খাদ্য উৎপাদনে কার্বন নিঃসরণ ও এর ভয়াবহতা

বিংশ শতাব্দীর শেষ থেকে আজ একবিংশ শতাব্দীর শুরুতে পুরো পৃথিবী যে ভয়াবহ সমস্যাটির সম্মুখীন, তা হলো জলবায়ু পরিবর্তন। এটি এমন এক সমস্যা যার সমাধানে সবাই এগিয়ে না এলে এবং এই ব্যাপারে সচেতন না হলে মানবজাতির অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাবে অচিরেই। গত কয়েক দশকে পৃথিবীব্যাপী জলবায়ুর যে পরিবির্তন লক্ষ্য করা গেছে তা আশংকাজনক এবং এই পরিবর্তনের মুখ্য কারণ হিসেবে গ্রীন-হাউস গ্যাস নিঃসরণ তথা কার্বন নিঃসরণকে চিহ্নিত করা হয়েছে। এই পরিবর্তন অব্যাহত থাকলে এবং বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি পেতে থাকলে ধারণা করা হয় ২০৫০ সাল নাগাদ পৃথিবীর অনেক শহর হারিয়ে যাবে সমুদ্র গর্ভে।

আমাদের দৈনন্দিন জীবনযাপনে আমরা যা কিছু করছি, যা কিছু ব্যবহার করছি তার সবকিছুই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কার্বন নিঃসরণের জন্য দায়ী। যেমন আমরা বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও যানবাহন ব্যাবহার করছি যা প্রত্যক্ষভাবে কার্বন নিঃসরণে দায়ী। আবার আমারা যেসব পণ্য ব্যাবহার করছি আমাদের রোজকার জীবনে তা উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরন এবং তা ভোক্তা পর্যন্ত আসার যত প্রক্রিয়া, সবকিছুতেই পরোক্ষভাবে হচ্ছে কার্বন নিঃসরণ। এভাবে কোনো ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান, যানবাহন, পণ্য, সংস্থা ইত্যদির দ্বারা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে যে পরিমাণ কার্বন নিঃসরণ হয় তাকে ঐ ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান, যানবাহন, পণ্য, সংস্থা ইত্যাদির কার্বন ফুটপ্রিন্ট বলে।

ছবিসূত্র : globalcoinreport.com

অবাক করা বিষয় এই যে, শুধু বিদ্যুৎ উৎপাদন, জ্বালানি, যানবাহন, প্রক্রিয়াজাত পণ্য উৎপাদনই কার্বন নিঃসরণের জন্য দায়ী নয়, কৃষিজাত পণ্য উৎপাদন, সংরক্ষণ এবং তা বাজারজাতকরণও করছে কার্বন নিঃসরণ। প্রাণীজ আমিষ উৎপাদনও এর অন্তর্ভুক্ত। নতুন এক গবেষণায় দেখা গেছে যে, কার্বন নিঃসরণে মানব সৃষ্ট কারণ গুলোর এক তৃতীয়াংশই হলো এই প্রাণীজ আমিষ ও কৃষিজাত পণ্য উৎপাদন।

কৃষিজাত পণ্য উৎপাদনে যেসব গ্রীন-হাউস গ্যাস নিঃসরণ হয় তা হল কার্বন ডাইঅক্সাইড, মিথেন, নাইট্রাস অক্সাইড, হাইড্রোফ্লুরো কার্বন, পারফ্লুরো কার্বন, ও সালফার হেক্সাফ্লুরাইড। এর মধ্যে কার্বন ডাইঅক্সাইড নিঃসরণ হয় যেসব কারণে তা হলো, কৃষিকাজের জন্য গাছপালা নিধন, মাটির গুণগত মান বিনষ্টকরণ ও মাঠে কৃষিজাত পণ্যের অবশিষ্টাংশ পোড়ানোর মাধ্যমে।

মিথেন নিঃসরণ হয় কৃষিজাত আবর্জনা, জীবাশ্ম জালানি ও জৈব সার ব্যবহারের ফলে। নাইট্রাস অক্সাইড নিঃসরণ হয় রাসায়নিক সার ব্যাবহারের ফলে। আর হাইড্রোফ্লুরো কার্বন, পারফ্লুরো কার্বন ও সালফার হেক্সাফ্লুরাইড নিঃসরণ হয় কৃষিজাত পণ্য হিমায়ন, প্রক্রিয়া ও বাজারজাতকরনে যেসব পদ্ধতি অবলম্বন করা হয় তার মাধ্যমে।

ছবিসূত্র : wri.org

২০০৮ সালে একটি সমীক্ষায় দেখা যায় যে, কৃষিজাত পণ্য উৎপাদন থেকে প্রতিবছর প্রায় ১২ হাজার মেগাটন কার্বন নিঃসরিত হয় যা সমগ্র খাদ্য উৎপাদন ব্যবস্থায় কার্বন নিঃসরণের ৮৩ ভাগ। এর মধ্যে রাসায়নিক সার উৎপাদন থেকে নিঃসরণ হয় ৫৭৫ মেগাটন কার্বন এবং হিমায়ন ও অন্যান্য প্রক্রিয়া থেকে নিঃসরণ হয় ৪৯০ মেগাটন কার্বন। সমগ্র খাদ্য উৎপাদন ব্যবস্থা থেকে কার্বন নিঃসরিত হয় ৯৮০০ – ১৬৯০০ মেগাটন পর্যন্ত।

২০১১ সালের এক সমীক্ষায় দেখা যায় যে, ১৯৯০ থেকে ২০১০ পর্যন্ত কৃষিজাত পণ্য উৎপাদনে কার্বন নিঃসরণের পরিমান বেড়েছে শতকরা ৮ ভাগ এবং ধারণা করা হয় ২০৩০ সাল নাগাদ তা বেড়ে শতকরা ১৫ ভাগ পর্যন্ত হতে পারে। উন্নত দেশ যেমন যুক্তরাষ্ট্র কৃষিজাত পণ্য উৎপাদন ছাড়াও তা হিমায়িতকরণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণে যে পরিমাণ কার্বন নিঃসরণ করে তা উল্লেখযোগ্য। ২০১১ সালের সেই একই সমীক্ষায় কৃষি উৎপাদনে সর্বোচ্চ কার্বন নিঃসরণকারী দেশ হিসেবে দশটি দেশকে চিহ্নিত করা হয়েছে। দেশগুলো হলো চীন, ব্রাজিল, যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, রাশিয়া, কঙ্গো, আর্জেন্টিনা, মিয়ানমার এবং পাকিস্তান।

শুধু কৃষিজাত পণ্যই নয়, গবাদি পশুপালনও কার্বন নিঃসরণে অনেকাংশে দায়ী। উল্লেখ্য যে, এখানে গবাদি পশু বলতে নির্দিষ্টভাবে সেসব পশুকে বোঝানো হয়েছে যেসব পশুর মাংস লাল যা রেড মিট হিসেবে অধিক পরিচিত। ২০১৪ সালে বিখ্যাত সংবাদপত্র দ্য গার্ডিয়ান “ গবাদি পশুপালনে কার্বন নিঃসরণ” বিষয়ক একটি প্রতবেদন প্রকাশ করে যেখানে তারা অন্যান্য পশুপালনের থেকে  গবাদি পশুপালনে অধিক কার্বন নিঃসরণের কারণ হিসেবে অধিক ভূমি ও পানির প্রয়োজনের কথা উল্লেখ করেছে। গরু, ছাগল, মহিষ ইত্যদি পশুপালনে যে পরিমাণ ভূমির প্রয়োজন তা মুরগি অথবা অন্যান্য পশুপালনে যে পরিমাণ ভূমির প্রয়োজন তার থেকে প্রায় ২৮ গুণ বেশি। পানির প্রয়োজন হয় প্রায় ৮ গুণ বেশি।

ছবিসূত্র : pinterest.com

গ্রীনইটজ নামে একটি ওয়েবসাইট কিছু নির্দিষ্ট কৃষিজাত পণ্য ও প্রাণীজ আমিষের ১ কেজি পরিমাণ উৎপাদনে যে পরিমাণ কার্বন নিঃসরণ হয় তার একটি তালিকা প্রকাশ করে। এসব কৃষিজাত ও প্রাণীজ আমিষ উৎপাদন থেকে শুরু করে সংরক্ষণ, প্রক্রিয়াজাতকরণ, ভোক্তার কাছে তা পৌঁছানো এবং তা খাদ্যে রূপান্তর হওয়া পর্যন্ত মোট যে পরিমাণ কার্বন নিঃসরণ করে তা এই তালিকায় দেখানো হয়েছে। তালিকাটি নিম্নরূপ :

ছবিসূত্র : greeneatz.com

তালিকায় দেখা যাচ্ছে  ১ কেজি পরিমা্ন রেড মিট খাদ্যে রূপান্তর হওয়া পর্যন্ত যে পরিমান কার্বন নিঃসরণ হয়, সমপরিমাণ কার্বন নিঃসরণ হয় যদি একটি গাড়ি যথাক্রমে ৯১ ও ৬৩ মাইল চলে। অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির ” ব্রিটিশ জনসাধারনের খাদ্যাভ্যাস ” শীর্ষক একটি গবেষণায় দেখা যায় যে, প্রতিদিন ১০০ গ্রাম অথবা তার অধিক রেড মিট যদি খাদ্যে রূপান্তরিত হয় তাহলে ৭.২ কেজি কার্বন নিঃসরণ হয়। সবজি ও মাছের ক্ষেত্রে তা ৩.৮ কেজি।

উপরোক্ত আলোচনায় আমাদের খাদ্যাভ্যাস যে কার্বন নিঃসরণে অনেক বড় স্থান দখল করে আছে তা স্পষ্ট প্রতীয়মান। আমাদের অনেকের কাছেই এই তথ্য ছিল অজানা। পুরো পৃথিবীব্যাপী গ্রীন-হাউস গ্যাস নিঃসরণ ও তার ভয়াবহ পরিণতি বিষয়ক যত আলোচনা ও জনসচেতনতামূলক কর্মসূচি পালন করা হয় তার বেশির ভাগই কলকারখানা, যানবাহন, গাছপালা নিধন ও এর ফলে জলবায়ু পরিবর্তন সহ প্রাকৃতিক বিপর্যয় ইত্যাদি ব্যাপারে সচেতন করা হয়।

এখন থেকে মানুষকে গ্রীন-হাউস গ্যাস নিঃসরণ বিষয়ক সব আলোচনা ও জনসচেতনতা মূলক কর্মসূচিতে যদি তাদের খাদ্যাভ্যাস কার্বন নিঃসরণের জন্য কতটা দায়ী, এই ব্যাপারে সচেতন করা না হয় এবং সে অনুযায়ী যদি খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন না করে ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় ব্যাবস্থা যদি না গ্রহণ করা হয় তাহলে অদূর ভবিষ্যতে এক ভয়াবহ প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হতে হবে নিঃসন্দেহে।

Mehedi Hasan Khan: