আপনি উচ্চমাধ্যমিক পর্যায় পার করেছেন। এখন কী করবেন ঠিক বুঝতে পারছেন না। জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং সম্পর্কে শুনেছেন, কিন্তু নির্দিষ্ট কোনো সিদ্ধান্তে আসতে পারছেন না। কারণ, আপনার এই বিষয় সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই।

তাহলে আজকের এই লেখাটি আপনার জন্য। জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে পড়াশোনা করলে কী কী করার সুযোগ পাবেন, পাশাপাশি জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়তে  হলে আপনাকে কী কী পড়তে হবে,  তা জানতে পারবেন এই লেখার মাধ্যমে।

‘জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং’ বাংলায় জিনতত্ত্ব প্রকৌশল। বর্তমানে চিকিৎসাক্ষেত্র ও কৃষিতে সমানভাবে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং ব্যবহৃত হচ্ছে। যে বিশেষ ইঞ্জিনিয়ারিং ও টেকনোলজি ব্যবহার করে জীবের বৈশিষ্ট্য পরিবর্তন করা হয় তাকে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং বা জেনেটিক মডিফিকেশন বলে।

বায়োলজিক্যাল টেকনোলজির সংক্ষিপ্ত রূপ বায়োটেকনোলজি। বায়োলজিক্যাল টেকনোলজির আভিধানিক অর্থ জৈবপ্রযুক্তি। যার কাজ জেনেটিকস, প্রাণরসায়ন, টিস্যু কালচার, মাইক্রোবায়োলজি ইত্যাদির সমন্বিত প্রক্রিয়া।

বাংলাদেশে বায়োটেকনোলজি ও জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংকে একসাথে করে ‘জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড বায়োটেকনোলজি’ নামে শিক্ষা দেওয়া হয়। বাংলাদেশ ও বিশ্বজুড়ে এর চাহিদা ব্যাপক।

ডিএনএ পরীক্ষা; source: BioNinja

ইতিহাস

১৯৫১ সালে সায়েন্স ফিকশন উপন্যাস ‘ড্রাগন’স আইল্যান্ড’-এ ‘জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং’ শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেন জ্যাক উইলিয়ামসন। তার এক বছর আগে ডিএনএ যে বংশগতির বাহক তা নিশ্চিত করেন আলফ্রেড হের্শেয় ও মার্থা চেজ। রবার্ট বুইয়ার ও রবার্ট সয়ানসন ১৯৭৬ সালে বিশ্বের প্রথম জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি ‘জেনেটেক’ প্রতিষ্ঠা করেন। এর এক বছর পর জেনেটিক ই-কোলাই ব্যাকটেরিয়া থেকে মানব প্রোটিন সোমাটোস্ট্যাটিন উৎপাদন করা হয়, যা হিউম্যান ইনসুলিন হিসেবে সুপরিচিত। জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের সাহায্যে চীন, ভাইরাস প্রতিরোধকারী তামাক গাছের প্রবর্তনের মাধ্যমে ট্রান্সজেনিক উদ্ভিদকে সর্বপ্রথম বাণিজ্যিক রূপ দান করে। বাংলাদেশের এ যাবৎকালের সবচেয়ে বড় আবিষ্কার হিসেবে ধরা হয় পাটএর পরজীবি ছত্রাকের জিন নকশা আবিষ্কার।

ডিএনএ; source: Biotechnology Conference

কেন পড়বেন?

বর্তমান বিশ্বে বর্ধিত জনসংখ্যার খাদ্য উৎপাদন, মানুষের মৃত্যুকে জয় করার ইচ্ছা, শিল্প উৎপাদন, পরিবেশ রক্ষাসহ মানবজীবনের নানা চাহিদা মেটাতে কাজ করছে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড বায়োটেকনোলজি। মেডিক্যাল সায়েন্স এবং ফার্মাসিউটিক্যালস ও কসমেটিক ইন্ডাস্ট্রির জীবন রক্ষাকারী ওষুধ উৎপাদন, অ্যানজাইম ও হরমোন উৎপাদনে এ বিষয় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। পরিবর্তিত বৈশ্বিক পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাওয়াতে এ বিষয়ের জন্য জনশক্তির চাহিদা দিন দিন বেড়ে চলছে। জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং পদ্ধতি ব্যবহার করে আণুবীক্ষণিক জীব যেমন: ব্যাকটেরিয়া, ইস্ট অথবা ইনসেক্টম্যামালিয়ান সেল ইত্যাদি থেকে বাণিজ্যিকভাবে প্রয়োজনীয় প্রোটিন উৎপাদন করা যায়। জিন প্রযুক্তি দ্বারা উন্নীত ফসল (জিএমসি) ও জিনগত পরিবর্তন সংবলিত জীব (জিএমও) হচ্ছে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের একটি বিতর্কের বিষয়। তবে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং মূলত কৃষিকে ঘিরেই বেশি পরিচালিত হচ্ছে। জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মাধ্যমে কৃষিতে জিন প্রযুক্তি দ্বারা উন্নীত ফসল উৎপাদনের উল্লেখযোগ্য কারণ হচ্ছে- পরিবেশের বিভিন্ন ধরনের হুমকি থেকে শস্যকে রক্ষা করা, শস্য থেকে সম্পূর্ণ নতুন উপাদান উৎপাদন করা, শস্যের গুণগত মান বৃদ্ধি করা, শস্যের বৃদ্ধি ত্বরান্বিত করা এবং রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতা বাড়ানো ইত্যাদি।

ইকোলাই ব্যাকটেরিয়া; source: VectorStock

কী পড়তে হয়?

বায়োটেকনোলজি অ্যান্ড জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে প্রয়োজনীয় প্রায় সব বিষয়ে পাঠদান করা হয়। বিশেষ কিছু বিষয় হিসেবে পড়ানো হয় প্ল্যান্ট বায়োটেকনোলজি,  এ্যানিমেল বায়োটেকনোলজি,  মাইক্রোবায়াল বায়োটেকনোলজি, এনভায়রনমেন্টাল বায়োটেকনোলজি, ফুড বায়োটেকনোলজি, এ্যাগ্রিকালচারাল বায়োটেকনোলজি, ফিশারিজ এ্যান্ড মেরিন বায়োটেকনোলজি, মেডিক্যাল এ্যান্ড ফার্মাসিউটিক্যালস্ বায়োটেকনোলজি,  প্ল্যান্ট টিস্যু কালচার,  এ্যানিমেল সেল টেকনোলজি,  বায়োপ্রসেস টোকনোলজি এবং জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং। সহায়ক বিষয় হিসেবে পড়ানো হয় এ্যানিমেল সায়েন্স, এ্যাগ্রিকালচারাল বোটানি, মাইক্রোবায়োলজি, কেমেস্ট্রি, বায়োকেমেস্ট্রি, বায়োস্ট্যাটিসটিক্স, মলিকুলার বায়োলজি এবং জেনেটিক্স। এসব বিষয়ের উপর শিক্ষার্থীদের মোট ১৬০ ক্রেডিট সম্পন্ন করতে হয়।

ভর্তির যোগ্যতা

এসএসসি ও এইচএসসিতে বিজ্ঞান বিভাগ থাকতে হবে। সাবজেক্টের তালিকায় অবশ্যই বায়োলজি থাকতে হবে। দেশের একাধিক পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড বায়োটেকনোলজি’তে আন্ডার গ্র্যাজুয়েট ও পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন কোর্স চালু আছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি, ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি ও ইউনিভার্সিটি অব ডেভেলপমেন্ট অল্টারনেটিভ উল্লেখযোগ্য।

জেনেটিক কোড; source:Biology-Kenyon College

ক্যারিয়ার সম্ভাবনা

জেনেটিকস ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড বায়োটেকনোলজির চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড বায়োটেকনোলজি বিভাগ থেকে পাস করা শিক্ষার্থীদের কর্মক্ষেত্র অনেক প্রসারিত। সরকারি বা বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে এ বিভাগের শিক্ষার্থীরা কর্মরত। বাংলাদেশের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব বায়োটেকনোলজি নামে একটি প্রতিষ্ঠান আছে, সেখানে এই বিভাগের ছেলেমেয়েরা গবেষণা করার কাজে অগ্রাধিকার পেয়ে থাকে। এ বিভাগের ছেলেমেয়েদের বর্তমানে দেশের চেয়ে বিদেশে চাকরির ক্ষেত্র অনেক বিস্তৃত হচ্ছে। আমাদের দেশে বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান যেমন পাট, ধান, কৃষি ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানে আমাদের বিভাগের ছেলেমেয়েরা গবেষক হিসেবে কাজ করছে। এ ছাড়া  সায়েন্স ল্যাবরেটরি, আইসিডিডিআরবি, বিএসটিআই, বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানিতে—যেখানে বিভিন্ন ধরনের ভ্যাকসিন উৎপাদন হয়—সেখানেও তাঁরা ভালো বেতনে চাকরি পাচ্ছে। যেসব প্রতিষ্ঠানে বায়োকেমেস্ট্রি, ফার্মেসি, প্রাণিবিদ্যা, উদ্ভিদবিদ্যা ইত্যাদি বিভাগ আছে, সেখানেও তাঁরা কাজ করার সুযোগ পাচ্ছে।

ক্রোমোজোম; source: Biology Questions

উচ্চশিক্ষার সুবিধা

যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জাপান, জার্মানি, দক্ষিণ কোরিয়া, চীন, অস্ট্রেলিয়া, নরওয়ে, বেলজিয়াম, নেদারল্যান্ডস, সুইডেনসহ ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোতে এই বিষয়ের জন্য বৃত্তি পাওয়া যায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের সুপারিশে জাপান সরকারের মনবুকাগাকুশো, চীনা সরকারের চায়নিজ গভর্নমেন্ট স্কলারশিপ, ব্রিটেনের কমনওয়েলথ, জার্মানির ডিএএডি, বেলজিয়ামের ভিলারওস স্কলারশিপ, নেদারল্যান্ডসের এনএফপি ও নুফিক, ইউরোপীয় দেশগুলোর ইরামাসমান্ডুস, সুইডেনের সুইডিস ইনস্টিটিউট স্টাডি, নরওয়ের কুইওটা, অস্ট্রেলিয়ার আইপিআরএস ও ইনইয়েভর নামকরা বৃত্তি পাওয়া যায়। তা ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় এবং তাদের অধীনে যেসব গবেষণা সংস্থা আছে, তারা জৈবপ্রযুক্তির ওপর বেশ কিছু বৃত্তি দেয়। এসব বৃত্তির মাধ্যমে পূর্ণকালীন বা টিউশন ফি মওকুফ করে সেখানে পড়ালেখা ও গবেষণা করা যায়।

সব মিলিয়ে চিন্তাভাবনা করে দেখুন। আপনার যদি মনে হয়,  আপনি জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ক্যারিয়ার গড়তে পারবেন, তাহলে আর দেরি না করে চেষ্টা শুরু করে দিন। আপনার জন্য জিনতত্ত্বের এক আনন্দময় রহস্য  উন্মোচনের অপেক্ষায় আছে।

Feature Image Source: Alamy