কার্বন ক্যাপচার স্কিড: পানি যখন গাড়ির জ্বালানি

Source: Pinterest

পৃথিবী চার ভাগের তিনভাগই পানি। ছোট থেকেই আমরা বিজ্ঞান বইয়ে একথা পড়ে আসছি। এত বিপুল পরিমাণ পানি থাকা সত্ত্বেও এর বেশিরভাগই লবণাক্ত। তাই এর পুরোপুরি ব্যবহারও আমরা করতে পারছি না। অন্যদিকে সারা পৃথিবীতে প্রায় প্রতিটি দেশেই রয়েছে জ্বালানির স্বল্পতা। এখন যদি পানিকেই জ্বালানি হিসাবে ব্যবহার করা যায় তাহলে সেটা কেমন হতো? নিশ্চয়ই অসাধারণ আইডিয়া হবে সেটা। কল্পনাতে এর অবস্থান এতদিন হলেও আমেরিকান নাভাল রিসার্চ ল্যাবরেটরি দিতে যাচ্ছে এর বাস্তবিক রূপ। যদিও বর্তমানে আরো অনেক দেশেই চলছে এর গবেষণা।

গবেষণার আনুষ্ঠানিক শুরুটা হয়েছিলো ২০১১ সনের জানুয়ারি মাসে নেভাল রিসার্চ ল্যাবরেটরির বিজ্ঞানীদের হাত ধরে। যদিও পানি থেকে জ্বালানি উৎপাদন তৈরি করার আইডিয়া নতুন নয়। এক দেড়শো বছর পূর্বে প্রথম ক্যাটালাইসিস কনভার্টার আবিষ্কারের পরেই বিভিন্ন বিজ্ঞানী এর কথা ভেবেছিলো। এখন কথা হচ্ছে সমুদ্রের পানি হতে জ্বালানি কিভাবে উৎপাদন করা হবে ?

Source: Pinterest

প্রথমত, আমরা জানি সমুদ্রের পানি সবচেয়ে বেশি কার্বন ধারণ করে যেটা অবশ্য বিশ্বের গ্রিন হাউজ ইফেক্টের জন্যও দায়ী বটে। যাই হোক, সমুদ্র হচ্ছে কার্বনের খনি বলা যায়, ফ্যাক্ট হচ্ছে এর ধারণকৃত কার্বনের পরিমাণ বাতাসের থেকে একশত চল্লিশগুণ বেশি। সমুদ্রের পানিতে থাকা সর্বমোট কার্বন ডাই অক্সাইডের ২ থেকে ৩ শতাংশ পরিমাণ কার্বন ডাই অক্সাইড সমুদ্রের পানিতে কার্বনিক এসিডের গ্যাস হিসাবে থাকে, ১ শতাংশ থাকে কার্বনেট হিসাবে এবং বাকি ৯৬ থেকে ৯৭ শতাংশ বাই – কার্বনেট হিসাবে পাওয়া যায়।

এখন কথা হচ্ছে, যদি লোহা বেস হিসাবে নিয়ে ক্যাটালাইসিস কনভার্টার তৈরি করা হয়, সেক্ষেত্রে দেখা যায় কার্বন ডাই অক্সাইডের ৬০ ভাগ কার্যকরীভাবে পাওয়া যায় আর সবথেকে কম পরিমাণ মিথেন গ্যাস উৎপাদন হয়। মিথেন গ্যাস পরিমাণে কম তৈরি করার উদ্দেশ্য হচ্ছে এই গ্যাস পরিবেশের ক্ষতি করবে তাই যত কম উপজাত হিসাবে পাওয়া যাবে ততটা উত্তম বলা চলে। এছাড়া পরবর্তী পদক্ষেপে অসম্পৃক্ত দীর্ঘাকার হাইড্রোকার্বন (ওলিফিন) চেইন তৈরিতে এর ভূমিকা থাকে।

Source: Pinterest

দ্বিতীয় স্টেপে হাইড্রোকার্বন (ওলিফিন) নিয়ন্ত্রিত পলিমারাইজেশন করে উচ্চ অাণবিক ক্ষমতাসম্পন্ন যৌগিক মিশ্রণে পরিবর্তিত করা হয়। যেটা কিনা হাইড্রোকার্বনের সি ৯ – সি ১৬ শ্রেণীর এক ধরনের কৃত্রিম জ্বালানি। বর্তমানে এই জ্বালানিকে প্রেট্রোলিয়ামজাত জেটের জ্বালানির বিকল্প ধরা হয়ে থাকে।

প্রজেক্ট শুরু করার বছর খানেক পর নেভাল রিসার্চ ল্যাবরেটরির বিজ্ঞানীরা প্রথম ভালো ফলাফল দেখাতে সক্ষম হয়। তারা সমুদ্রের পানি দিয়ে তৈরি এই সিনথেটিক জ্বালানি প্রথমবারের মতো রেডিও কন্ট্রোল এয়ারক্রাফটে ব্যবহার করেন। যেটা কিনা ছিলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পি-৫১ ম্যাসট্যাংয়ের রেপ্লিকা। তারা সেই পরীক্ষায় দেখায় ইঞ্জিনের কোনোরূপ পরিবর্তন না করেই এই কার্বন ক্যাপটর স্কিড প্রযুক্তি দিয়ে উৎপাদিত জ্বালানি ব্যবহার করা সম্ভব।

Source: Pinterest

তারা এটাও দেখায় এই প্রযুক্তি ব্যবহার করলে জ্বালানি উৎপাদনের খরচ কমে আসবে ফলে সল্প খরচে সবার কাছে এই জ্বালানি পৌছে দেওয়া সম্ভব হবে। তাদের হিসাব অনুযায়ী এই প্রযুক্তিতে প্রতি গ্যালন জ্বালানি উৎপাদনে ব্যয় হবে ৩ থেকে ৬ ডলারের মতো। আর সারাবিশ্বে পৌঁছে দেওয়ার জন্য বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু হবে দশ বছরেরও কম সময়ের মধ্যে।

সুবিধা-অসুবিধা

প্রতিটি আবিষ্কারের শুরুতে অনেক নেতিবাচক দিক আর বেশ টেকনিক্যাল সমস্যা আমরা দেখতে পাই। কার্বন ক্যাপচার স্কিডও এর হতে আলাদা নয়। এই প্রযুক্তির সবথেকে বড় বাধা হচ্ছে সমুদ্রের পানির সরবরাহ। অবাক হয়ে নিজেকেই প্রশ্ন করতে পারেন পানির সরবরাহ নিয়ে কিভাবে সমস্যা হবে যেখানে সমুদ্র অফুরন্ত পানি রয়েছে।

প্রথম সমস্যা হচ্ছে, সমুদ্রের প্রতি লিটার পানিতে থাকে ১০০ মিলিগ্রাম কার্বন। যদিও বাতাসের থেকে এর পরিমাণ ১৪০ গুণ বেশি, তবুও প্রতি গ্যালন জ্বালানি তৈরি করতে প্রয়োজন হবে ৩৯ হাজার গ্যালন সমুদ্রের পানি। তবে সমস্যা সেটা নয়। সমস্যা হচ্ছে পানি উত্তোলন করা। যদি কোন জাহাজে এই প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয় তখন জাহাজকে পাম্পিং করে সমুদ্র হতে এই পরিমাণ পানি মাত্র গ্যালন জ্বালানি তৈরি করার জন্য তুলতে হবে। যেটা কিনা কষ্টসাধ্য ব্যাপার বটে।

Source: Pinterest

আর এই পরিমাণ পানি তুলতে যদি তেল ব্যবহার করতে হয় তাহলে এর কোন সুবিধা পাওয়া যাবে না। এছাড়া কনর্ভারটারের প্রচুর পরিমাণে বৈদ্যুতিক শক্তির প্রয়োজন হবে। সেই পরিমাণ বিদ্যুৎ পাওয়ার জন্য জন্য আমরা আমার জ্বালানিই ব্যবহারই করি তাহলে পুরো কাজটাই ব্যর্থ প্রজেক্ট হয়ে যাবে।

তবে এর উত্তরনের উপায় রয়েছে। যদি পাওয়ার হিসাবে নিউক্লিয়ার শক্তি ব্যবহার করা হয় তখন এর ৮০ শতাংশ কার্যকারিতা আমরা দেখতে পাবো। কিন্তু এখানেও রয়েছে আরেক সমস্যা। নৌবাহিনীর কিছু ক্যারিয়ার জাহাজ ব্যতীত পারমাণবিক শক্তি ব্যবহার করে এমন জাহাজ সাধারণত নেই। সুতরাং দেশের সরকার ব্যতীত এই প্রজেক্ট কেউ এগোতে পারবে এমন সুযোগটি নেই বললেই চলে।

Source: Pinterest

তার উপর সমুদ্রের পরিবেশের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভবনা তো রয়েছেই। প্লাংকটনসহ বিভিন্ন সামুদ্রিক উদ্ভিদ এই কাজের ফলে তাদের স্বাভাবিক বংশবৃদ্ধির পরিবেশ হারাবে। যার ফলে সামুদ্রিক খাদ্যশৃঙ্খল নষ্ট হবে আর হাজার হাজার প্রজাতি বিলুপ্ত হবে। এছাড়া ৬০ শতাংশ গ্যাস পানি থেকে পরিবর্তিত করা গেলে বাকি চল্লিশ শতাংশ পরিবেশের বিভিন্নরূপ ক্ষতি করবে। কারণ এই ৪০ শতাংশের মধ্যকার ২৫ শতাংশই হচ্ছে পরিবেশের জন্য ক্ষতিকারক মিথেন।

তবে এর বেশ কয়েকটি খারাপ দিকে থাকলেও ভালো দিক হচ্ছে আমাদের কখনোই জ্বালানির স্বল্পতা হবে না। কারণ বিভিন্ন ইঞ্জিনে যখন এই জ্বালানি ব্যবহার করা হবে সেটা আবার কার্বন রুপেরই তো বায়ুমণ্ডলে মিশ্রিত হবে। আর বায়ুমণ্ডলে যখন কার্বন যাবে সেটা একসময় পানি হয়ে আবার ফিরে আসবে সমুদ্রে। ফলে আমরা পারো অফুরন্ত জ্বালানির উৎস।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *