ব্যক্তি বা সামষ্টিক সাফল্যের জন্য উৎপাদনশীলতা সবার আগে বিবেচ্য বিষয়। কোনো কোনো দেশ এবং ব্যক্তি কাঙ্ক্ষিত উৎপাদনশীলতা অর্জন করতে পারেন না। আবার কেউ কেউ নিজেদের উৎপাদনশীলতা ধরে রাখতে পারেন না। যারা নিজেদের কর্মস্পৃহা এবং উৎপাদনশীলতা সব সময় ধরে রাখতে পারেন, তাদের সাথে সাধারণ মানুষের পার্থক্যটা কোথায়? উৎপাদনশীল দেশ এবং দেশের মানুষ কেন সবাইকে ছাড়িয়ে সাফল্যের শিখরে আরোহণ করে?
আসলে উৎপাদনশীল মানুষেরা সব সময় শেখার মধ্যে থাকেন। যখনই তারা নতুন বা উদ্ভাবনী কিছু দেখেন, তখনই তা রপ্ত করার চেষ্টা করেন। তারা জানার চেষ্টা করেন, অধিক উৎপাদনশীল নতুন কোনো ব্যবস্থা বা বিষয় কীভাবে কাজ করে। তারপর নিজেরাই তা অর্জন করার চেষ্টা করেন। এই কারণেই তারা ব্যর্থ রাষ্ট্র এবং ব্যক্তির তুলনায় অনেক গুণ এগিয়ে থাকেন।
আজকের নিবন্ধে উন্নত দেশ এবং সফল মানুষের উৎপাদনশীলতা ধরে রাখার কিছু কৌশল নিয়ে আলোচনা করব। আশা করি এই কৌশলগুলো প্রয়োগ করলে অল্প দিনের মধ্যেই আপনি ফল পেতে শুরু করবেন।
১. জীবন এবং কাজের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখার সংস্কৃতি
জীবন এবং কাজের ভারসাম্য বজায় রাখার সংস্কৃতি সবার মধ্যে থাকে না। আপনি যদি কাজ এবং জীবনের মধ্যে যথাযথ ভারসাম্য বজায় রাখতে পারেন, তবে সব সময় আপনি অনেক বেশি প্রাণবন্ত, প্রফুল্ল এবং সুস্থ বোধ করবেন। যা আপনার উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর অন্যতম পূর্বশর্ত।
জীবন অনিশ্চিত। নানা বিপর্যয় এবং অনিশ্চয়তা জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে এসে হাজির হয়। আপনি হঠাৎ করে চাকরি হারাতে পারেন, অর্থনৈতিক বা শারীরিক সক্ষমতা হারাতে পারেন, এমনকি আপনার ব্যক্তিগত ব্যবসা ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হতে পারে।
তাই আপনি যদি শুধু কাজ ছাড়া জীবনে আর কিছু ভাবতে না জানেন, তবে অচিরেই আপনি হতাশ হয়ে পড়বেন। জীবনের সঠিক অর্থ কখনোই উপলব্ধি করতে পারবেন না। এমন মানুষ কর্ম এবং ব্যক্তিজীবনের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখতে পারেন না। যার ফলে অঢেল অর্থ থাকা সত্ত্বেও ব্যক্তি জীবনের সুখ স্বাচ্ছন্দ্য হারিয়ে যায়, সম্পর্কগুলো ফিকে হয়ে যায় এবং ভবিষ্যতে এই অবস্থা কাটিয়ে ওঠা দুঃসাধ্য হয়ে পড়ে।
অর্থনৈতিক সাফল্য আর জীবনের সৌন্দর্য খুঁজে পাওয়া এক বিষয় নয়। তাই চাকরি, ব্যবসা বা কাজের বাইরে ব্যক্তি জীবনকে উপভোগ্য করে তুলতে হবে। পরিবারের সাথে ভালো সময় কাটানো, নিজের শখ পূরণ করা, পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে ভ্রমণ করাসহ জীবন স্বাচ্ছন্দ্যময় করে তোলার মতো অন্যান্য কাজে অংশ নিতে হবে। উন্নত দেশের মানুষ সব সময় ব্যক্তি এবং কর্মজীবনের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রেখে জীবনযাপন করেন। তাই জটিল এবং শ্রমসাধ্য কাজ করলেও তাদের জীবন কখনো দুর্বিষহ হয়ে ওঠে না। সুখ উপভোগ করার জন্য বাড়তি সময়েরও প্রয়োজন হয় না।
২. সংক্ষিপ্ত কর্মঘন্টা কিন্তু বেশি উৎপাদনশীলতা
অপেক্ষাকৃত সংক্ষিপ্ত কর্মঘন্টা কর্মীদের বেশি উৎপাদনশীল করে তোলে। যদিও কিছু কিছু দেশ এই নীতি মানতে চায় না। যেমন, জাপান ও মেক্সিকোতে দীর্ঘ সময় ধরে মানুষ কাজ করেন। ফলে অন্যান্য উন্নত দেশের তুলনায় তাদের উৎপাদনশীলতা কিছুটা হ্রাস পায়। এর বিপরীতে সুইডেনকে আদর্শ ধরা যেতে পারে। সুইডেনের মানুষ জীবন এবং কাজের ভারসাম্য বজায় রেখে জীবন যাপন করেন। যার ফলে তারা দিনভর অন্যদের তুলনায় বেশি উৎপাদনশীল থাকেন।
উৎপাদনশীলতা নিয়ে এক গবেষণায় নার্সিংহোমে কাজ করা এক নারীকে দৈনিক ৮ ঘন্টা কাজ করতে বলা হয়। এরপর দীর্ঘদিন ধরে তার কর্ম উদ্দীপনা এবং উৎপাদনশীলতা পর্যবেক্ষণ করা হয়। পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, অফিসের শেষ কর্মঘন্টাগুলোতে তিনি ক্লান্ত এবং অবসন্ন হয়ে পড়েন। এমনকি বাড়িতে ফিরে তার সন্তানকে সময় দিতে গিয়েও তিনি ক্লান্ত বোধ করেন। ফলে সন্তানের সাথে তার সম্পর্ক আনন্দের হয়ে ওঠে না।
পরবর্তীতে ওই নারীকে একই বেতনে দৈনিক ৬ ঘন্টা কাজের নিয়ম বেঁধে দেয়া হয়। এতে অল্প দিনেই গবেষকরা অবিশ্বাস্য ফল পান। কারণ কর্মক্ষেত্রে সম্পূর্ণ সময় জুড়ে তিনি প্রাণবন্ত এবং উৎপাদনশীল থাকেন। ফলে তার কাজের ক্ষেত্রে অল্প দিনের মধ্যেই ব্যাপক ইতিবাচক পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। এমনকি তিনি সন্তানকেও যথেষ্ট সময় দিতে পারেন এবং ব্যক্তিজীবনেও হাসিখুশি থাকেন।
সুতরাং বেশি সময় ধরে কাজ করলে অধিক লাভবান হওয়া যায় এই ধারণা ভুল। ভুলে গেলে চলবে না, কাজ জীবনের জন্য, জীবন কাজের জন্য নয়।
সংক্ষিপ্ত কর্মঘন্টার আরো অনেকগুলো সুবিধা রয়েছে। অল্প সময় কাজ করার কারণে কর্মীরা সব সময় অনেক বেশি প্রাণবন্ত থাকেন। ফলে অল্প সময়ে বেশি উৎপাদন সম্ভব হয়। আবার কর্মীরা যেহেতু যথেষ্ট বিরতি এবং বিশ্রাম নেওয়ার সুযোগ পান, তাই তাদের মস্তিষ্ক অনেক বেশি সৃজনশীল হয়ে থাকে। তাছাড়া কর্মীরা নিয়মিত কাজ করলেও পরিবার, আত্মীয়স্বজন এবং বন্ধুবান্ধবকে যথেষ্ট সময় দিতে পারেন। যার ফলে তাদের ব্যক্তিজীবনও আনন্দময় হয়ে ওঠে।
৩. বর্তমান কাজে মনোযোগ
যেসব মানুষ বর্তমান কাজে সম্পূর্ণ মনোযোগী থাকতে পারেন, তারাই সবচেয়ে বেশি উৎপাদনশীল হয়ে থাকেন।
উন্নত দেশে মানুষ কর্মক্ষেত্রে সম্পূর্ণ মনোযোগী থাকেন এবং সর্বক্ষণ কাজের মধ্যে জড়িয়ে থাকেন। আবার কর্মক্ষেত্র ত্যাগ করার পর কাজ নিয়ে মোটেও চিন্তা করেন না।
আপনি যদি সচেতনভাবে এই অভ্যাস গড়ে তুলতে পারেন, তবে অচিরেই আপনার উৎপাদনশীলতা হাজার গুণ বেড়ে যাবে। যেমন, আইসল্যান্ডে মানুষ নিজেদের উৎপাদনশীলতা বাড়াতে অল্প সময় কাজ করেন। কিন্তু কাজের সময় সম্পূর্ণ মনোযোগী থাকেন। ফলে তারা স্বাভাবিকের চেয়ে ১০ গুণ বেশি উৎপাদন করতে পারেন।
৪. নমনীয় কাজের সময়সূচি
লুক্সেমবার্গ, সুইডেন এবং স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলোতে কাজের সময়সূচি খুবই নমনীয়। এসব দেশের কর্মীরা ইচ্ছা করলে কর্মক্ষেত্রে কয়েক ঘণ্টা দেরিতে এসে দেরিতে যেতে পারেন। আবার মন চাইলে নির্ধারিত সময়ের কয়েক ঘন্টা আগে এসে নিজের জন্য নির্ধারিত কাজ সেরে আগেই কর্মস্থল ত্যাগ করতে পারেন।
এই নীতি গ্রহণ করার ফলে কর্মীদের সাথে প্রতিষ্ঠানের চমৎকার সম্পর্ক সৃষ্টি হয় এবং পরস্পরের মধ্যে বিশ্বাস আরো দৃঢ় হয়। তাছাড়া কর্মীরা নিজের সুবিধা মতো কাজ করার সুযোগ পান বলে বাড়ি এবং কর্মক্ষেত্র সব জায়গায় অনেক বেশি উৎপাদনশীল থাকেন।
Feature photo: eapo tokyo