প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের উন্নতির মূলে রয়েছে এর দক্ষ মানবসম্পদ৷ প্রতিষ্ঠানের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ সম্পদগুলোর মতোই মানবসম্পদ একটি আবশ্যকীয় উপাদান। যে প্রতিষ্ঠানের মানবসম্পদ যত উন্নত, সেই প্রতিষ্ঠান তত দ্রুত সফলতার শীর্ষে পৌঁছাতে পারে। এজন্যেই নিয়োগের সময়, সবচে সেরা মানুষটিকে বাছাই করে নিয়োগ দেওয়াটা বেশ গুরুত্বপূর্ণ।

একেক প্রতিষ্ঠানে নতুন কর্মী নিয়োগ ব্যয় একেক মাত্রার হয়ে থাকে; Source: Money Crashers

আর তাই বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে যোগ্য প্রার্থীকে আবেদনের জন্য আগ্রহী করা থেকে শুরু করে বাছাই করে নিয়োগ দেওয়া পর্যন্ত সমস্ত কার্যক্রম পরিচালনার জন্য সম্ভাব্য ব্যয় প্রতিষ্ঠানকেই বহন করতে হয়। চলুন জেনে নেওয়া যাক কর্মী নিয়োগের যাবতীয় ব্যয়গুলো সম্পর্কে।

১. নিয়োগের ব্যয়

কোনো প্রতিষ্ঠানে নতুন কর্মী নিয়োগের সময় সর্বপ্রথম বিবেচনায় আসে কর্মী নিয়োগের যাবতীয় খরচসমূহের বিষয়। প্রতিষ্ঠানে নতুন কর্মী প্রয়োজন হলেও যদি এর যথাযথ নিয়োগ ও বেতন দেওয়ার মতো ক্ষমতা প্রতিষ্ঠান না রাখে তাহলে কর্মী নিয়োগ দেওয়াটাই বোকামি হবে। তাই আগে প্রতিষ্ঠানের সামগ্রিক অবস্থা বিবেচনা করে কর্মী নিয়োগের যাবতীয় ব্যয় সম্পর্কে একটি ধারণা নিন।

কর্মী নিয়োগের যাবতীয় কার্যাবলী সম্পাদনের প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরীণ কিছু ব্যয় হয়; Source: joshuawilsoncpa.com

ব্যবসায়ের উপদেষ্টা উইলিয়াম জি ব্লিসের মতে একজন কর্মী নিয়োগের প্রক্রিয়াধীন বিভিন্ন ধরণের বড় মাপের ব্যয় অন্তর্ভুক্ত থাকে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু ব্যয় হলো কর্মী নিয়োগের বিজ্ঞাপন প্রচার, অভ্যন্তরীণ নিয়োগকারীদের জন্য ব্যয়, নিয়োগ সংক্রান্ত বিষয় পুনরায় পর্যালোচনা ও অন্যান্য যাবতীয় কাজ সম্পাদনের ক্ষেত্রে নিয়োগকারীদের সহায়তার জন্য ব্যয়, সাক্ষাৎকার পরিচালনা ব্যয়, কর্মীর ব্যাকগ্রাউন্ড চেক ব্যয় এবং বিভিন্ন প্রাক-কর্মসংস্থান মূল্যায়ন পরীক্ষা করানো ব্যক্তির ব্যয়।

অর্থাৎ যেহেতু একজন নতুন কর্মী নিয়োগ দিতে প্রতিষ্ঠানকে অনেক ধরণের ব্যয়ের সম্মুখীন হতে হয়, সেহেতু সূক্ষ্মভাবে যাচাই বাচাই করে কর্মী নিয়োগের সিদ্ধান্ত নেওয়া এবং প্রয়োজনীয় অর্থ সংগ্রহ করা প্রয়োজন।

২. প্রশিক্ষণের ব্যয়

প্রতিষ্ঠানে নতুন কর্মী নিয়োগ এবং সঠিক স্থানে তাকে দায়িত্ব বুঝিয়ে দেওয়ার পরই আসে কর্মী প্রশিক্ষণের বিষয়। একজন নতুন কর্মীকে হুট করে কাজে লাগিয়ে দিলে, তার কাছ থেকে খুব একটা ভালো কাজ আশা করা যায় না। বরং তার উপর আরোপিত কাজ এবং আপনার প্রতিষ্ঠানের যাবতীয় কার্যাবলি সম্পর্কে তাকে বুঝিয়ে দিলে, সে আরো সহজভাবে কাজগুলো করতে পারবে। এ প্রসঙ্গে “মাইক্যাল জে জুসিয়াস” বলেন, “প্রশিক্ষণ হলো যেকোনো প্রক্রিয়া, যা দ্বারা কর্মীর কার্যসম্পাদন প্রবণতা, দক্ষতা এবং সামর্থ্য বৃদ্ধি পায়।”

কর্মীদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য প্রশিক্ষক নিয়োগসহ আরও নানা ধরণের ব্যয় হয়ে থাকে। তাই কর্মী প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানের সবচেয়ে ব্যয়বহুল বিনিয়োগ হিসাবে প্রমাণিত হয়। প্রশিক্ষণ ম্যাগাজিনের ২০১৩ সালের সমীক্ষা অনুসারে, প্রতিটি প্রতিষ্ঠান কর্মী প্রশিক্ষণের জন্য বছরে গড়ে ১৮৮৬ ডলার ব্যয় করে। ২০১৬ সালের সমীক্ষা অনুযায়ী কর্মীরা প্রতি বছর গড়ে ৪৭.৬ ঘন্টা প্রশিক্ষণের জন্য ব্যয় করেন।

উদ্যোক্তা এবং পরামর্শদাতা “স্কট অ্যালেন” প্রশিক্ষণের ব্যয় বোঝার একটি সহজ উপায় বিশ্লেষণ করে বলেছেন, “নতুন কর্মীকে ১০০% উৎপাদনশীলতার প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য কাঠামোগত প্রশিক্ষণের (উপকরণ সহ) এবং ম্যানেজার ও মূল সহকর্মীদের জন্যেও প্রতিষ্ঠান থেকে ব্যয় নির্ধারণ করুন।”

৩. বেতন ব্যয়

বেতন ব্যয় কর্মী নিয়োগের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যয়। এটি কর্মীর অর্থনৈতিক অবস্থা ও আবেগ দ্বারা পরিচালিত হয়। একজন কর্মী আপনার প্রতিষ্ঠানে কাজ করবেই তার অভিজ্ঞতা ও আর্থিক সচ্ছলতার জন্য। তাই কর্মী নিয়োগের আগে অবশ্যই কর্মীর কাজ ও পারিশ্রমিক নির্ধারণ করুন।

নতুন কর্মীর বেতন ব্যয় নির্ধারণ; Source: terrameridiana.com

কর্মীর অভিজ্ঞতা, কাজের ধরণ, মান, বৈশিষ্ট্য, শিক্ষাগত যোগ্যতা ইত্যাদি বিষয় বিবেচনা করে বেতন নির্ধারণ করতে হয়।
অনেক সময় আশানুরূপ কর্মী না পেলে অথবা নির্দিষ্ট পদ অনুযায়ী অধিক মানসম্মত কর্মী পেলে তাৎক্ষণিক বিবেচনা করে বেতন নির্ধারণ করতে হয়। অর্থাৎ প্রতিষ্ঠানে নতুন কর্মী নিয়োগের ক্ষেত্রে অত্যন্ত নমনীয় একটি বিষয় হলো বেতন ব্যয়।

তাছাড়া বর্তমানে অনেক প্রতিষ্ঠান নতুন কর্মী নিয়োগ দিলে বেতনের অতিরিক্ত কিছু সুবিধা ব্যয় দিয়ে থাকে। যেটা কর্মীদের অনুপ্রেরণা যোগাতে খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এই বিষয়ে বোস্টন বিজনেস জার্নালের কলামিস্ট এবং এমআইটির স্লোয়ান স্কুল অফ ম্যানেজমেন্টের প্রভাষক “জো হাডজিমার” বলেন, “বেতনের অতিরিক্ত সুবিধা ব্যয় সাধারণত মূল বেতনের ২৫℅ থেকে ৪০% পর্যন্ত হয়ে থাকে।”

৪. কর্মক্ষেত্রে একীকরণের ব্যয়

নতুন কর্মী নিয়োগের মূখ্য ব্যয়গুলোর পাশাপাশি কিছু গৌণ ব্যয়ও অন্তর্ভুক্ত থাকে। যেহেতু এরুপ প্রত্যকটি ব্যয়ই প্রতিষ্ঠানের অর্থিক অবস্থার উপর প্রভাব ফেলে, সেহেতু মূখ্য ও গৌণ দুই ধরণের ব্যয়কেই গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা উচিত। গৌণ ব্যয়গুলোর মধ্যে অন্যতম একটি হলো কর্মক্ষেত্রে একীকরণের ব্যয়। যেমন নতুন কর্মীর কাজের জায়গা একীকরণ, একটি ডেস্ক বরাদ্দ করা, তার সহকর্মীদের আশেপাশে থেকে কাজ করতে পারার জন্য সুবিধা দেওয়ার বিষয়গুলোও বেশ ব্যয়বহুল হতে পারে।

যদিও বর্তমান ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানগুলোতে একটি কম্পিউটার, একটি চেয়ার এবং একটি ডেস্ক শুরু থেকেই সরবরাহ করা থাকে৷ তবে এর বাইরেও কিছু জিনিস প্রয়োজন হয় যার জন্য প্রতিষ্ঠানকে বাড়তি কিছু ব্যয় বহন করতে হয়। যেমন বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সফটওয়্যার, সেল ফোন, ভ্রমণ এবং কাজের জন্য প্রয়োজনীয় কোনো বিশেষ সরঞ্জাম ইত্যাদি।

৫. সমচ্ছেদ বিন্দু

ব্রেক ইভেন পয়েন্ট বা সমচ্ছেদ বিন্দু বলতে প্রতিষ্ঠানের উৎপাদন অথবা বিক্রয় মাত্রার ঐ অবস্থান কে বুঝায় যেখানে মোট বিক্রয় ও মোট ব্যয়ের পরিমাণ সমান হয়। অর্থাৎ এই বিন্দুতে প্রতিষ্ঠানের কোনো লাভ লোকসান কিছুই হয় না৷ পরবর্তীতে ক্রমান্বয়ে ব্যয়ের তুলনায় লাভ বাড়তে থাকে। ঠিক তেমনি প্রতিষ্ঠানে একজন নতুন কর্মীকে নিয়োগ দিলে সে শুরুতেই ১০০% কাজ দিতে পারবে না। বরং কাজ করতে করতে একসময় সমচ্ছেদ বিন্দুতে পৌঁছাবে এবং ক্রমান্বয়ে কাজের মান ভালো হতে থাকবে।

নতুন কর্মীদের জন্য বিনিয়োগ করলে পরবর্তীতে তারাই প্রতিষ্ঠানের উন্নয়ন করতে পারবে; Source: community.articulate.com

সম্প্রতি এক গবেষণায় দেখা যায় যে, নতুন কর্মীদের প্রথম মাস বা প্রশিক্ষণ শেষ হওয়ার পর, তারা প্রায় ২৫% উৎপাদনশীলতায় কাজ করেন। অর্থাৎ এই উৎপাদনশীলতার ব্যয় কর্মীর বেতনের ৭৫% হয়। পরবর্তী ৫ থেকে ১২ সপ্তাহের মধ্যে উৎপাদনশীলতা ৫০% পর্যন্ত যায়, যার ব্যয় কর্মীর বেতনের ৫০% এর সমান। এবং সর্বশেষ ১৩-২০ সপ্তাহের মধ্যে সাধারণত কর্মীরা উৎপাদনশীলতার হার ৭৫% পর্যন্ত নিয়ে আসে, যার ফলে তখন কর্মীর বেতনের ২৫% পর্যন্ত ব্যয় হয়। সুতরাং কর্মীর জন্য প্রথমে বিনিয়োগ করলে পরে তার ফলাফল ক্রমান্বয়ে আপনার প্রতিষ্ঠানই গ্রহন করবে।

Featured Image Source: medianaranja.com.do