ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা অনেক পুরানো চিকিৎসা পদ্ধতি। প্রাচীন গ্রিসে হিপোক্রেটাস ফিজিওথেরাপি চিকিৎসার সূচনা করেছিলেন, ম্যাসেজ ও ম্যানুয়াল থেরাপির মাধ্যমে। ফিজিওথেরাপি শব্দটি ফিজিও (শারীরিক) এবং থেরাপি (চিকিৎসা) শব্দ দুটি থেকে আগত। আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের অন্যতম এবং অপরিহার্য শাখা হচ্ছে ফিজিওথেরাপি।
Image Source: nahb.com
যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের জন্য ১৯৭২ সালে বিদেশি ফিজিওথেরাপিস্টদের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশে ফিজিওথেরাপি চিকিৎসার যাত্রা শুরু হয়। ফিজিওথেরাপি চিকিৎসার গুরুত্ব ও প্রয়োজন অনুধাবন করে ১৯৭৩ সালে আরআইএইচডি (বর্তমানে নিটোর) ফিজিওথেরাপি চিকিৎসার ওপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসা অনুষদের অধীনে স্নাতক ডিগ্রি চালু করে।
ফিজিওথেরাপি এমন একটি চিকিৎসা পদ্ধতি, যেখানে শারীরিক ব্যায়ামের মাধ্যমে চিকিৎসা, রোগ প্রতিরোধ এবং প্রতিবন্ধকতাজনিত জটিলতা প্রতিরোধে স্বাস্থ্য সেবা প্রদান করা হয়। এই পদ্ধতির চিকিৎসকদের ফিজিওথেরাপিস্ট বলা হয়। ফিজিওথেরাপিস্টরা মানবদেহের কার্যপ্রণালী উন্নয়ন, ব্যথা নিয়ন্ত্রণ ও নিরাময় এবং স্থায়ী অক্ষমতা প্রতিকার ও প্রতিরোধে কাজ করে থাকেন। এ ধরণের চিকিৎসা পদ্ধতির প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো এই পদ্ধতিতে ঔষধ প্রয়োগ ও অস্ত্রোপচারের পরিবর্তে শারীরিক ব্যায়াম, ম্যাসেজ, তাপ চিকিৎসার মাধ্যমে বিভিন্ন ব্যথাজনিত রোগ নিরাময় ও প্রতিকার করা হয়।
আমরা যদি আমাদের দেহের বিভিন্ন রোগের কথা চিন্তা করি তাহলে বুঝতে পারবো, শুধু ওষুধ সব রোগের পরিপূর্ণ সুস্থতা দিতে পারে না। কিছু কিছু ক্ষেত্রে ওষুধের পাশাপাশি যেমন অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন হয়, তেমনি কিছু রোগে ওষুধের পাশাপাশি ফিজিওথেরাপি চিকিৎসার প্রয়োজন হয়। বিশেষ করে যেসব রোগের উৎস বিভিন্ন মেকানিক্যাল সমস্যা ও ডিজেনারেটিভ বা বয়স জনিত সমস্যা, সেসব ক্ষেত্রে ওষুধের মাধ্যমে সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা তুলনামূলকভাবে কম।
যেসব রোগে ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা প্রয়োজন
বাতের ব্যথা, কোমর ব্যথা, ঘাড় ব্যথা, হাঁটু ও গোড়ালির ব্যথা, আঘাতজনিত ব্যথা, ডিস্ক প্রলেপস-জনিত ব্যথা, সায়াটিকা, হাড় ক্ষয়জনিত ব্যথা (যেমন: সারভাইক্যাল ও লাম্বার স্পন্ডাইলোসিস, অস্টিও-আরথ্রাইটিস), জয়েন্ট শক্ত হয়ে যাওয়া বা ফ্রোজেন সোল্ডার, প্লাস্টার বা অপারেশন পরবর্তী জয়েন্ট স্টিফনেসস, স্ট্রোক-জনিত প্যারালাইসিস, স্পাইনাল কর্ড ইনজুরি বা অন্য কারণে প্যারালাইসিস-জনিত সমস্যা, মুখ বেঁকে যাওয়া বা ফেসিয়াল পালসি, বিভিন্ন ধরনের অপারেশন পরবর্তী সমস্যা থেকে পরিপূর্ণ সুস্থতা লাভের জন্য ওষুধের পাশাপাশি ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা প্রয়োজন।
Image Source: fitforwork.org
এছাড়াও জন্মগত বাঁকা পা বা ক্লাবফিট, গাইনোকলজিক্যাল সমস্যায় সেরিব্রাল পলসি (প্রতিবন্ধী শিশু), অ্যানকাইলজিং স্পন্ডাইলাইটিস, পারকিন্সন ডিজিজ, বার্ধক্যজনিত সমস্যা ইত্যাদি চিকিৎসার ক্ষেত্রে ও পুনর্বাসন সেবায় ফিজিওথেরাপির ভূমিকা অপরিসীম।
কাজের ধরন
একজন ফিজিওথেরাপি চিকিৎসক রোগীর রোগ বর্ণনা, বিভিন্ন ধরণের টেস্ট, যেমন: ফিজিক্যাল টেস্ট, ফিজিওথেরাপিউটিক স্পেশাল টেস্ট, প্রয়োজন অনুযায়ী বিভিন্ন রেডিওলজিক্যাল এবং প্যাথলজিক্যাল টেস্টের মাধ্যমে রোগ নির্ণয় করে থাকেন। এরপর রোগীর প্রয়োজন অনুযায়ী চিকিৎসার পরিকল্পনা করেন এবং সেই অনুযায়ী বিভিন্ন পদ্ধতি যেমন: ম্যানুয়াল থেরাপি, ম্যানিপুলেটিভ থেরাপি, মোবিলাইজেশন, মুভমেন্ট উইথ মোবিলাইজেশন থেরাপির সেবা প্রদান করে থাকেন। কিছু কিছু ক্ষেত্রে থেরাপির পাশাপাশি ওষুধও ব্যবহার করতে হয়।
শিক্ষাগত যোগ্যতা
ফিজিওথেরাপিস্ট হতে চাইলে ফিজিওথেরাপি বিষয়ে ৪ বছরের স্নাতক ডিগ্রি এবং ১ বছর ইন্টার্নশিপ করতে হবে। স্নাতক ডিগ্রির পর ফিজিওথেরাপিস্টরা বিশেষায়িত নানা বিষয়ে, যেমন- নিউরো ফিজিওথেরাপি, অর্থো ফিজিওথেরাপি, স্পোর্টস ফিজিওথেরাপি, চেস্ট ফিজিওথেরাপি, গাইনোকোলজিক্যাল ফিজিওথেরাপিতে
আরো ১ বা ২ বছর মেয়াদী স্নাতকোত্তর কোর্সও করতে পারেন। বাংলাদেশে বিভিন্ন মানের ফিজিওথেরাপিস্ট রয়েছেন,
কোয়ালিফাইড ফিজিওথেরাপিস্ট
যার ফিজিওথেরাপি বিষয়ে ৪ বছর মেয়াদি স্নাতক ডিগ্রি এবং সেইসাথে ১ বছরের ইন্টার্নশিপের অভিজ্ঞতা রয়েছে তাকে কোয়ালিফাইড ফিজিওথেরাপিস্ট বলা হয়। শুধুমাত্র ফিজিওথেরাপি বিষয়ে ব্যাচেলর বা মাস্টার্স ডিগ্রিধারীকেই ‘ফিজিওথেরাপিস্ট’ বলা হয়ে থাকে।
ডিপ্লোমা ফিজিওথেরাপিস্ট
ডিপ্লোমা ফিজিওথেরাপিস্ট হতে চাইলে ফিজিওথেরাপি বিষয়ে ৩ বছর মেয়াদি ডিপ্লোমা কোর্স সম্পন্ন করতে হবে। তিনি একজন কোয়ালিফাইড ফিজিওথেরাপিস্টের অধীনে চিকিৎসাসেবা প্রদান করতে পারবেন।
অ্যাসিস্ট্যান্ট ফিজিওথেরাপিস্ট
মাত্র ১ বছরের কোর্স সম্পন্ন করেই অ্যাসিস্ট্যান্ট ফিজিওথেরাপিস্ট হওয়া যায়। তবে একজন অ্যাসিস্ট্যান্ট ফিজিওথেরাপিস্টকে অবশ্যই একজন কোয়ালিফাইড ফিজিওথেরাপিস্টের অধীনে চিকিৎসাসেবা প্রদান করতে হবে।
কোথায় ফিজিওথেরাপি পড়ানো হয়
বর্তমানে বাংলাদেশে সিআরপি, গণবিশ্ববিদ্যালয়, পিপলস ইউনিভার্সিটি, স্টেট কলেজ অব হেলথ সাইন্সেস সহ মোট ৭ টি প্রতিষ্ঠানে ফিজিওথেরাপি বিষয়ে স্নাতক ও ডিপ্লোমা কোর্স চালু আছে।
Image Source: stepupbarrie.com
একজন ফিজিওথেরাপিস্টের যেসব যোগ্যতা ও দক্ষতা থাকতে হবে
- যোগাযোগ করার দক্ষতা
- ধৈর্যশীলতা
- পরিশ্রম করার মানসিকতা
- সহানুভূশীলতা
- উদ্যমী
- ইতিবাচক মনোভাব
- চিন্তা করে বিশ্লেষণ করা
- সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা ইত্যাদি
কাজের ক্ষেত্র
কবিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে ফিজিওথেরাপিস্টের পদ রয়েছে। বর্তমানে সরকার দেশের প্রতিবন্ধী সনাক্তকরণ ও চিকিৎসা ব্যবস্থা চালু করেছে। দেশের ৬৪ জেলাসহ ৬৮টি স্থানে প্রতিবন্ধী উন্নয়ন প্রকল্প চালু রয়েছে। প্রতিবন্ধী চিকিৎসা, উন্নয়ন ও পুনর্বাসন প্রক্রিয়ার প্রধান বিষয় ফিজিওথেরাপি। দেশের বিশেষায়িত সরকারি হাসপাতাল ও মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসমূহে ফিজিওথেরাপি বিভাগ, কোনো কোনো ক্ষেত্রে ওয়ার্ড পর্যন্ত রয়েছে। বর্তমানে আলাদাভাবে ফিজিওথেরাপি সেন্টার সমূহ গড়ে উঠছে, যার কারণে ফিজিওথেরাপিস্টদের চাহিদা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। আবার বিভিন্ন সমাজসেবামূলক প্রতিষ্ঠান ও এনজিওতে ফিজিওথেরাপিস্টেরদের চাহিদা রয়েছে। এছাড়াও বিভিন্ন খেলোয়াড়দের দলেও ফিজিওথেরাপিস্ট নিয়োগ দেয়া হয়।
আয় রোজাগার
সরকারি বিভিন্ন হাসপাতালে জাতীয় বেতন স্কেল অনুযায়ী বেতন দেয়া হয়। বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে অভিজ্ঞতা অনুযায়ী বেতন দেওয়া হয়। এর বাইরে ব্যাক্তিগত ভাবে কাজ করার সুযোগ তো থাকছেই। ফ্রেস গ্র্যাজুয়েটরা চাকরির প্রথম দিকে ১৫,০০০-২০,০০০ টাকা পর্যন্ত বেতন পেয়ে থাকেন। তবে অভিজ্ঞতা বাড়ার সাথে সাথে বেতনের পরিমাণও বাড়তে থাকে।
Featured Image: physiotherapyalberta.com