ইস্টি লোডার: ব্যবসায়িক জগতে সফল এক নারী

ইস্টি লোডার যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী একজন সফল নারী উদ্যোক্তা যিনি বিশ্বখ্যাত ইস্টি লোডার কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা। এছাড়াও তিনি ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের ধনাঢ্য নারীউদ্যোক্তাদের মধ্যে একজন। ১৯৯৮ সালে প্রকাশিত টাইম ম্যাগাজিনের মতে, বিংশ শতাব্দীর প্রভাবশালী নারী ব্যবসায়ীদের মধ্যে একজন হিসেবে উলেখ করা হয় তাকে। প্রসাধনীর জগতে বিপ্লব নিয়ে আসা এই নারীকে নিয়েই আজকের আলোচ্য বিষয়বস্তু।

{ "slotId": "2452885053", "unitType": "in-article" }
ছবিসূত্র: Dave Lackie

শৈশব

ইষ্টি লাউডারের জন্ম দাপ্তরিকভাবে ১৯০৮ সালের ১ জুলাই, কিন্তু মতান্তরে তার জন্ম ১৯০৬ সালের ১ জুলাই। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্ক সিটির করোনাতে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা ম্যাক্স মেন্‌যার ১৮৯০ সালে চেকোস্লোভাকিয়া থেকে যুক্তরাষ্ট্রে দেশান্তর হন। তিনি প্রথমদিকে একজন দর্জি এবং পরবর্তীতে তাদের করোনার বাসার নিচে একটি হার্ডওয়্যারের দোকান খোলেন। তার মা রোজ নি স্কটজ্‌নি রোসেন্থাল ৯ সন্তান আর এই বড় সংসার সামলানোর পরও তার সৌন্দর্য নিয়ে বেশ সচেতন ছিলেন এবং খুব আড়ম্বরপূর্ণও ছিলেন বটে! সূর্যের অতি বেগুনি রশ্মি থেকে তার ত্বককে রক্ষা করার জন্য তিনি বাইরে বের হওয়ার আগে সবসময় প্যারাসল ব্যবহার করতেন। শৈশবে ইস্টি চুল আঁচড়াতে খুব পছন্দ করতেন এবং অপেক্ষা করতেন যে, তিনি কবে তার মায়ের মতো বড় হবেন। তিনি তার বাবার দ্বারাও বেশ অনুপ্রাণিত ছিলেন।

ইস্টি তার মা-বাবার জীবনযাপনের মান নিয়ে বিব্রতবোধ করতেন। আর মনেপ্রাণে চাইতেন যে, তিনি যেন পুরোই যুক্তরাষ্ট্রের অধিবাসীদের মতো হবেন। তবে তার সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ ইচ্ছাটি ছিলো একজন সফল অভিনেত্রী হওয়া এবং তিনি চাইতেন সব জায়গায় তার নাম ছড়িয়ে পড়ুক। কলেজে পড়াকালীন তিনি তার বাবার দোকানে সহযোগী হিসেবে কাজ করতেন। সেখান থেকে তিনি খুচরা ব্যবসায়ের মৌলিক বিষয়গুলো জানতে পেরেছেন। আরও বুঝতে পেরেছেন উৎকর্ষের গুরুত্ব। এছাড়াও পণ্যের বাহ্যিক রূপ কতটা গুরুত্বপূর্ণ এবং গুণাগুণ সম্পন্ন পণ্য কীভাবে প্রচার করতে হয় তাও তিনি শিখেছিলেন।

বড়দিনের সময় তার বাবা কীভাবে হাতুড়ি ও পেরেক সুন্দর করে র‍্যাপিং কাগজে মুড়ে গ্রাহকদের উপহার হিসেবে দিতেন তাও তিনি লক্ষ করেছেন। পরবর্তীতে অধিক হারে ক্রেতাদের আকর্ষণ করার জন্য তিনি এই কৌশলটি অবলম্বন করেন।

{ "slotId": "", "unitType": "in-article", "pubId": "pub-6767816662210766" }
ছবিসূত্র: WhenHub Studio

শিক্ষা জীবন

১৯১৪ সালে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ আরম্ভের কিছুটা পরপরই তার মামা জন স্কটজ্‌ নিউ ইয়র্ক সিটিতে তাদের সাথে থাকতে চলে আসেন। পেশায় তিনি একজন রাসায়নবিদ ছিলেন। ইস্টিদের বাসার পেছনের খালি জায়গাটিতে রসায়নাগার তৈরি করেন। আর এর নাম দেন নিউ ওয়ে ল্যাবরেটরিজ যেখানে প্রাকৃতিক সব উপাদান দিয়ে প্রস্তুত করা হতো ক্রিম, লোশন, সুগন্ধি। সবসময়ই সৌন্দর্য নিয়ে উৎসুক ইস্টি তার মামার কাজ কাজ দেখেই তখন বেশিরভাগ সময় কাটাতেন। ইস্টি তার মামার ব্যবসায়ে সাহায্য করা শুরু করলেন এবং কীভাবে মুখ পরিষ্কার ও ম্যাসাজ করতে হত তাও শিখলেন।

ধীরে ধীরে তিনি সেসব পণ্যগুলো তার কলেজের সহপাঠীদের কাছে বিক্রি করা শুরু করলেন। আর সেই প্রথমদিকে তার পণ্যগুলোর নাম দিলেন ‘জারস অব হোপ’। তার মামার পণ্যের কার্যকারিতা প্রমাণের জন্য তিনি নিজেও তার সহপাঠীদের রূপচর্চা বিষয়ক পরামর্শ দিতেন। সময়ের সাথে সাথে তিনি তার মামার বানানো সেসব পণ্যের বিভিন্ন নাম দেয়া শুরু করলেন। যেমন সুপার রিচ অল পারপাজ ক্রিম, সিক্স ইন ওয়ান কোল্ড ক্রিম এবং ডক্টর স্কটজ্‌ ভিয়েনিজ ক্রিম। তবে কলেজ পাশ করার পরেই তিনি যথার্থভাবে প্রচারের কাজটি শুরু করেন।

ছবিসূত্র: Pinterest

প্রাথমিক কর্মজীবন

একদিন ইস্টি তার চুল কাটাতে স্থানীয় একটি স্যালুনে যান। তার কোমল ত্বক দেখে সেই স্যালুনের সত্ত্বাধিকারী ফ্লোরেন্স মরিস তার রূপের রহস্য জিজ্ঞাসা করেন। পরবর্তীতে ইস্টি সেই স্যালুনে তার মামার বানানো ৪টি পণ্য নিয়ে যান। মরিস খুব প্রভাবিত হয়ে যান এবং ইস্টিকে তার স্যালুনে সেই পণ্যগুলো বিক্রি করার প্রস্তাব দেন। স্যালুনে সেই পণ্য বিক্রির সময় ইস্টি এক ধরনের অপমানজনক অভিজ্ঞতার শিকার হন।

একদিন তিনি একজন ক্রেতাকে জিজ্ঞেস করেন যে, তার পরা ব্লাউজটি কোথা থেকে কেনা। যার উত্তরে সেই ক্রেতা ইস্টিকে বলেন যে, এটা তার জানার বিষয় নয়। কারণ তার মতে কখনোই ইস্টির সেই ব্লাউজটি কেনার সামর্থ্য হবে না। তার এই কথাটি ইস্টির এতোটাই অপমানে লাগে যে, তিনি মনে মনে প্রতিজ্ঞা নেন যে তিনি এমনভাবে উপার্জন করবেন যেন তিনি যা ইচ্ছা তা-ই কিনতে পারেন। এরপর তিনি দ্বিগুণ পরিশ্রম করা শুরু করেন এবং বিভিন্ন স্যালুন ও ক্লাবে সেই পণ্যগুলো বিক্রি করতে থাকেন। ১৯৩০ সালে জোসেফ লটারের সাথে বিয়ে এবং তাদের বড় সন্তানের জন্মের পরও এই কাজটি ইস্টি চালিয়ে যান।

প্রাথমিক এই সময়কালে, ইস্টি রাতের পর রাত রান্নাঘরে কাটাতেন। প্রাকৃতিক উপাদান দিয়ে তার পণ্যগুলো কীভাবে আরও উন্নত করা যায় সেই চেষ্টা করতেন। আর দিনেরবেলা তিনি গ্রাহকদের সাথে দেখা করতেন, পণ্য বিক্রি করতেন এবং বিনামূল্যে পণ্যও দিতেন পরীক্ষা করার জন্য। কিছুদিন পরই ইস্টি বুঝতে পারলেন যে, ব্যবসায় উন্নতির জন্য সামাজিক যোগাযোগ কতটা গুরুত্বপূর্ণ! চিন্তাভাবনার পর তিনি তার অতীতকে পাল্টে দিলেন।

তিনি তার গ্রাহকদের সমকক্ষে চলে গেলেন। বহু বছর ধরে মানুষ জানতেন যে, ইস্টি ইউরোপের অভিজাত পরিবারের একজন সদস্য। ধীরে ধীরে তিনি নিউ ইয়র্ক মেট্রোপলিটন এলাকার বিভিন্ন হোটেলে অতিথিদের সাথে দেখা করে তার বাজার প্রসারিত করা শুরু করেন। তার গ্রাহকদের সংখ্যা বাড়ছিলো ঠিকই কিন্তু তার বৈবাহিক জীবন হচ্ছিলো আশঙ্কার সম্মুখীন। যার ফলস্বরূপ ১৯৩৯ সালে তার বিবাহ বিচ্ছেদ হয়।

বিবাহ বিচ্ছেদের পরপরই তিনি ফ্লোরিডার মায়ামি সমুদ্র সৈকতে তার সন্তান্ত লিওনার্দোকে নিয়ে চলে যান। সেখানে একটি কলিন্স এভিনিউতে একটি হোটেলে তিনি কার্যালয় খুলেন। যেখানে তিনি বিত্তবান অতিথিদের কাছে তার পণ্যগুলো বিক্রি করা শুরু করেন। আর তা প্রচারের জন্য তিনি ‘টেল আ ওমেন’ নামে একটি অভিনব প্রচার অভিযান চালান।

ছবিসূত্র: Assouline

ঘুরে দাঁড়ানো

১৯৪২ সালে তার ছেলে লিওনার্দোর অসুখের কথা শুনে তার সাবেক স্বামী জোসেফ ছেলেকে দেখতে আসে। এরপর ধীরে ধীরে আবার ইস্টি এবং জোসেফের পুরনো ভালোবাসা জেগে ওঠে এবং সেই বছরই তারা পুনরায় বিয়ে করেন। তখন জোসেফ ইস্টিকে তার ব্যবসায়ে সহযোগিতা করার জন্য নিজের চাকরি ছেড়ে চলে আসেন। ইস্টি যেহেতু ব্যবসার বিকাশ এবং বিপণনের কাজে জড়িত ছিলেন সেহেতু জোসেফ উৎপাদন এবং আর্থিক সংস্থানের কাজটি দেখাশোনা করা শুরু করেন। ১৯৪৪ সালে তারা সর্বপ্রথম নিজেদের বড় উদ্যোগটি নেন এবং নিউ ইয়র্কে তাদের প্রথম দোকানটি খোলেন।

প্রথমে যখন তাদের বিয়ে হয়েছিলো তখন তারা নাম পাল্টে লোটার থেকে লোডার রাখেন। তাই ১৯৪৬ সালে যখন তারা যখন কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন, তখন নাম দেন ইস্টি লোডার ইনকর্পোরেটেড। তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে, পণ্যগুলো শুধুমাত্র বড় বড় ডিপার্টমেন্টাল স্টোরেই বিক্রি করা হবে। প্রথমদিকে তারা মাত্র ৪টি পণ্য- ক্লিঞ্জিং অয়েল, স্কিন লোশন, সুপার রিচ অল পারপাজ ক্রিম এবং ক্রিম প্যাক বিক্রি করতেন। আর সেই দোকানে তারা স্বামী স্ত্রী দু’জনই দুজনই কর্মচারী ছিলেন। ম্যানহাটেনের একটি রেস্টুরেন্টের রান্নাঘরে তারা রাতে বসে পণ্যগুলো তৈরি করতেন এবং সেটিকেই তারা কারখানা ও গুদামে রূপান্তরিত করে ফেলেন।

{ "slotId": "2452885053", "unitType": "in-article" }

১৯৪৭ সালে তারা প্রথম তাদের বড় অর্ডারটি পান। নিউ ইয়র্ক সিটির সাক্স ফিফথ নামের বিলাসবহুল একটি স্টোর থেকে তারা ৮০০ ডলারের অর্ডার পান। আর সেই অর্ডারের সব পণ্য মাত্র দুই দিনেই বিক্রি হয়ে যায় যা থেকে স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছিলো যে, বড় সব ব্র্যান্ডগুলোর সাথে ইস্টি অবলীলায় প্রতিযোগিতার যোগ্য। তখন মিসেস লোডার সারা বিশ্বে ভ্রমণ শুরু করলেন এবং বড় বড় সব স্টোরে তার পণ্য বিক্রির চেষ্টা করেন। ১৯৫০ সালের শুরুর দিকে ইস্টি লোডারের পণ্য নামজাদা সব স্টোর যেমন আই. ম্যাগনিন, মার্শাল ফিল্ডস্‌, নিয়েমেন-মার্কাস এবং বনউইট টেলারে বিক্রি হওয়া শুরু হয়। শুধুমাত্র বড় পরিসরে বিজ্ঞাপন প্রচার করাটাই বাকি ছিলো তাদের।

তবে শুধুমাত্র ৫,০০০ ডলারের বিনময়ে বিজ্ঞাপনের কাজ করার জন্য কোনো বিজ্ঞাপনী সংস্থাই রাজি হচ্ছিলো না। এরপর ইস্টি নিজেই বুদ্ধি করে স্টোরের ব্যবস্থাপকদের কাছে বিনামূল্যে পণ্যের সেম্পল দিয়ে আসতেন। এই প্রথাটি তখনকার সময়ে এতটা প্রচলিত না থাকার কারণে ব্যবস্থাপকেরা এক প্রকার ধরেই নিয়েছিলেন যে ইস্টির পণ্যগুলোর মান নিশ্চয়ই খারাপ হবে! তবে পণ্যের অভজ্ঞতা তাদের ধারণাকে অচিরেই ভুল প্রমাণ করেছে। ইস্টি এরপর পুরো যুক্তরাষ্ট্রে ভ্রমণ করে বড় বড় ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে পণ্য বিক্রি শুরু করলেন। সব জায়গাতেই তিনি বিক্রয়কর্মীদের পাশে থেকে প্রশিক্ষণ দিতেন। প্রথম প্রথম দিনে বিনামূল্যে সেম্পল বিতরণ করলেও পরবর্তীতে প্রতিটি বিক্রিত পণ্যের সাথে একটি করে উপহার দিতেন।

ডিরেক্ট মেইলের মাধ্যমে তারা বিনামূল্যে সেম্পল পাঠাতে শুরু করেন এবং দাতব্য কার্যক্রম ও ফ্যাশন শো-তে বিতরণ করেন। ১৯৫৩ সালের দিকে ব্যবসায়কে বহুমুখী করার মতো নিশ্চয়তায় তারা পৌঁছে যায়। আর সেই বছরেই তারা ‘ইউথ দিউ’ নামে গোসল করার এক ধরনের তেল বের করেন যা সুগন্ধি বিভাগে বিপ্লব সাধন করে এবং ইস্টির কোম্পানিও বিশাল লাভ করে।

{ "slotId": "2452885053", "unitType": "in-article" }

পুরষ্কার ও অর্জনসমূহ

১৯৬৭ সালে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ১০০ জন সেরা উদ্যোক্তাদের একজন এবং ১৯৭০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবসায় ক্ষেত্রে দশ জন বিশিষ্ট নারীদের একজন ছিলেন। ১৯৬৮ সালে তিনি অ্যালবার্ট আইনস্টাইন কলেজ অব মেডিসিন স্পিরিট অব অ্যাচিভমেন্ট পুরষ্কার পান।

১৯৭৮ সালের ১৬ই জানুয়ারি একজন নারী হিসেবে প্রথম ইন্সিগনিয়া অব শেভেলিয়ার অব দ্য লিজন অব অনার (ফ্রান্স) লাভ করেন। ১৯৮৮ সালে তাকে জুনিয়র অ্যাচিভমেন্ট ইউএস বিজনেস হল অব ফেম এ অভিষিক্ত করা হয়। ২০০৪ সালে তার মৃত্যুর ঠিক পরপরই তাকে প্রেসিডেন্সিয়াল মেডেল অব ফ্রিডম দেয়া হয়।

Feature Image Source: The Perfume Society

{ "slotId": "2452885053", "unitType": "in-article" }

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *