আপনি একজন তরুণ উদ্যোক্তা, বেশ কিছু দিন হলো একটি স্টার্টআপ ব্যবসা করছেন। অথবা আপনি একজন নবীন কন্ঠশিল্পী। একের পর এক গান গেয়ে কন্ঠশিল্পী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করছেন। অথবা আপনি একজন নবীন লেখক, দৈনিক পত্রিকায় নিয়মিত লেখালিখি করছেন কিংবা সামজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লিখছেন বা দু-একটি সৃজনশীল প্রবন্ধ প্রকাশ করে নিজেকে লেখক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করছেন। অথবা জগতের আর সব কাজ ছেড়ে একজন ক্রিকেটার হওয়ার জন্য দিন রাত পরিশ্রম করে নিজেকে গড়ে তুলছেন।
ব্যবসায়ী, শিল্পী, লেখক বা ক্রিকেটার, আপনার স্বপ্ন যা-ই হোক না কেন, চেষ্টা করে চলেছেন নিরন্তর। এই নিরন্তর প্রচেষ্টায় কখনো কখনো অবসাদ নেমে আসে, একঘেয়ে লাগে সব চেষ্টা। মনে হয় সব ছেড়ে পালিয়ে যায় দূরে কোথাও।
আপনি যদি নিজের স্বপ্ন পূরণ করতে এমন নিরন্তর চেষ্টা করতে করতে হাঁপিয়ে উঠেন, তবে এখনই একবার দেখে নেওয়া উচিত এত প্রচেষ্টায় আদৌ আপনার কোনো উন্নতি হচ্ছে কিনা? দেখবেন নিজের উন্নতি হচ্ছে কিনা বা তার ধারাবাহিকতা কেমন তা বোঝার পর অবসাদ, একঘেয়েমি চলে যাবে। কাজে পূর্ণ উদ্যম ফিরে পাবেন।
কিন্তু কীভাবে উন্নতি পরিমাপ করা যায়? সেজন্য কয়েকটি সূচক বিবেচনা করে নিজের অবস্থান বিশ্লেষণ করা যায়। যেমন-
১. আয়
যেকোনো ব্যবসায় আদৌ কোনো উন্নতি হচ্ছে কিনা তা পরিমাপের প্রথম এবং প্রাথমিক ধাপ হল আয়। হতে পারে এখনও আপনার ব্যবসায় আয় ব্যয়ের সমতা আসেনি। এতে ঘাবড়ানোর কিছু নেই। প্রাথমিক অবস্থায় ব্যয়ের তুলনায় আয় কম হবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু লক্ষণীয় বিষয় হলো, আদৌ কোনো আয় হচ্ছে কিনা। যদি আয় হয় তবে প্রাথমিক ভাবে ধরে নেওয়া যায়, ব্যবসায় উন্নতি হচ্ছে। আর যদি ব্যবসার ধরণ বুঝে মাসের পর মাস বিনিয়োগ করে যাচ্ছেন অথচ কোনো আয় হচ্ছে না তাহলে আপনার ব্যবসার পদ্ধতি নিয়ে এখনই ভাবা উচিত। উন্নতি করতে হলে ব্যবসায় অভিনবত্ব আনা প্রয়োজন।
শুধু মাত্র ব্যবসায় না, ধরণ বুঝে অন্যান্য সৃজনশীল কাজের ক্ষেত্রেও এই নীতি প্রযোজ্য। কেননা সৃজনশীল কাজের ক্ষেত্রেও সারা দিন যা-ই করি না কেন, দিন শেষে অর্থই মূল কথা। সুতরাং আপনার সৃজনশীল কাজের উন্নতি হচ্ছে কিনা তা বুঝতে হলে দেখতে হবে শুধু মুখে মুখে প্রশংসা নয়, মানুষ আপনার সৃজন কর্ম উপভোগ করতে অর্থ ব্যয় করার মানসিকতা পোষণ করে কিনা।
২. আয়ের ধারাবাহিকতা
উন্নতি পরিমাপের দ্বিতীয়, তবে প্রধান ধাপ হচ্ছে ধারাবাহিকতা। আসলে ধারাবাহিকতার অন্য অর্থই উন্নতি অর্থাৎ পূর্বের অবস্থা থেকে ক্রমশ সমৃদ্ধির দিকে আপনি হাঁটছেন কিনা তার পরিসংখ্যানই উন্নতির প্রধান সূচক।
ধরুন, আপনার এক বন্ধুর একটি প্রতিষ্ঠিত ব্যবসা প্রতিষ্ঠান আছে। সেই তুলনায় আপনার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খুবই ছোট। আপনার বন্ধু তার ব্যবসা থেকে গত বছর নিট লাভ করেছিল ১০০ কোটি টাকা, যা এ বছর দাঁড়িয়েছে ৯০ কোটি টাকায়। আর আপনি গত বছর সব খরচ করার পর নিট লাভ করেছিলেন এক লক্ষ টাকা যা এ বছর এক লক্ষ ১০ হাজার টাকায় এসে দাঁড়িয়েছে। আপনার বন্ধু এবছর ১০ কোটি টাকা কম লাভ করেছে যা হয়তো আপনার গোটা ব্যবসার মূলধন বা সম্পদের মূল্যের চেয়েও অনেক বেশি। তা সত্ত্বেও আপনার বন্ধুর কোনো উন্নতি হয়নি বরং তিনি ১০ শতাংশ পিছিয়ে গেছেন। কিন্তু আপনি পূর্বের চেয়ে ১০ শতাংশ উন্নতি করেছেন।
উন্নতি সর্বদা পরিমাণের উপর নির্ভর করে না, নির্ভর করে ধারাবাহিতকার উপরও। সুতরাং ব্যবসায় ধারাবাহিকতা রক্ষা করাই উন্নতি। সব কাজে প্রতি মুহূর্তে নিজের প্রতিবন্ধকতাকে ছাড়িয়ে যাওয়াই উন্নতি। সুতরাং ব্যবসা বা সৃজনশীল কাজ যা-ই হোক না কেন, চেষ্টা করুন সবসময় নিজের প্রতিবন্ধকতাকে অতিক্রম করার, তবেই হবে কাঙ্ক্ষিত উন্নতি।
৩. ভাইরাল
আমি অত্যন্ত সচেতন ভাবেই এই ট্রেন্ডিং শব্দটি ব্যবহার করছি। ব্যবসা বা সৃজনশীল যে কাজই হোক না কেন হঠাৎ করে ভাইরাল হয়ে ওঠার প্রবণতা কাজের বিশুদ্ধ ও ধারাবাহিকতা নষ্ট করে। হঠাৎ করে ভাইরাল হয়ে উঠলে আপনার কাজ বা সেবা নিয়ে মানুষের মধ্যে সাময়িক একটা উন্মদনা সৃষ্টি হয় বৈকি, কিন্তু সেই উন্মাদনা স্থায়ী হয় না। সময়ের সাথে সাথে কালের গর্ভে হারিয়ে যায় সেই ভাইরালিটি।
কোন ব্যবসায়ী যদি হঠাৎ করে অধিক উন্নতি করতে যান, তখন তিনি অসৎ পন্থা অবলম্বন করেন, অপরাধপ্রবণ হয়ে ওঠেন, যা সাময়িকভাবে কাজ করলেও একসময় সম্পূর্ণ ব্যবসাকেই ধ্বংস করে দেয়।
আবার যদি কোনো সৃজনশীল ব্যক্তি সস্তা জনপ্রিয়তা বা অর্থ পেতে তার যথাযথ সৃজনশীলতা ছেড়ে কেবল হঠাৎ জনপ্রিয় হয়ে ওঠার খেলায় মেতে ওঠেন, তবে এই প্রবণতা তার সৃজনশীলতাকে ধ্বংস করে দেয়। সুতরাং, ভাইরাল নয়, বরং ধীরে হোক, তবুও উন্নতি হোক ধারাবাহিকতা বজায় থাক।
৪. প্রশংসা
পৃথিবীতে এমন কিছু প্রাপ্তি আছে যা টাকার অঙ্কে পরিমাপ করা যায় না। আবার চাইলেই অর্জন করা যায় না। আর এ ধরণের অর্জন অমূল্য। এমনই এক অমূল্য অর্জন হলো প্রশংসা।
আপনার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের পণ্য বা সেবা, অথবা আপনার সৃজন কাজ মানুষের কাছে প্রশংসিত হচ্ছে কিনা তা যাচাই করা উন্নতি পরিমাপের অন্যতম মোক্ষম হাতিয়ার। এর জন্য বিশেষ কোনো জরিপের প্রয়োজন নেই। ভোক্তার প্রতিক্রিয়া, প্রতিবেশীর সাথে আলাপ বা পথ চলতে চলতে মানুষের মতামত নিতে পারেন। এতে থেকে খুব সহজেই বুঝতে পারবেন। যদি আপনার পণ্য বা কাজ মানুষের কাছে প্রশংসিত হয়, তবে বুঝবেন আপনার উন্নতি হচ্ছে। না হলে আপনার প্রচেষ্টা নিয়ে নতুন পরিকল্পনা করা উচিত।
পরিশেষে বলবো, নিজের কাজ নিয়ে নিজের সার্বিক বোধই খুব সহজে আপনাকে বলে দেবে আপনার উন্নতি হচ্ছে কিনা। যদি নিজের কাছে ইতিবাচক সাড়া পান তবে জানবেন সাফল্য আসবেই। সুতরাং আত্মবিশ্বাস রাখুন আর এগিয়ে যান বীরদর্পে। মনে রাখবেন, ছোট ছোট বালুকণা, বিন্দু বিন্দু জল, গড়ে তোলে মহাদেশ সাগর অতল।