজন ডাক্তারের কাছে চিকিৎসা নিই আমি।

স্কটল্যান্ডের এডিনবরার নামে এক চাস্টলে বসে তিনি একটু আধটু করে লেখালেখি শুরু করেন। কয়েক বছর আগে ম্যানচেস্টার থেকে ট্রেনযোগে লন্ডনে যাওয়ার সময় তাঁর মাথায় এক দারুণ গল্প কাহিনীর উদয় হয়। ছোট্ট এক ছেলের কাহিনী, যে ট্রেনে চড়ে বড় এক জাদুকরদের স্কুলে ভর্তি হতে যাচ্ছে। এই চিন্তার ছেলেটিই, হ্যারি পটার।

সময়টা ১৯৯৫ সাল। এই সময়ই রাউলিং হ্যারি পটার অ্যান্ড দ্য ফিলোসফার’স স্টোন বইটি লেখা শেষ করেন। প্রকাশকের কাছে পাণ্ডুলিপি পাঠান। সবচেয়ে মজার বিষয় হলো এই, প্রথমে কোনো প্রকাশকই বইটি ছাপতে রাজি হয়নি। এরই মধ্যে বড় বড় অনেক প্রকাশকই পাণ্ডুলিপিটি নিতেই চাইলেন না।

ছবিসূত্র:cnn.com

দীর্ঘ ১২ মাস অনেক চেষ্টার পর একজন প্রকাশক পাওয়া যায়। যার মেয়ে লিখাটি দারুণরকম পছন্দ করে। শুরুর দিকটাতেই প্রকাশক খুশি হয়ে অগ্রিম সম্মানী হিসেবে রাউলিং কে দেড় হাজার পাউন্ড দেন। প্রথম প্রকাশে বইটির এক হাজার কপি ছাপা হয়। উল্লেখ্য, প্রায় ৫০০ কপি বই-ই বিক্রি করা হয় বিভিন্ন স্কুল, কলেজের লাইব্রেরিতে।

ছবিসূত্র:টেলিগ্রাফ ডট কম

সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হচ্ছে, প্রকাশনা জগতের ইতিহাস টপকে হ্যারি পটার অ্যান্ড দ্য গবলেট অব ফায়ার বইটি বাজারে আসার প্রথম দিনেই যুক্তরাজ্যে বিক্রি হয় প্রায় তিন লাখের মতো কপি। আর মাত্র দু’দিনে, যুক্তরাষ্ট্রে বিক্রি হয় ৩০ লাখ ছাড়িয়ে!

সাফল্যের পাল্লা আজ ভারী রাউলিং এর কিন্তু রাউলিং নিজের সবচেয়ে কষ্টের দিনগুলোকে ভুলে যাননি। ২০০০ সালের শুরুর দিকে একটি দাতব্য ট্রাস্ট প্রতিষ্ঠা করেন রাউলিং, যা নারী ও শিশুদের জন্য বছরে প্রায় ৫০ লাখ পাউন্ডের মতো সাহায্য সহযোগীতা করে থাকে। লেখায় ইতি টানবার আগে দুটি প্রশ্ন:

এক, মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়ে রাউলিং যদি আত্মহত্যা করতেন তবে এই রাউলিং কে ক’জন চিনতেন?
দুই, একের পর এক প্রকাশকের তিরস্কার পেয়ে যদি হাল ছেড়ে দিতেন, তবে হ্যারি পটার সিরিজের জন্মের মুখ পৃথিবী দেখতে পারতো কি?

জীবন একটাই, একে চলতে দিন। এর শেষ দেখে তবেই থামুন। মনে রাখবেন, মানুষের সব দরকারের বড় দরকার বেঁচে থাকা। বেঁচে থাকলে সবই সম্ভব।