সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বা সোশ্যাল মিডিয়াগুলোর মধ্যে ফেসবুক, টুইটার, ইনস্টাগ্রাম, হোয়াটসঅ্যাপ, পিন্টারেস্ট (Pinterest) অন্যতম। কিন্তু প্রতিমাসে প্রায় ২.১৯ বিলিয়ন সক্রিয় ব্যবহারকারী নিয়ে বেশ কয়েকবছর ধরে সোশ্যাল মিডিয়ায় রাজত্ব করছে ফেসবুক। এছাড়াও ইনস্টাগ্রাম এবং হোয়াটসঅ্যাপকে ছাড়িয়ে মার্ক জাকারবার্গের ফেসবুক যেন পুরো বিশ্ব শাসন করছেন। গুগল, ফেসবুকের মত টেক জায়েন্ট কোম্পানিগুলো প্রতিবছর ডেভেলপার সম্মেলন বা কনফারেন্সের মাধ্যমে চেষ্টা করে তাদের পণ্যগুলোর নতুন এবং চমৎকার প্রযুক্তিক বৈশিষ্ট্যগুলো সবার মাঝে ব্যতিক্রমী সব নামে তুলে ধরতে। যেমন, ফেসবুকের ডেভেলপার কনফারেন্সের নাম এফ ৮ (F8) । উইকিপিডিয়ার তথ্য মতে, ফেসবুকের ঐতিহ্যবাহী ৮ ঘন্টা হ্যাকাথনের মাধ্যমে আসে এফ ৮ নামটি। ২০০৭ সাল থেকে যাত্রা শুরু করলেও এটি ফেসবুকের নবম ডেভেলপার কনফারেন্স।
তবে এ বছরের মে মাসের ১, ২ তারিখে অনুষ্ঠিত হওয়া এই সম্মেলন ফেসবুকের ইতিহাসে স্মরণকালের সেরা সম্মেলন। কেননা এই বছরের মার্চে ফেসবুককে পড়তে হয় ক্যামব্রিজ অ্যানালিটিকা কেলেঙ্কারিতে। এ ঘটনার ফলে নানা বাধার মুখে পড়ে যায় ফেসবুক। এমনকি #deletefacebook নামের হ্যাশট্যাগ ব্যবহাররের মাধ্যমেও শুরু হয় ক্যাম্পেইন। ফলে সবার মনে একটি প্রশ্ন ছিল ডাটা প্রাইভেসির এই ঘটনা ফেসবুক কিভাবে মোকাবিলা করে। কিন্তু রাজার রাজত্ব কেড়ে নেওয়া কি এত সহজ বলুন! এসব কিছুকে আমলে না নিয়ে ফেসবুক প্রতিবারের মতো আয়োজন করে বহুল কাঙ্ক্ষিত এফ ৮। তাহলে আর দেরি না করে চলুন জেনে নেয়া যাক এবারের অসাধারণ আপডেটগুলো।
বৈধ ডেটিং এখন ফেসবুকে
কি ভাবছেন ফেসবুকের মতো জায়গায় ডেটিং এর সাথে আবার বৈধতা কেন? আসলে বৈধতা শব্দটি মজা করে ব্যবহার করলেও ফেসবুক কর্তৃপক্ষ এবার আনুষ্ঠানিকভাবে ডেটিং করার সুযোগ দিচ্ছে আপনার নিজস্ব ফেসবুক প্রোফাইলটির মাধ্যমে। কেননা ফেসবুক কর্তৃপক্ষ চায় না আপনার প্রোফাইলের রিলেশনশিপ স্ট্যাটাস সিঙ্গেল থাকুক। এ বিষয়ে সিবিসি (CBC) নিউজের সিনিয়র রিপোর্টার জ্যাকলিন হ্যানসন বলেন, “হতে পারে, প্রায় ২০০ মিলিয়ন সিঙ্গেল ফেসবুক প্রোফাইলের জন্যেই মার্ক জাকারবার্গের এই অভিনব পরিকল্পনা।”
ফেসবুকের এই ডেটিং সুবিধা নিতে আপনার নিজস্ব প্রোফাইলে আলাদাভাবে একটি ডেটিং প্রোফাইল বানাতে হবে। যা থাকবে সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত এবং নিরাপদ। তবে ফেসবুকের এই ডেটিং প্রোফাইল নতুন সংযোজন হলেও টিনডার (Tinder) এবং বামবলের (Bumble) মতো জনপ্রিয় কিছু চ্যাটিং অ্যাপ ফেসবুক লগইনের মাধ্যমে এই চ্যাটিং সুবিধা দিয়ে আসছিল।
শক্তিশালী ক্ষমতায় ওকুলাস গো
ওকুলাস গো (OCULUS GO) মূলত ভিআর তথা ভার্চুয়াল রিয়ালিটি সম্বলিত ফেসবুক হার্ডওয়্যার। ভার্চুয়াল রিয়ালিটি কম্পিউটার প্রযুক্তির এমন এক আবিষ্কার যার মাধ্যমে আপনি কৃত্রিম পরিবেশ দেখার সুযোগ পাবেন। ওকুলাস গো’তে শক্তিশালী লেন্সের সাথে থাকছে প্রায় ১,০০০ অ্যাপস ব্যবহারের সুযোগ। এছাড়াও ওকুলাস টিভি, রুম, ভেন্যু অ্যাপসের মাধ্যমে মুভি থেকে শুরু করে বিভিন্ন গেম সহ নানা ধরনের আর্টিফিশিয়াল বিনোদনের সুযোগ তো থাকছেই। মজার বিষয় এর সাহায্য এবার লাইফ ইভেন্ট দেখার সুযোগ পাচ্ছেন ব্যবহারকারীরা।
তবে মার্ক জাকারবার্গ এফ ৮ এ উপস্থিত সকলকেই একটি করে ওকুলাস গো ফ্রি দিলেও এটি পেতে আপনাকে খরচ করতে হবে ৩২ জিপি ১৯৯ ডলার এবং ৬৪ জিপি ২৪৯ ডলার।
নতুন সংস্করণে মেসেঞ্জার
ফেসবুক কর্তৃ্পক্ষ মেসেঞ্জারে নিয়ে আসছে ব্যাপক পরিবর্তন। এ বিষয়ে মেসেঞ্জারের ভাইস প্রেসিডেন্ট ডেভিড মার্কাস (David Marcus) বলেন, প্রায় ২ হাজার ডেভেলপার নিয়ে গঠিত নতুন এই অ্যাপটিতে থাকছে কুইক অ্যাকশন তথা আরও দ্রুত গতির মেসেজ আদান প্রদান, ভিডিও কল, ভয়েস কলের সুযোগ। ব্যবসাক্ষেত্রে মেসেঞ্জারকে আরও উন্নত করার জন্য কাস্টমার চ্যাট প্লাগইনকে করা হয়েছে আরও উন্নত। যাকে সংক্ষেপে চ্যাটবট নামে আমরা সবাই চিনি।
প্রথম বারের মতো মেসেঞ্জারে যুক্ত হচ্ছে এম (M) ট্রান্সলেশন। যা আপনাকে যেকোনো ভাষাভাষী মানুষের সাথে স্বাচ্ছন্দে কথোপকথনে সাহায্য করবে। এছাড়াও স্মুথ ব্যবহারের পাশাপাশি, স্নাপচ্যাটের মত নানা ধরনের ফেস ফিল্টার সহ ডার্ক মুড অপশন যুক্ত হচ্ছে নতুন সংযোজনে। মজার বিষয় মেসেঞ্জারের ইউজার ইন্টারফেস তথা পুরো ডিজাইনে আনা হয়েছে আমূল পরবর্তন, যা মেসেঞ্জার ব্যবহারকরীদের দিবে নতুন এক অনুভূতি।
পরিপূর্ণতায় ইনস্টাগ্রাম
প্রায় সব পণ্যের পরিবর্তনের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আপডেট এসেছে ইনস্টাগ্রামে। রিয়েল টাইম ভিডিও কল, অগমেন্ট রিয়ালিটির ফেস ফিল্টার সহ প্রথমবারের মতো থার্ড পার্টি কিছু অ্যাপস ইন্টিগ্রেট করার ফলে ইনস্টাগ্রাম ব্যবহারকারীরা পাচ্ছেন বাড়তি কিছু সুবিধা। ফলে নিদির্ষ্ট কিছু অ্যাপস যেমন গো-প্রো (GoPro), Spotify এর মাধ্যমে খুব সহজেই আপনার অনুভূতি গুলো তাৎক্ষণিক শেয়ার করতে পারবেন ইনস্টাগ্রামে।
প্রতিদিন প্রায় ১০০ মিলিয়ন ব্যবহারকারীরা এবার পাচ্ছেন নতুন গ্রুপ ভিডিও কলিং ফিচার। মজার বিষয় এটি মিনিমাইজ করার সুযোগও থাকছে। ফলে আপনি ভিডিও কলের পাশাপাশি আপনার নিউজ ফিডের ব্যক্তিগত কাজগুলোও করতে পারবেন সহজেই। এসব অসাধারণ বৈশিষ্ট্যের জন্যই হয়তো কর্তৃপক্ষ বলছেন, ইনস্টাগ্রাম এখন সকল ক্ষমতায় পরিপূর্ণ এক সোশ্যাল মিডিয়া।
ব্যাপক নিরাপত্তায় হোয়াটসঅ্যাপ
নিরাপত্তার বিষয়টি বিবেচনা করলে মনে হবে সত্যিই নতুন করে এর প্রেমে পড়ার মতো ব্যাপার। যখন হোয়াটসঅ্যাপের ডিরেক্টর মুবারিক ইমাম (Mubarik Imam) বলছিলেন, এটি এতটাই নিরাপদ যে, কোনো ডাটা সার্ভার তো জমা রাখেই না বরং এন্ড টু এন্ড (End-to-End) এনক্রিপশন প্রাইভেসি মেনে চলে। সহজ করে বললে এটি এমন এক নিরাপত্তা ব্যবস্থা যার মাধ্যমে কোনো নির্দিষ্ট ব্যক্তিকে পাঠানো টেক্টটি সম্পর্কে তৃতীয় কোনো মাধ্যম যেমন হ্যাকার এমনকি হোয়াটসঅ্যাপ কর্তৃপক্ষও বুঝতে পারে না।
এজন্যই প্রায় ৪৫০ মিলিয়ন ব্যবহারকারী তাদের স্টোরি শেয়ার করার পাশাপাশি প্রতিদিন প্রায় ৬৫ বিলিয়ন মেসেজ আদান প্রদান করে হোয়াটসঅ্যাপে। এছাড়াও ভিডিও এবং ভয়েস কলে ব্যবহারকারীরা প্রতিদিন প্রায় ২ বিলিয়ন মিনিট সময় কাটায় এই অ্যাপে। এবছর নতুন আপডেট হিসাবে থাকছে গ্রুপ ভিডিও কল এবং মেসেজিংয়ের সময় স্টিকার ব্যবহারের সুযোগ।এসব কিছুর ধারাবাহিকতায় কর্তৃপক্ষ সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে হোয়াটসঅ্যাপ বিজনেস অ্যাপে। কারণ ইতিমধ্যে এর ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রায় ৩ মিলিয়ন।
ফেসবুককে আমরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম হিসাবে জানলেও পৃথিবীর অন্যতম সেরা ডিজিটাল মার্কেটপ্লেস ফেসবুকের দখলে। এজন্য মার্ক জাকারবার্গ ৭২.৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের আর্থিক সম্পদ নিয়ে পৃথিবীর শীর্ষ ধনীদের তালিকায় অবস্থান করছেন। লক্ষ্য করুন, ক্যামব্রিজ অ্যানালিটিকার মতো অপরাধের পরও ফেসবুক এগিয়ে যাচ্ছে নিজস্ব গতিতে। তবে এই সম্মেলনে ডাটা প্রাইভেসির তথা নিরাপত্তার বিষয়ে অনেক গুরুত্ব দিয়েছে ফেসবুক কতৃপক্ষ। যেমন ভুয়া তথা ফেইক খবর ছড়ানো ঠেকাতে খুবেই কঠোর হচ্ছে ফেসবুক। এমনকি জনপ্রিয় পেজ যাঁরা পরিচালনা করেন তাদরে পরিচয় সনাক্ত করতে অভিনব এক পদ্ধতি নিয়ে আসছে ফেসবুক কতৃপক্ষ। এছাড়ও প্রায় ৮৩ মিলিয়ন ফেইক প্রোফাইলের উপর অ্যাকশন নেওয়া হবে বলে জানান ফেসবুকের প্রধান নির্বাহী মার্ক জাকারবার্গ। তিনি আরও বলেন বড় পেজগুলো পরীক্ষ করা হবে যেসব পেজের মালিক পেজ সম্পর্কে সঠিক তথ্য দিবেন না তাঁদের পেজে কোন রকমের পোস্ট করতে দেওয়া হবে না। অনলাইনে সব ধরনের রাজনৈতিক বিজ্ঞাপন প্রচারের ক্ষেত্রে ‘অনেস্ট অ্যাডস অ্যাক্ট’ নীতিমালা সমর্থন করার কথা বলেন জাকারবার্গ। তিনি আরও বলেন এই নীতিমালা বিজ্ঞাপনের ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করলেও সবকিছু নিয়ন্ত্রনে আসতে সময় লাগবে বেশ কয়েকদিন এবং এই নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রন করবে আলাদা একটি টিম। যাঁরা সবসময় কাজ করবে নিরাপত্তা নিয়ে।
এসব কিছুর পরেও একটি প্রশ্ন থেকেই যায় ফেসবুক তথা নানাবিধ প্রযুক্তির এই পরিবর্তন আমাদের কাছে কতটা নিরাপদ? তাই বলবো, প্রযুক্তির এই উন্নতিতে নিজেকে না ভাসিয়ে এখনই সময় নিজের উপর নিজের নিয়ন্ত্রণ রাখার। আর তাই প্রয়োজন সঠিক প্রযুক্তিগত জ্ঞান।