নার্সিং হচ্ছে সেবামূলক পেশা। যেখানে কাজ করে একদিকে যেমন মানুষের সেবা করা যায়, তেমনি এই পেশাতে খুব সহজে উজ্জ্বল ভবিষ্যৎও গড়া যায়। দেশে এখন প্রায় সব শহরেই সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল বা ক্লিনিক গড়ে উঠেছে। ক্রমেই বেড়ে চলছে এসব হাসপাতালের সংখ্যা। তাই এসব প্রতিষ্ঠানে প্রতিবছরই নার্সের প্রয়োজন হয়। তবে প্রায় সময় দেখা যায়, অনেক প্রতিষ্ঠানেই দক্ষ নার্সদের অভাব রয়েছে।
বাংলাদেশসহ বিশ্বের সব দেশেই রয়েছে নার্সদের চাহিদা। আসলে এটি এমন একটি পেশা, যার চাহিদা স্থান, কাল, পাত্রে সীমাবদ্ধ নয়। আমাদের দেশে ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ারদের যতটা চাহিদা রয়েছে এবং অভিভাবকদের এসব বিষয়ে পড়ানোর যে প্রবণতা রয়েছে, নার্সিং পেশাতে পড়ার এবং পড়ানোর প্রবণতা তেমন একটা নেই। নার্সিং বিষয়ে অনেকের স্পষ্ট ধারণাও নেই। এ বিষয় নিয়ে কোথায় পড়ালেখা করা যায় কিংবা কী ধরণের সুযোগ সুবিধা রয়েছে এবং কীভাবে এ পেশায় ক্যারিয়ার গঠন করা যায়, সেসব বিষয় নিয়েই আলোচনা করব আজকের নিবন্ধে।
নার্সিং
নার্সিং শব্দের আভিধানিক অর্থ তত্ত্বাবধান করা বা সেবা করা। এই নার্সিং শব্দ থেকেই এসেছে নার্স শব্দটি।
নার্সিং এমন একটি পেশা যা সাধারণ জনগণের স্বাস্থ্য পরিচর্যা ও স্বাস্থ্য সচেতনতামূলক কর্মকাণ্ডের সাথে সম্পৃক্ত। এ পেশার সাথে জড়িত দক্ষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ব্যক্তি নার্স বা সেবিকা নামে পরিচিত।
কাজের ধরণ
কাজের ক্ষেত্র ও অভিজ্ঞতা অনুযায়ী আপনি অ্যাসিস্ট্যান্ট নার্স, স্টাফ নার্স, ওটি সিস্টার বা নার্সিং সুপারভাইজার হিসেবে কাজ করার সুযোগ পাবেন। পাশাপাশি নার্সিং কলেজে ইন্সট্রাক্টর বা ডেমোনস্ট্রেটর ইনচার্জ হিসেবেও অনেকে যোগ দিয়ে থাকেন। এছাড়া, নার্সিং অধিদপ্তরে প্রজেক্ট অফিসার, সহকারী পরিচালক পদেও কাজ করতে পারেন।
সুতরাং, কাজের ক্ষেত্রের উপর নির্ভর করবে আপনার কাজের ধরন কী রকম হবে। তবে সাধারণত নিম্নলিখিত কাজসমূহ একজন নার্স মূল দায়িত্ব হিসেবে পালন করে থাকেন।
- একজন নার্সকে সাধারণত চিকিৎসকের নানা কাজের সহকারী হিসেবে হাসপাতাল বা ক্লিনিকের আউটডোর ও ইনডোর, অপারেশন থিয়েটারে কাজ করতে হয়।
- ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী রোগীর স্বাস্থ্য পরীক্ষা।
- ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী রোগীকে সঠিকভাবে ঔষধ খাওয়ানো।
- রোগীর স্বাস্থ্যের অগ্রগতি বা অবনতি সম্পর্কে ডাক্তারকে নিয়মিত জানানো।
- রোগীর সার্বিক পরিচর্যার দায়িত্ব নেয়া।
- ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন ও পরামর্শ সঠিকভাবে বোঝা ও সে অনুযায়ী রোগীর পরিচর্যা করা।
- রোগীর সমস্যার কথা মনোযোগ দিয়ে শোনা ও ডাক্তারকে জানানো।
- রোগীর স্বাস্থ্যের অগ্রগতি ও অবনতি সম্পর্কে নিয়মিত প্রতিবেদন তৈরি করতে পারা।
পড়ালেখার সুযোগ
এ পেশা শুরুর আগে আপনাকে ডিপ্লোমা ইন নার্সিং (৩ বছর), পোস্ট বেসিক বিএসসি ইন নার্সিং অথবা ব্যাচেলার অব সায়েন্স ইন নার্সিং (বিএসসি) ৪ বছর মেয়াদি কোর্স করতে হবে। এছাড়া অর্থোপেডিকস, সাইকিয়াট্রিক, পেডিয়াট্রিক, সিসিইউ, আইসিইউ ও কার্ডিয়াক নার্সিংসহ বিভিন্ন বিষয়ের ওপর এক বছর মেয়াদী কোর্স চালু আছে।
নার্সিং ও মিডওয়াইফ অধিদপ্তর তথ্যমতে, দেশে বর্তমানে সরকারি ডিপ্লোমা ইন নার্সিং কলেজ আছে ৪৩টি। আর বেসরকারি কলেজ আছে ৭০টি। এছাড়া সরকারি বিএসসি ইন নার্সিং কলেজ আছে ৯টি, আর বেসরকারি কলেজ আছে ২১টি। বছরের বিভিন্ন সময় এসব প্রতিষ্ঠানে ভর্তি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়।
নার্সিংয়ের প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে কোর্সের শেষে ছয় মাসের ইন্টার্নশিপ সম্পন্ন করার পর নার্সিং ও মিডওয়াইফ অধিদপ্তরের আয়োজিত পরীক্ষায় অংশ নিতে হয়। এতে উত্তীর্ণ হবার মাধ্যমে নিবন্ধিত হলেই পেশা হিসাবে নার্সিংকে বেছে নিতে পারবেন।
কোর্সের বিষয় সমূহ
বিদেশি কারিকুলামের সাথে সামঞ্জস্য রেখেই দেশের এসব কোর্সের পাঠ্যসূচি তৈরি করা হয়েছে। এ কোর্সের অন্তর্ভুক্ত বিষয়গুলোর মধ্যে রয়েছে ইন্ট্রোডাক্টরি অব নার্সিং, হিউম্যান অ্যানাটমি, কমিউনিটি নার্সিং, সেমিনার অ্যান্ড রিসার্চ ইন নার্সিং, হিউম্যান ফিজিওলজি, কনসেপ্ট অব হেলথ অ্যান্ড ইলনেস, মেন্টাল হেলথ নার্সিং, পপুলেশন কন্ট্রোল অ্যান্ড ফ্যামিলি প্লানিং, ইন্ট্রোডাক্টরি অব ফার্মাকোলজি, ম্যাটারনাল অ্যান্ড চাইল্ড নার্সিং, নার্সিং অ্যাডমিনিস্ট্রেশন প্রভৃতি।
ভর্তি সংক্রান্ত তথ্য
বিজ্ঞান বিভাগে পড়ুয়াদের অগ্রাধিকার দেয়া হলেও মানবিক ও বাণিজ্য বিভাগের শিক্ষার্থীরাও ভর্তি হতে পারে এই বিভাগে।এইচএসসি’র ফলাফল বের হওয়ার পরপরই ভর্তি কার্যক্রম শুরু হয়। তবে সরকারি কলেজগুলোতে শুধুমাত্র ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীরাই ভর্তির জন্য আবেদন করতে পারবেন। নার্সিং ও মিডওয়াইফ অধিদপ্তরের অধীনে ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে।
নার্সিংয়ের প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে কোর্সের শেষে ছয় মাসের ইন্টার্নশিপ সম্পন্ন করার পর বাংলাদেশ নার্সিং কাউন্সিল আয়োজিত পরীক্ষায় অংশ নিতে হয়। এতে উত্তীর্ণ হবার মাধ্যমে নিবন্ধিত হলেই পেশা হিসাবে নার্সিং নিতে পারবেন।
কাজের সুযোগ
আমাদের দেশে প্রয়োজনের তুলনায় নার্সের সংখ্যা এখনো কম। তাই নার্স হিসাবে নিবন্ধন পাবার পর তুলনামূলকভাবে কম সময়ে চাকরি পাওয়ার সম্ভবনা বেশি।
এ বিষয়ে পড়ার পর দেশ-বিদেশে সর্বত্রই ক্যারিয়ার গড়ার সুযোগ আছে। দেশে সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল, সমাজসেবা অধিদপ্তর, হোটেল, মোটেল, এনজিও এমনকি পর্যটন কর্পোরেশনেও ক্যারিয়ার গড়ার সুযোগ রয়েছে। বর্তমানে আমাদের দেশে তো বটেই, বিদেশেও নার্সিং পেশার দক্ষ ও অভিজ্ঞ লোকদের চাহিদা।
তবে বিদেশে চাকরি পেতে হলে নার্সদের প্রশিক্ষিত হওয়ার পাশাপাশি ইংরেজিতে পারদর্শী হতে হবে। বর্তমানে বাংলাদেশের প্রায় ১৩৫০ জন নার্স সৌদি আরব, লিবিয়া, কানাডা, যুক্তরাজ্যসহ বিশ্বের তেরটি দেশে কর্মরত রয়েছেন। ইংরেজি ভাষা ও উন্নত প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে দক্ষ নার্স গড়ে তুলতে পারলে এই খাতে প্রচুর পরিমাণে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব।
নার্স থেকে পদোন্নতি পেয়ে সিনিয়র স্টাফ নার্স ও সুপারিন্টেনডেন্ট বা নার্সিং ট্রেনিং কলেজের প্রশিক্ষক হওয়ার জন্য প্রয়োজন অভিজ্ঞতা ও বিশেষায়িত কারিগরি দক্ষতা।
নার্সিং পেশাটি একটি দায়িত্বের পেশা। এ পেশায় আসতে হলে মানুষের সেবার মানসিকতা থাকতে হবে। এখানে মানুষের সেবা করা যায় খুব কাছ থেকে। সম্ভাবনাময় এ পেশায় রয়েছে আর্থিক সচ্ছলতা ও মর্যাদার জীবন। সেবাধর্মী এ পেশায় আপনিও অর্জন করতে পারেন সামাজিক মর্যাদা ও ভালো আয়ের সুযোগ।
Featured Image: youtube.com