মাস্টার্সের শেষ পর্যায়ে এসে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা যে বিষয় নিয়ে সবচেয়ে বেশি ভাবনায় পড়ে, তা হলো থিসিস পেপার তৈরি করা। এছাড়াও পিএইচডি করার সময়ও থিসিস করতে হয়, তবে পিএইচডির থিসিসের ক্ষেত্র মাস্টার্সের থিসিসের তুলনায় আরো অনেক বেশি বিস্তৃত।
থিসিস পেপার তৈরি করা নিঃসন্দেহে একটি চ্যলেঞ্জিং কাজ। থিসিসের মতো বড় স্কেলের প্রজেক্ট শেষ করতে প্রয়োজন পর্যাপ্ত সময়, ধৈর্য, প্রচুর পড়াশোনা এবং পরিশ্রম। তবে ভয় পাবার কোনো কারণ নেই। সঠিক সময় কাজ শুরু করলে, সব কিছু সুসংগঠিত করে রাখলে, রিসার্চের টপিক নিয়ে পড়াশোনা করলে ও প্রয়োজনীয় ও গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট নোট করে রাখলে, আপনি নির্ধারিত সময়ের মধ্যে আপনার থিসিসের কাজ শেষ করতে পারবেন।
আজকের নিবন্ধে আমরা আলোচনা করব, থিসিস পেপার তৈরি করার সময় কোন কোন বিষয়ের দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। চলুন জেনে নিই, সে বিষয়গুলো কী কী।
১. থিসিসের ক্ষেত্র নির্ধারণ
থিসিস পেপার শুরু করার আগে জানতে হবে কোন ক্ষেত্রের উপরে আপনি গবেষণা করবেন। এক্ষেত্রে সুপারভাইজারের সহযোগিতা নিয়ে পারেন অথবা নিজের আগ্রহের ক্ষেত্রকে থিসিসের জন্য বেছে নিতে।
২. সঠিক টপিক বাছাই করা
বিষয় বা ক্ষেত্র ঠিক করার পরের কাজ হলো টপিক নির্ধারণ করা। থিসিসের টপিক খুঁজে বের করা বেশ কঠিন একটা কাজ। বেশ কিছুদিন সময় নিয়ে ঘাটাঘাটি করে টপিক ঠিক করতে হয়।
টপিক নির্ধারণের ক্ষেত্রে প্রথম কাজ হচ্ছে থিসিসের ক্ষেত্র নিয়ে ভালো ধারণা নেওয়া। এই ক্ষেত্রে ইন্টারনেটের সহযোগিতা নিতে পারেন। ভালো করে ইন্টারনেট, বই, রিসার্চ পেপার ঘেঁটে তারপর টপিক নির্ধারণ করা উচিৎ।
৩. একাডেমিক রাইটিং দক্ষতা অর্জন করা
সুন্দর, সংক্ষিপ্ত আকারে, সুসংগঠিতভাবে প্রমাণিত তথ্য প্রকাশ করাকে একাডেমিক রাইটিং বলা হয়। বিভিন্ন রিপোর্ট, রিসার্চ পেপার করার জন্য একাডেমিক রাইটিং পারদর্শী হতে হয়।
বাংলাদেশের অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে একাডেমিক রাইটিংয়ের উপর খুব একটা কোর্স করানো হয় না। তাই একাডেমিক রাইটিংয়ের বেশিরভাগ নিয়মকানুন আমাদের অজানা।
এক্ষেত্রে ইউটিউব হতে পারে সবচেয়ে ভালো মাধ্যম, এখানে সার্চ দিলেই একাডেমিক রাইটিং সম্পর্কিত অনেক ভিডিও আপনি পাবেন। এসব ভিডিও দেখে আপনি একাডেমিক রাইটিং দক্ষতা অর্জন করতে পারেন।
এছাড়াও Coursera কিংবা Udemy মতো বিভিন্ন অনলাইন সাইটগুলোতে একাডেমিক রাইটিংয়ের উপর অনেক কোর্স রয়েছে। আপনি চাইলেই আপনার পছন্দের সাইট থেকে নিজের ইচ্ছা অনুযায়ী এ সম্পর্কিত যেকোনো কোর্স করে নিতে পারেন।
৪. পর্যাপ্ত সময় হাতে নিয়ে কাজ শুরু করা
থিসিস তৈরি করা বেশ সময়সাপেক্ষ কাজ। আপনি যদি মনে করেন হঠাৎ কোনো প্রস্তুতি ছাড়া কাজ শুরু করে ২-৩ মাসের মধ্যে মানসম্পন্ন থিসিস তৈরি করতে পারবেন, তাহলে ভুল ভাবছেন।
কারণ প্রচুর পরিশ্রম, অনেক পড়াশোনা, মনোযোগ সহকারে গবেষণা করে থিসিস পেপার তৈরি করতে হয়। আপনার ছোট একটি ভুলের কারণে আপনার থিসিসের মান খারাপ হতে পারে, এমনকি আপনার থিসিস পেপার প্রত্যাখাতও হতে পারে। তাই পর্যাপ্ত সময় হাতে নিয়ে থিসিসের কাজ শুরু করুন।
৫. থিসিসের টপিক নিয়ে প্রচুর পড়াশোনা করুন
ভালো থিসিস করার প্রধান শর্ত হলো আপনি যে টপিক নিয়ে কাজ করবেন সে সংক্রান্ত প্রচুর আর্টিকেল, রিপোর্ট, জার্নাল ইত্যাদি পড়া। কমপক্ষে তিন মাস আপনার সংশ্লিষ্ট টপিক নিয়ে পড়াশোনা করা উচিৎ।
এভাবে থিসিস সম্পর্কে আপনি অনেক কিছুই জানতে ও শিখতে পারবেন এবং সেইসাথে থিসিস পেপারে কোন কোন পয়েন্ট যুক্ত করতে হবে ও বাদ দিতে হবে, কোন ফরম্যাটে লিখলে ভালো হবে, গবেষণার জন্য কোন কোন পদ্ধতি অবলম্বন করতে পারেন এসব সম্পর্কে ধারণা হবে।
শুধু রিসার্চ পেপার পড়লেই হবে না, রিসার্চ পেপার সাথে যে সকল রেফারেন্স দেওয়া থাকে সেগুলোও খুঁজে বের করে পড়তে হবে।
প্রথম দিকে হয়তো আপনি রিসার্চ পেপারের সব বিষয় বুঝতে পারবেন না, কিন্তু তিন মাসে অন্তত আপনি এটুকু বুঝতে পারবেন যে কোন বিষয়গুলো পরবর্তীতে আপনাকে থিসিস লিখতে সাহায্য করবে।
৬. সুপারভাইজারের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখা
থিসিসের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, নিয়মিত সুপারভাইজারের সাথে যোগাযোগ রাখা। আপনার কাজের মান কী রকম হচ্ছে, সব ঠিক আছে কিনা, কোন ভুলত্রুটি রয়েছে কিনা এসব বিষয় নিয়ে আপনার সুপারভাইজারের সাথে নিয়মিত আলোচনা করতে হবে।
এটা যেমন মার্ক পেতে সহায়তা করবে, সেই সাথে ভবিষ্যতে ভালো সুপারিশের জন্যেও কাজে লাগবে। এছাড়াও থিসিস পেপারে ভুল হওয়ার সম্ভাবনাও অনেক কম থাকবে।
৭. অ্যাবস্ট্রাক্ট ও রেফারেন্সে বিশেষ গুরুত্ব দিন
থিসিস পেপারের প্রথম অংশ হচ্ছে অ্যাবস্ট্রাক্ট এবং সর্বশেষ অংশ কনক্লুশনের পর রেফারেন্স সেকশন উল্লেখ করা হয়। অনেক শিক্ষার্থী এ দু’টো অংশকে কম গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন। কিন্তু থিসিসের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দু’টো অংশ হচ্ছে অ্যাবস্ট্রাক্ট ও রেফারেন্স।
পুরো থিসিসের মূল সারমর্ম তুলে ধরা হয় অ্যাবস্ট্রাক্টে। একজন পাঠক সবার আগে থিসিসের এই অংশে চোখ বোলাবে। তাই এটিকে এমনভাবে উপস্থাপন করতে হবে যাতে করে পাঠকের মনে আপনার থিসিস নিয়ে কৌতূহল জাগে।
যে সকল সূত্র থেকে আপনি গবেষণার জন্য তথ্য সংগ্রহ করেছেন, যেমন-0 বই, অন্যান্য রিসার্চ পেপার, রিপোর্ট, ওয়েবসাইট ইত্যাদি ক্রমানুসারে বিস্তারিত রেফারেন্সে উল্লেখ করতে হবে।
যাতে পাঠকরা চাইলেই তাদের প্রয়োজন অনুযায়ী যেকোনো তথ্য সেসব সূত্র থেকে খুঁজে বের করতে পারেন। রেফারেন্সের সঠিক উপস্থাপন আপনার থিসিস পেপারকে আরো আস্থাভাজন ও মানসম্মত করে তুলবে।
তাই আপনি যদি চান পাঠক আপনার গবেষণাটি সম্পর্কে জানুক, তাহলে এ দুটি অংশের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দিন।
৮. থিসিসের মূল উদ্দেশ্য মনে রাখুন
যারা থিসিসের কাজ করছেন, তারা সবাই কম বেশি চাপের মধ্যে থাকেন। এটি একটি স্বাভাবিক ব্যাপার। তবে আপনি যদি বেশি চাপ অনুভব করেন এবং কাজ করার উৎসাহ হারিয়ে ফেলেন তাহলে থিসিস করার পিছনে মূল উদ্দেশ্যকে মনে করুন।
থিসিসের করলে আপনি কীভাবে লাভবান হবেন, ভবিষ্যতে কী ধরণের সুযোগ সুবিধা পাবেন, নতুন কী কী শিখতে পারবেন, কীভাবে জ্ঞানের বিকাশ ও গবেষণা করার দক্ষতা অর্জন করতে পারবেন এবং উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে থিসিস পেপারের ভূমিকার কথা সবসময় মনে রাখুন।
তাহলে আপনি আপনার কাজে আরো বেশি মনোযোগী হতে পারবেন ও একটি মানসম্মত থিসিস পেপার তৈরি করতে পারবেন।
Featured Image: helixbinders.co.uk