চা পান করার অভ্যাস বাঙালীর বহু পুরনো। আন্দোলন করে ইংরেজদের তাড়ালেও তাদের চা পান করার অভ্যাসটা ঠিকই রপ্ত করে নিয়েছি আমরা। এখন চা পান করে না এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া কঠিন। যার বাড়িতে চায়ের আয়োজন হয় না সেও মোড়ের দোকান থেকে সেরে নেয় এই নিত্যদিনের পানীয় পানের কাজটি। তবে আমি পরামর্শ দিব চা যখন খাবেনই তখন গ্রিন টি বা সবুজ চা খান।
গ্রিন টি অন্যান্য সাধারণ পানীয়ের মতো নয়, এর রয়েছে অনন্য স্বাস্থ্যগত গুণাগুণ। যেমন গ্রিন টিতে আছে প্রচুর পরিমাণে এ্যান্টি অক্সিডেন্ট ও নিউট্রিয়েন্ট যা স্বাস্থ্যগতভাবে অনেক তাৎপর্যপূর্ণ। চলুন জেনে নিই জনপ্রিয় এই পানীয় গ্রিন টির আরও কিছু স্বাস্থ্যগত গুণাগুণ, যা আপনাকে নিত্যদিনের পানীয় হিসেবে গ্রিন টি খেতে উৎসাহিত করবে।
ক্যালরি কমানোর হাতিয়ার
কাজ করার প্রধান নিয়ামক ক্যালরি বা শক্তি। মানব শরীরে ক্যালরির তারতম্যের উপর নির্ভর করে ব্যক্তির কর্মক্ষমতা। কিন্তু স্বাস্থ্যকর খাবার খেয়ে খেয়ে যদি শুধু শরীরে ক্যালরি জমানো হয়, খরচ না করা হয়, তবে নানান শারিরীক জটিলতা দেখা দেয়। তাই সারাদিন যারা আরাম আয়েশে দিন কাটায় তাদেরও সুস্থ্য থাকতে ব্যায়াম করে শরীরের অতিরিক্ত ক্যালরি ক্ষয় করতে হয়।
গ্রিন টি এই অতিরিক্ত ক্যালরি ক্ষয় করার দায়িত্ব নেয়। ফলে মানব শরীরের বিপাক ক্রিয়া বৃদ্ধি পায়। ১০ জন ব্যক্তির ওপর পরিচালিত এক পরীক্ষায় দেখা গেছে, গ্রিন টি পান করার কারণে তাদের ক্যালরি খরচ ৪ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।
শারীরিক সুস্থতায়
মানব শরীরে নানা কারণে বিভিন্ন অঙ্গের কোষ নষ্ট হয়ে যায়। গ্রিন টিতে আছে শক্তিশালী এ্যান্টিঅক্সিডেন্ট পলিফিনল ও ক্যাটেকিন। এই এ্যান্টিঅক্সিডেন্ট দেহের কোষ নষ্ট হওয়া থেকে রক্ষা করে। এছাড়া আমাদের শরীরে বিভিন্ন রোগ সৃষ্টিকারী ক্ষতিকর র্যাডিকেল সৃষ্টিতেও বাধা দেয় গ্রিন টি। অনেক চিকিৎসা বিজ্ঞানীর ধারণা, গ্রিন টিতে বিদ্যমান এপিগ্যালোক্যাটেকিন গ্যালেট (EGCG) এ্যান্টিঅক্সিডেন্ট বিভিন্ন প্রকার রোগ নিরাময় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
মস্তিষ্কের সুস্থতায়
কফিতে থাকা ক্যাফেইনের গুরুত্বের কথা আমরা সবাই জানি। ক্যাফেইন মানুষের মস্তিষ্কের কোষ সতেজ ও সক্রিয় রাখতে খুবই কার্যকারী। গ্রিন টিতে অল্প পরিমাণ ক্যাফেইন থাকে, যা এক প্রকার উদ্দীপক হিসেবে কাজ করে। তাই মস্তিষ্কের কার্যকলাপ স্বাভাবিক ও মন প্রফুল্ল রাখতে গ্রিন টির জুড়ি নেই। অধিক কাজের চাপ সামাল দিয়ে মন উৎফুল্ল রাখতে, স্মৃতিশক্তি ও মস্তিষ্কের কর্মক্ষমতা বৃদ্ধিতে নিয়মিত গ্রিন টি পান অধিক উপকারী।
ক্যান্সার-ঝুঁকি কমাতে
বর্তমান পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি মানুষের মৃত্যু হচ্ছে ক্যান্স্যারে আক্রান্ত হয়ে। কোন কোন দেশে ক্যান্সার মানুষের মৃত্যুর প্রধান কারণ। মানব দেহের অনিয়ন্ত্রিত কোষ বৃদ্ধির ফলে এই ক্যান্স্যার হয়। গ্রিন টি এই ক্যান্সার ঝুঁকি কমায় উল্লেখযোগ্যভাবে।
স্তন ক্যান্সার ঝুঁকি নিয়ে পরিচালিত এক গবেষণা মতে, নিয়মিত গ্রিন টি পান করা নারীর স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা সাধারণ নারীর তুলনায় ২২ শতাংশ কমে যায়। চীনে প্রায় ৭০ হাজার নারীর ওপর চালানো অপর এক সমীক্ষা মতে, নিয়মিত গ্রিন টি পান করা নারীদের কোলোরেক্টাল ক্যান্সারের ঝুঁকি ৫৭ শতাংশ কম থাকে। এছাড়া নিয়মিত গ্রিন টি পান প্রস্টেট ক্যান্সারের ঝুঁকি প্রায় ৫০ শতাংশ কমিয়ে দেয়।
ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া দমন
গ্রিন টিতে বিদ্যমান ক্যাটেকিন ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস দমন করে। মানুষের মুখের দুর্গন্ধ সৃষ্টিকারী ব্যাকটেরিয়াসহ বিভিন্ন রোগ সৃষ্টিকারী ব্যাকটেরিয়া ধ্বংস করে গ্রিন টি। স্ট্রেপ্টোকক্কাস মিউট্যান্স ব্যাকটেরিয়া মানুষের মুখে প্ল্যাক তৈরি করে, যা ধীরে ধীরে দাঁত ক্ষয় করে। নিয়মিত গ্রিন টি পান স্ট্রেপ্টোকক্কাস মিউট্যান্স ব্যাকটেরিয়া বৃদ্ধি রোধ করে দাঁত সুস্থ্ রাখতে সহায়তা করে।
ডায়াবেটিসের ঝুঁকি কমায়
ডায়াবেটিস আর একটি বড় ঝুঁকির নাম। দেশে ডায়াবেটিস আক্রান্তের সংখ্যা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। নিয়মিত গ্রিন টি পান ইন্সুলিন সেন্সিটিভিটি নিয়ন্ত্রণে আনে, যা ব্লাড সুগারের মাত্রা কমিয়ে নিয়ন্ত্রণে রাখতে সহায়তা করে।
সবল হৃদপিন্ড
রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রার উপর হৃদপিণ্ডের সুস্থতা অনেকাংশে নির্ভর করে। তাছাড়া কার্ডিওভ্যাস্কুল্যার রোগ হৃদপিণ্ডের বিভিন্ন অসুখ ও স্ট্রোক সৃষ্টি করে। গ্রিন টি রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা কমায়, যা নানান রকম হার্টের অসুখ ও স্ট্রোকের ঝুঁকি অনেকাংশে কমিয়ে দেয়।
মেদ কমানোর দাওয়াই
শরীরের অতিরিক্ত মেদ নিয়ে অনেকে চিন্তিত। নিয়মিত ব্যায়ামের পাশাপাশি আপনার মেদ কমানোর মোক্ষম দাওয়াই গ্রিন টি। গ্রিন টি খুব অল্প সময়ের মধ্যে বিপাক হার বাড়াতে সক্ষম। কাজেই এটি দেহের অতিরিক্ত মেদ কমাতেও সহায়ক। বিশেষ করে পেটের মেদ কমাতে গ্রিন টি অতুলনীয় ভূমিকা রাখতে সক্ষম।
অ্যালঝেইমার দূর করতে
গ্রিন টিতে বিদ্যামান ক্যাটেকিন স্নায়ুকোষ সুরক্ষিত রাখতে সহায়তা করে। যার ফলে বার্ধক্যজনিত কারণে সৃষ্ট অ্যালঝেইমার ও পারকিনন্স রোগ থেকে রক্ষা করে গ্রিন টি।
মৃত্যু ঝুঁকি হ্রাস
পৃথিবীতে কেউই অমর নয়। সবাইকে একদিন মরতে হবে। তাই গ্রিন টি কাউকে অমরত্ব দিতে পারে না, কিন্তু আরও কিছু দিন বেশি বেঁচে থাকার সম্ভাবনা দিতে পারে। আগেই বলেছি নিয়মিত গ্রিন টি পান যেহেতু হৃৎপিন্ড সুস্থ্ ও সবল রাখতে সহায়তা করে, মেদ কমিয়ে সুঠাম রাখে, মস্তিষ্ক সতেজ রাখে, তাই সব মিলিয়ে মানুষের সার্বিক সুস্থতা বাড়িয়ে দেয়, যা মানুষকে দীর্ঘজীবী করে তোলে।
জাপানিরা গড়ে দিনে ৫ কাপ গ্রিন টি পান করে। ফলে তাদের হৃদপিণ্ডের রোগ ও স্ট্রোকে মারা যাওয়ার সংখ্যা অন্য দেশের তুলনায় খুবই কম। জাপানি নারীদের অন্য দেশের নারীদের তুলনায় স্ট্রোকের ঝুঁকি ৪২ শতাংশ কম ও পুরুষের অন্য দেশের পুরুষের তুলনায় ৩৫ শতাংশ কম। এতক্ষণে নিশ্চয় বুঝেছেন গ্রিন টি আমাদের স্বুস্থ্যতার জন্য কতটা দরকারী। সুতরাং আজ থেকে আর সাধারণ চা নয়, পান করুন নিয়মিত গ্রিন টি বা সবুজ চা।